ড.গোলসান আরা বেগমঃ পুঁজনীয়,বরণীয়,স্মরণীয়,গর্ভধারীনী আমার মা। সেই মায়ের কথা বলছি।যাকে সারা দুনিয়ার মাটি উল্টালেও আর পাবো না।আমার সেই স্নেহময়ী মা,যার জঠরের ছোট ঘরে পুষ্ট হয়েছি আমি,জীবন পেয়েছি। জন্ম কালে পৃথিবীতে এসে বিকট চিৎকার দিয়ে বলেছি আমাকে কোলে তুলে নাও। অন্ন, বস্র, বাঁচার পরিবেশ দাও। তাঁর বুকের দুধ পান করেই প্রথম তৃষ্ণা নিবারণ করেছি। আমার মায়ের চেয়ে সর্বংসহা আর কেহ নাই।মাথার উপর ছায়া হয়ে সর্বক্ষণ স্নেহ আদর দিতেন।আমার বেহেশ্তের চাবি তাঁর পায়ে করে লুটুপুটি।
আমি আমার সেই মমতাময়ী মাকে হারিয়েছি ১৯৯৫ সালে, আজো মনে হয় সেই মা, পিছু ডাকছে আমায় । মায়ের স্মৃতির ছায়াছবি হাঁটতে,বসতে, খাইতে সর্বক্ষণ আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। মনে হয় তিনি আমার মাথায় রেখে হাত বলছেন —এই কর, সেই কর,দেখো জীবনে সফলতা কুড়িয়ে পাবে। এদিকে বা ঐ দিকে যাও,প্রত্যাশা পূরণ হবে। সেই মায়ের চুনের কৌটা, মাথার বালিশ সাজিয়ে রেখেছি অতি যত্নে।
তিনি ছিলেন খুব কর্মট,অতিশয় সহনশীল, মেধাবী।এক হাতেই সংসারের সমস্ত কাজ কর্ম সামলাতেন। নিজের পেট খালি রেখে হলেও সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতেন। দারিদ্র্যতা মায়ের পায়ে পায়ে হাঁটতো।লবণ থাকলে তেল খাকতো না।তবুও কোন অভিযোগ ছিলো না মায়ের । কপালে মশা মাছি মেরে জোছনা রাতে আকাশ পানে থাকিয়ে থাকতেন। শরীরের ঘাম ঝরাতেন সংসারের আয় উন্নতির জন্য। আমার সেই শোলক বলার মা আর নেই। কি ক্লান্তিহীন পরিশ্রমই না করেছেন, তা আগে বুঝিনি।
মা ছিলেন পাঁচ সন্তানের জননী। তিন / চার শ্রেণি পর্যন্ত ছিলো পেটে বিদ্যা।তিনি লিখতে ও পড়তে পারতেন। পূর্ণিমা রাতে মাদুর পেতে গোল হয়ে উঠানে বসে মায়েরর পুতি পাঠ শুনতাম। নবীজীর নাতি হাসান হোসেনের কারবালা প্রান্তরে ফুরাত নদীর তীরে ঘটে যাওয়া গঠনাটি বলতেন, আর বুক ভিজিয়ে কাঁদতেন।আমরা পিন পত্তন শব্দটি না করে, পানির তৃষ্ণায় বুক ফাটা কান্নার কথা শুনে মর্মাহত হতাম।
পারিবারিক ভাবে মা ছিলেন সন্মানী,ধনী ও ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান। নানার বাড়িতে ধান চালের বা বিলাসিতার অভাব ছিলো না।মায়ের মুখে শুনেছি বস্তা ভর্তি কাঁচা টাকা মাথায় নিয়ে হজ্জ করতে গিয়েছিলেন নানা। এক ছেলে ও দুই মেয়েকে নানির হাতে ধরিয়ে দিয়ে অসময়ে নানা দেন অচিন গন্তব্যে পরপারে পাড়ি। সেই থেকে নানার রাজত্বের ঘানি টানতে থাকেন নানি।। মা এতিম হলেও, নানার বাড়িতে হাত ডুবিয়ে দুধে ভাতে বড় হয়েছিলেন। উপছে পড়তো সুখের ঝলকানি
স্বামীর বাড়িতে এসে মা কঠিন দারিদ্র্যতার সঙ্গে লড়াই করতে শুরু করেন। নিজে শাক ভাত দিয়ে মেটাতেন পেটের চাহিদা। কিন্তু সন্তানদের কষ্ট দিতেন না।সকাল থেকে সন্ধ্যাবদি বোবা বধিরের মতো সংসারের নিত্যদিনের চাদর উল্টাতেন। ফর্সা গাল দু’টো লাল হয়ে গেলেও কেউ ছিলো না আঁছল টেনে ধরার। গভীর রাতে বাবার পরিশ্রমের পা দু’টো চেপে দিয়ে হেলিয়ে দিতেন ক্লান্ত দেহ বালিশে।
মায়ের অসুখ বিসুখ হতো না যে, তা নয়। জ্বরে গা পুড়ে গেলেও বলতেন, কিচ্ছু হয়নি ভালো আছি। ডাক্তারের কাছে যাবে বা ঔষধ খাবে তার সক্ষমতা ছিলো না।এক দুই দিন কষ্ট করার পর পাশের বাড়ির মসজিদের হুজুরের পানি পড়া খেয়ে ভালো হয়ে যেতেন।তাবিজ কবজ, পানি পড়া ও ঝাড়ঁফু এর প্রতি ছিলো তার অগাধ বিশ্বাস। তার সন্তানদের পরীক্ষা এলেই হুজুরের ফু নিয়ে আসতেন কলমে। মানত করতেন মসজিদে বা দরগায়।
