অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদক দেশের বর্তমান প্রজন্মের জন্য একটি বড় হুমকি। সব অপরাধেরই হাতেখড়ি মাদক। সংশোধনের জন্য কারাগারে যাওয়ার পরও মাদকের সংস্পর্শে অব্যাহত থাকার কারণে বিষয়টি আরো ভয়ংকর হয়ে উঠছে। অনেকে কারাগারে যাওয়ার আগে মাদকসেবী না থাকলেও জামিনে বের হওয়ার পর মাদকাসক্ত হয়ে বের হচ্ছেন এমন তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, কারাগারের ব্যবস্থা নিয়ে আরো গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে। সংশোধনের জন্য যাওয়ার পরও অনেকে অপরাধের হাতেখড়ি নিয়ে বের হওয়াটা খুবই আতঙ্কের।
তবে কারা সদর দপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক কর্নেল শেখ সুজাউর রহমান বলেন, আমরা মাঝে-মধ্যেই সারপ্রাইজ ভিজিট করে থাকি বিভিন্ন কারাগারে। মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত রয়েছে। মাদকের সঙ্গে যদি কেউ জড়িত থাকেন এবং এর প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কারা সদর দপ্তর থেকে ৪২টি কারাগারকে সিসিটিভির মাধ্যমে নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। বাকি কারাগারগুলোও শিগগিরই সদর দপ্তরের মনিটরিংয়ের আওতায় আসবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে চরখাম্বা মোড় এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে যশোর জেলার কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রহরী আশরাফুল মুরাদ রুবেলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার জ্যাকেটের পকেটে ১০০টি ইয়াবা ট্যাবলেট পায় পুলিশ। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে যশোরের নাজির শঙ্করপুর এলাকা থেকে তোরাব আলী নামের আরেক মাদক ব্যবসায়ীকে ১৫০ পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে।
পুলিশ বলছে, মুরাদ নিয়মিত কারাগারের মাদকসেবী বন্দিদের কাছে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক সরবরাহ করতেন। তোরাব নিজেও একসময় কারারক্ষী ছিলেন।
কারা সূত্র বলছে, শুধু গত বছরেই মাদক পাচারের জন্য কমপক্ষে ২৫ জন কারারক্ষীর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবুও কারাগারের অভ্যন্তরে মাদক ব্যবসা নিরবচ্ছিন্ন ছিল।
কাশিমপুর-২ কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সম্প্রতি জামিনে বের হওয়া এক বন্দি এ প্রতিবেদককে বলেছেন, কারারক্ষীদের সঙ্গে কয়েদি, ফয়েজ, নূর হোসেন, হাজতি মনির, রোকন এবং ফয়সাল মাদক বাণিজ্য করছেন দীর্ঘদিন ধরে। তারা নিয়মিত তাদের বাড়িতে টাকা পাঠান। এ ছাড়া ওই কারাগারে ১ নম্বর বিল্ডিংয়ের কয়েদিদের মাধ্যমে বিভিন্ন ওয়ার্ডে বাণিজ্য হয়ে থাকে। ৬ নম্বর বিল্ডিংয়ের একাধিক ওয়ার্ডে মাদকের ওপেন স্পট চলছে প্রশাসনের সহায়তায়।
কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে দীর্ঘদিন ছিলেন এক বন্দি। নাম ফয়েজ আহমেদ (ছদ্মনাম)। সম্প্রতি এ প্রতিবেদককে তিনি বলছিলেন, ওই কারাগারের কয়েদি রাজধানীর শাহজাহানপুরের রিপন, সাহেদ, মোহাম্মদপুরের রিপন, কয়েদি রতন এবং কয়েদি পিচ্চি লিটন কারা প্রশাসনের সহায়তায় দীর্ঘদিন ধরে মাদক ব্যবসা করে আসছেন। এ ছাড়া গাজী বিল্ডিংয়ের একাধিক রুমে মাদকের ওপেন স্পট পরিচালনা হচ্ছে। তিনি একজন বন্দির উদাহরণ দেন, যিনি মার্চের শুরুতে মাদক সেবন করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েন এবং পদ্মা ভবনের লেভেল-৪ এর ৪ নম্বর ওয়ার্ড থেকে কারাগারের রক্ষীদের ৫ হাজার টাকা দিয়ে ছেড়ে দিতে হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, তাদের কাছে তথ্য রয়েছে যে, কারাবন্দিদের একটি অংশ মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এবং কারাগারের অভ্যন্তরেও মাদক সেবন চলে। যদিও কারাগারের অভ্যন্তরে অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে তাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, জেল কর্তৃপক্ষ নিয়মিতভাবে তা করে এবং ব্যবস্থাও নেয়।
জানা গেছে, গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত-৩ কাশিমপুর কারাগার-২-এর রক্ষী আজিজার রহমানকে বন্দিদের মাদক সরবরাহের দায়ে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন। ২০১৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর কয়েকজন রক্ষী শহিদুল ইসলাম নামে এক বন্দিকে তার কাছে ১০০টি ইয়াবা ট্যাবলেটসহ পাওয়ার পর এ ঘটনা ঘটে। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, আজিজারের কাছ থেকে শহিদুল মাদক নিয়ে এসেছিলেন। আরো অনুসন্ধানে আজিজারের বাড়িতে ৬০০টি ইয়াবা ট্যাবলেট এবং ১০০ গ্রাম গাঁজা পাওয়া গেছে।