প্রাণহীন মৌলভীবাজারের হাওর, নদী ও গাঙ জলগড়ায় না তারপরও জলাধার বা জলাশয়

হাওর বার্তা ডেস্কঃ কাগজে কলমে আছে বাস্তবে নেই। আর যেগুলো আছে তাও এখন মরে যাচ্ছে। এমন মহাসংকটে কোনোরকম বেঁচে থাকা জেলার নদী, খাল, হাওর, জলাশয় ও গাঙ। চিরচেনা দৃশ্যে এখন অনেকটাই পরিবর্তন। নানা সমস্যা ও সংকটে এখন তা ধ্বংসের দোরগোড়ায়। তার অন্যতম কারণ নাব্যহ্রাস। দীর্ঘদিন সংস্কারহীনতায় এখন বেহাল। জেলার এসব মিঠা পানির উৎসের অধিকাংশের অস্তিত্ব প্রায় বিলীনের পথে। ভরাট হচ্ছে জেলার নদী, খাল, হাওর ও গাঙ। কিন্তু নেই কোনো সংস্কারের উদ্যোগ। বছরের পর বছর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এমন উদাসীনতায় ঐতিহ্য আর অস্তিত্ব টানাপড়নে। এখন শুধু মানচিত্রেই এসব নদী, গাঙ, ছড়া, খাল, জলাশয় ও হাওর। কিন্তু বাস্তব দৃশ্যে তার মিল নেই। কাগজে কলমের এই মিঠা পানির জলাধারগুলো এখন অনেকটাই বিরান ভূমি। অযত্ন আর অবহেলায় ভরাট হয়ে এখন শ্রেণি পরিবর্তন হয়েছে জল গড়ানো বা জল ধরে রাখার এই উৎসসমূহের। স্থানীয়দের ক্ষোভ বা অভিযোগ ওই সকল স্থান দিয়ে এখন আর জল গড়ায় না। তারপরও কাগজে কলমের পরিচয় জলাধার বা জলাশয়।

এমন অবস্থা এখন এজেলার খরস্রোতা ঐতিহ্যবাহী নদী, খাল, গাঙ, জলাশয় ও হাওরগুলোর। মানবসৃষ্ট নানা সমস্যা ও সংকটে যেগুলো যুদ্ধ করে মৃত্যুপথ যাত্রী হয়ে এখন কোনরকম ঠিকে আছে। নাব্যহ্রাসে জৌলুস হারিয়ে এখন নিজেদের পরিচিতিটাও সংকটাপন্ন। তাই স্রোতস্বী এই নদী, গাঙ, খাল ও হাওর নিয়ে শৈশবের স্মৃতির সঙ্গে বিস্তর ফারাক হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। এখন ধারণ ক্ষমতা না থাকাতে বর্ষা মৌসুমে সৃষ্টি হচ্ছে বন্যা ও দীর্ঘ জলাবদ্ধতা। আর শুষ্ক মৌসুমে মরুভূমি। স্থানীয় মিঠা পানির এসকল উৎসগুলোর এমন বেহালে বিরুপ প্রভাব পড়েছে দেশীয় প্রজাতির মাছ, জলজপ্রাণি ও উদ্ভিদের উপর। খাদ্য ও বাসস্থান নিয়ে তারাও জীবন মৃত্যুর চরম ঝুঁকিতে। স্থানীয়দের শঙ্কা এমন দুর্দশা চলমান থাকলে কয়েক বছরের মধ্যেই তা বিলীন হবে। তারা জানালেন প্রতি বছরই পলি জমে ভরাট হচ্ছে নদী, খাল, গাঙ, জলাশয়, জলাধার ও হাওরগুলো।

আর এই সুযোগে চলে দখল উৎসব। যে যার মত প্রভাব খাটিয়ে চালাচ্ছেন দখল দ্বারিত্ব। এ কারণে ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে চিরচেনা দৃশ্যপট। ভরাট হওয়া অংশে গড়ে ওঠছে ঘরবাড়ি কিংবা ক্ষেতের ভূমি। এ কারণে বর্ষা মৌসুমে যেমন বন্যা হয়ে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ জলাবদ্ধতা। তেমনি শুষ্ক মৌসুমেও পানির অভাবে ব্যাহত হচ্ছে চাষাবাদ। জেলার অন্যতম নদী মনু, ধলাই, ফানাই, সোনাই ও জুড়ী এখন মুমূর্ষু অবস্থায়। অন্যদিকে মরে যাওয়া শাখা নদী বরাক, বিলাস, লাংলী, গোপলা ও আন ফানাই নদীর অস্তিত্বই বোঝার উপায় থাকে না শুষ্ক মৌসুমে। নাব্যহ্রাসের কারণে বর্ষা মৌসুমে পানির ধারণক্ষমতা না থাকায় নদী, গাঙ ও হাওরগুলোর দু’তীর ভেঙ্গে প্লাবিত হয় আশপাশের গ্রাম। পানিতে তলিয়ে গিয়ে ক্ষতি হয় ঘরবাড়ি ও চাষাবাদের। উল্টো চিত্র শুষ্ক মৌসুমে।