মায়ের বড় দুই ছেলে ও ছোট মেয়ে অ্যামেরিকায় স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যায়।দেশের মাটিতে পড়ে থাকি আমি আর ছোট ভাই মূকুল। এরপর আমাদের পরিবারে ও চারপাশে চালচক্রেবহু পরিবর্তন আসে। বড় ভাই বাবলু আমাদের পরিবারটিকে শেকড়সহ টেনে গ্রাম থেকে ঢাকা শহরে নিয়ে এসেছিল ১৯৭৮ সালে । স্থায়ী ভাবে বসবাস করছিলাম বাবা মা সহ পাঁচ ভাইবোন ঢাকার কলাবাগানে ১/এ বশির উদ্দিন রোড়ের বাসায়। বড় ভাই নিয়েছিলেন পরিবারের ভরণ পোষণের কঠিন দায়িত্ব।বড় ভাই পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন অ্যামেরিকায়।
নতশিরে জানাই শ্রদ্ধা এই ভাইয়ের এতো বড় সিদ্ধান্ত নেয়া ও স্বপ্ন পূরণের জন্য। বড় ভাই উদার না হলে আমরা হয়তো কিশোরগজ্ঞ জেলার মারীয়া ইউনিয়নের স্বল্পমারিয়া গ্রামে ধুকে ধুকে মরতাম। স্যালুট বড় ভাই তোমায়।
সব দায়িত্ব শেষ করার পর মা যখন মরণ বিছানায় শুয়েছিলো।তিন মাস লড়াই করেছিলো মরণযুদ্ধে। অনেক ঔষধ পাতির পর মা বুঝতে পেরেছিলেন — বেলা ফুরিয়ে আসছে। বিদেশে বসবাসরত ভাইবোন প্রতিদিন মায়ের সাথে টেলিফোনে কথা বলতো। একদিন বাড়ীর চারপাশের উচু উচু দালান দেখিয়ে মা বলেছিলো — এই গুলো সব থাকবে।থাকবো না শুধু আমি। মায়ের চোখে পানি না আসলেও গরম নিঃশ্বাস অনুভব করেছিলাম। এটাই তো সৃষ্টির চিরন্তন নিয়ম। পুরাতন সরে দাঁড়াবে নতুনকে জানাবে স্বাগতম।
অবশেষে এক সন্ধ্যায়, হঠাৎ একটা ঝড় এলো। মায়ের হাত পা অবশ হতে থাকলো। আমরা ডুকরে কান্না শুরু করে দিলাম।মা শুধু বললো — কান্না করে আর কি হবে। এটাই ছিলো মায়ের শেষ কথা। হায় মরণ, তোর দয়া মায়া নেই।তোর মরণ ছোবল বড় বিষাক্ত।
মাকে নিয়ে গেলাম হাসপাতালে। ডাক্তার দৌড়ে এলো।নাড়ীর স্পন্দন পরীক্ষা করে ব্লাড কালচারের টেষ্ট দিলো। নার্স ব্লাড নিতে এসে নাড়ীর রক্ত প্রবাহ না পেয়ে চলে গেলো।
কত ডাকা ডাকি করলাম,মা আর চোখ খুলতে পাড়লো না। শুধু বলছেন উ। কতক্ষণ পর আমার মা আমেনা বেগম হয়ে গেলেন লাশ।পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন, না ফেরার দেশে। লাশের গোসল কাফন সেরে নিয়ে গেলাম পিজি হসপিটালের লাশ সংরক্ষন রুমে। ফ্রিজে লাশ ঢুকিয়ে সুইজ অন করতেই একটা ছেন ছেন করে শব্দ হলো। তখন আমার মায়ের অবস্থা কি হয়েছিলো জানি না।কিন্তু আজো আমার অনুভূতিতে সেই শব্দটি হাতুড়ি পেটা করে। ভয়ে হাত পা অবশ হয়ে আসে।
পর দিন বড় ভাই বাবলু এলো আ্যামেরিকা থেকে ফিরে। সে বার বার টেবিল চাপরিয়ে কান্না করলো, আর বললো— আমি কেন আরো আগে এলাম না। ছোট ভাই বকুল ও ছোট বোন নাহার আসতে পারলো না। সকালে মায়ের লাশ যথারীতি কলাবাগানের বাসায় আনা হলো। আবারো কাফুনের মুখ খুলে ভাইকে দেখানোর পর বশির উদ্দিন রোড় মসজিদে জানাজা করে, বায়তুল মোকারম মসজিদে হলো দ্বিতীয় জানাজা। এর পর লাশ নিয়ে ছুটে গেলাম বনানি গোড়স্থানে। ওখানে আমার বাবার কবরের ডান পাশে দাফন করা হলো। হলো জীবনের শেষ যবনিকা টানা।হায় মৃত্যু, কি করুণ তোমার হাত দু’টো। মা কে রেখে চোখ মুছতে মুছতে সবাই বশির উদ্দিন রোডের বাসায় ফিরে এলাম।
লেখকঃ উপদেষ্টা মন্ডলির সদস্য, বাংলাদেশ কৃষক লীগ।