গ্রামীণ নারী বলতেই কেমন যেন ভেসে উঠে সহজ, সরল এবং সাধারণ একটা জীবনের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু আজ গ্রামীণ নারীরা আর গ্রামীণ থাকছে না। নানা প্রতিকূলতার মধ্যদিয়ে জীবন সংগ্রামের পথ খুঁজে নিয়েছে। গ্রাম ছেড়ে তারা কর্মের সন্ধানে শহরমুখী হয়েছে। শুধু যে তারা কর্মের সন্ধানে শহরমুখী হয়েছে এমন নয়, নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে ইটপাথরের জীবনকে সঙ্গী হিসেবে মেনে নিয়েছে। গ্রামীণ নারীদের এমনি একটা দিন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে যেখানে তাদের ৩৬৪ দিনের থেকে একটা দিন আলাদাভাবে চিন্তা করতে হয়। গত ১৫ অক্টোবর ছিল বিশ্ব গ্রামীণ নারী দিবস। আসলে এই বিশ্ব গ্রামীণ নারী দিবস সম্পর্কে অনেকেই জানে না। এই দিনে তাদের প্রত্যাশা কি অর্জন করতে পেরেছে? সামনে তাদের আরো কঠিন সময় অপেক্ষা করছে কিনা এসব বিষয়ে গ্রামীণ নারীরা কখনোই চিন্তা করে না। বিশ্ব গ্রামীণ নারী দিবস বিশ্ব গ্রামীণ নারী দিবস প্রতি বছর বিশ্বে পালিত হলেও বাংলাদেশে খুব কমই আলোচিত এবং কম পালিত হয়। বাংলাদেশে যে কয়েকটা এনজিও এই দিবস নিয়ে কমসূচি গ্রহণ করে তাদের মধ্যে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা অন্যতম। প্রতি বছর নানা কর্মসূচি এই প্রতিষ্ঠান পালন করে থাকে। এবারও তাদের কর্মসূচির ব্যতিক্রম ঘটেনি। এবারের আয়োজনে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা তাদের নিজস্ব কার্যালয়ে একটি সম্মেলন করে প্রতিষ্ঠানের মহাসচিব এডভোকেট সিগমা হুদার নেতৃত্বে। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘গ্রামীণ নারীরা শহরে কেমন আছে।’ সম্মেলনে কয়েকজন গ্রামীণ নারী তাদের নানা অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। শহরে জীবনের সাথে গ্রামীণ জীবনের তুলনা করেন। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা এসব গ্রামীণ নারীদের শহরে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কাজ করছেন। নারীরা নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে পারে এর জন্য এই প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। ১৯৭৭ সালের ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। যা আজও তাদের কাজ পরিচালিত হচ্ছে সমস্যাগ্রস্ত শিশু ও নারীদের নিয়ে। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা যে সকল কর্মসূচি বা কাজ করে থাকেÑ নারীদের সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, মৌলিক চাহিদা সম্পর্কে সচেতন, শিশুদের ওপর নির্যাতন রোধ, মানব পাচার রোধ, নারীদের বিভিন্ন ধরনের আইনি সহায়তাসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সম্পর্কে সচেতন এবং আইনি সহায়তা প্রদান করে থাকেন। এই প্রতিষ্ঠান দেশের পাঁচটি স্থানে রয়েছে- কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ঝিনাদহ, খুলনা, রাজশাহী এবং কর্মী রয়েছে ৫২ হাজার, ১৩ হাজার নারী নেত্রী রয়েছে। সম্মেলনে আসা কল্যাণপুর ৭নং পোড়া বস্তির রাজিয়া সুলতানার সাথে কথা বলে জানতে পারা যায়, শহর জীবন তার ভালো লাগে না। এখানে সব কিছু অনেক কঠিন এবং বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন যুদ্ধ করতে হয়। গ্রামীণ জীবন অনেক ভালো। গ্রামের খোলামেলা পরিবেশ, বিপদে সবাই এগিয়ে আসে, মানসিক শান্তিতে গ্রামে বসবাস করা যায়। গ্রামীণ সুন্দর পরিবেশ ছেড়ে আসার কারণ জানতে চাওয়া হলে বলেন, তার গ্রামীণ বাড়ি ঘর নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে যায়, গ্রামে থাকার মতো এবং নিজের সব কিছু হারিয়ে শহরে চলে আসে। স্বামী, সন্তানদের নিয়ে শহরে জীবন ভালো লাগে না তার। এখানে সবাই ব্যস্ত জীবন পার করে, যে যার মতো চলে। কারোর সাথে ভালো সম্পর্ক নেই। এরপরও তারা শহরে আসছে এর মূল কারণ শহরে পর্যাপ্ত কাজের সুযোগ রয়েছে। রাজিয়ার মতো নিলুফা বেগম গ্রামের ভিটামাটি হারিয়ে এসেছে শহরের। শহরে জীবন ভালো লাগে না। এরপরও জীবনের তাগিদে এসেছে। তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশ মানবাধিকার সংস্থার সাথে তারা অনেক দিন থেকেই জড়িত। এই প্রতিষ্ঠানের তারা একজন মাঠকর্মী বা বস্তির নেত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিজেকে সাহসী এবং আত্মনির্ভরশীল হয়েছে এবং অন্যদেরকেও উৎসাহিত করেছে। বিভিন্ন সমস্যা এবং সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছে। তাদের কাজের মধ্যে রয়েছে। তারা গরিব নারীদের সচেতনমূলক যেমন, নারীর স্বাস্থ্য, স্বামী বা পরিবার কর্তৃক নির্যাতন সম্পর্কে সচেতন, শিশুর স্বাস্থ্য, নিজের কর্ম সম্পর্কে সচেতন, যৌতুকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, মানব পাচার, গৃহপরিচালিকার বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে বিবাহ বিচ্ছেদ। জিডি। বস্তির নারীদের সহায়তা দিয়ে থাকেন এই বস্তির নেত্রীরা। এদেরকে সচেতন করে আত্মবিশ্বাসী করাই হলো বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার কাজ। আর এই কাজগুলো করে বস্তির নারী নেত্রীরা। গ্রামীণ নারী শহরে কেমন আছে সম্মেলনে এডভোকেট সিগমা হুদা বলেন, বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা অসহায় নারী ও শিশুদের সমস্যা সমাধানের আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে ধাপে ধাপে প্রদক্ষেপ গ্রহণ করে। যাতে অসহায় নারী নিজেদের সমস্যা সমাধান করতে এগিয়ে আসে এর পাশাপাশি অন্য নারীদেরকেউ সচেতন করতে পারে। নারীরা এখন আর অসহায় নয়, নিজের অবস্থা সম্পর্কে, চার পাশের পরিবেশ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা সকল বিষয়ে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার মাধ্যমে সচেতন হচ্ছে। আগে নারী নির্যাতন হলে নারীরা মুখ বুঝে সহ্য করেছে। থানায় যেতে ভয় পেয়েছে। কিন্তু এখন আর নারীরা ভয় পায় না। আইনি সহায়তা নারীরা পাচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে। বাংলাদেশের গ্রামীণ নারীরা নিজের অবস্থান নিজে থেকে তৈরি করে নিচ্ছে। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার অর্জন বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার মহাসচিব অ্যাডভোকেট সিগমা হুদা বলেন, এই প্রতিষ্ঠানের অর্জন এই অসহায় নারীরা। আজ তারা নিজেদের সম্পর্কে সচেতন হতে পেরেছে। নারী ক্ষমতায়নের পুরুষরা অনেক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। সে সকল প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এই অবস্থানে আসতে পেরেছে। গরিব নারী ও শিশুদের জন্য কাজ করতে পেরেছে। নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করে সফল হয়েছে। বাল্যবিবাহ রোধ করতে পেরেছে বিভিন্ন বস্তি থেকে। যৌতুক কমিয়ে আনার জন্য কাজ করেছে। মার্তৃ স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতার বিভিন্ন সময়ে সেমিনার, কাউসিলিং করেছে। এর ফলস্বরূপ, নারীরা সচেতন হয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখেছে। নারীরা এখন আর দুর্বল নয়। কর্মে নিজের অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে। গ্রামীণ নারীরা প্রতিকূল শহরে এসেও সুযোগ কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছে। এখন দরকার তাদের বাসযোগ্য পরিবেশ। কারণ এই নারীরাই হলো দেশের কর্মশক্তির অন্যতম মাধ্যম। এদের সুন্দর পরিবেশ পেলে বাংলাদেশ নতুনভাবে গড়তে পারবে। এই জন্য গ্রামীণ নারীদের দরকার বাসযোগ্য সুন্দর পরিবেশ।
Copyright Daily Inqilab