নদী, গাঙ ও হাওরের বিলগুলোতে পানি না থাকায় চাষাবাদ নিয়ে বিপাকে পড়েন কৃষিজীবী লোকজন। নদী ও হাওর তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দারা জানান, মৌলভীবাজার সদর, রাজনগর, কুলাউড়া উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মনু নদীর বিভিন্ন স্থানেই শুষ্ক মৌসুমে চর জেগে উঠে। কুলাউড়ায় ফানাই, কমলগঞ্জে ধলাই, জুড়ী উপজেলা জুড়ী ও সোনাই নদীর একই অবস্থা। জানা গেল মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামের পাশে কুশিয়ারা নদীর একটি শাখা বরাক নাম ধারণ করে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। শীতকালে বরাক একেবারে পানিশূন্য হয়ে পড়ে। শ্রীমঙ্গলের রাজঘাট দিয়ে প্রবাহিত লাংলী নদী হেতিমগঞ্জ নামক স্থানে বিলাস নদীতে গিয়ে মিলিত হয়েছে। পাহাড়ের মধ্য দিয়ে বয়ে আসা এ নদীর রূপরেখা খালে পরিণত হয়েছে। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কাগাবলা ইউনিয়নের বাসিন্দারা জানান শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গোপলা নদী তার ঐতিহ্য হারিয়েছে শুধুমাত্র পলির কারণে ভরাট হয়ে।

কুলাউড়া উপজেলার ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়ের বাসিন্দারা জানান ফানাই ও আন ফানান একসময় খরস্রোতা থাকলেও এখন নানা কারণে ভরাট হয়ে যাওয়াতে নেই সেই জৌলুস। সিন্দুরখান এলাকার বাসিন্দারা জানান লাংলী নদীর বিভিন্ন অংশ বালুমহাল হিসেবে ইজারা দেওয়া হয়। স্থানীয়দের কাছে লাংলী নদী নয় এখন তা কালেঙ্গিছড়া হিসেবে পরিচিত। শীতকালে এসকল নদীর বুকে চাষাবাদ হয় শাকসবজি, চরানো হয় গরু, মহিষ ও ছাগল। অন্যদিকে মৌলভীবাজারের কুশিয়ারা নদীর অংশের তলদেশ পলি জমে ভরাট হওয়ায় দেশের বৃহত্তম হাওর হাকালুকি ও কাউয়াদীঘি সমান্তরাল। হাওর দু’টিও ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি নিষ্কাশন এখন বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এ কারণে বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা আর ফসলহানি হাওর দু’টি নিত্যসঙ্গী। একই অবস্থা হাইল হাওরেরও। তাই মৌসুমে আউশ, আমন, বোরো ও সবজি চাষাবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন স্থানীয় কৃষকরা। কৃষকের চাষাবাদের রক্ষায় কাউয়া দীঘি হাওরে প্রায় শত কোটি টাকার মনু প্রকল্পে সেচ সুবিধার জন্য উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন পাম্প বসালেও তা গোড়াতে গলদ থাকায় কাজে আসছেনা।

দুর্ভোগগ্রস্তদের দাবি প্রকল্প পরিকল্পনায় উজানের পাহাড়ি ঢলের পানি ধারনের চিন্তা না করে ওই প্রকল্পের বাস্তবায়নে এই দুর্দশা। বর্ষা মৌসুমে কুলাউড়ার ভাটেরা ও উজান এলাকার ১৮টি স্থান দিয়ে কাউয়া দীঘিতে পানি প্রবেশ করায় এই সেচ পাম্প সেচ দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারে না। আর দীর্ঘ সংস্কারহীনতায় পানির ক্যানেলগুলোও কাজে আসায় উপকৃত হচ্ছেন না কৃষকরা। তাই নতুন করে অনুরূপ আরেকটি পাম্প হাওজের দাবি স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের। অন্যদিকে পলি জমে কুশিয়ারা নদীর সঙ্গে হাওরের সংযোগ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় দেশীয় প্রজাতির মাছের বংশবিস্তার বিরূপ প্রভাব পড়ছে। তাই হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছ। এই নদীগুলোর সঙ্গে হাওর, গাঙ, ছড়া ও খালগুলোর সংযোগ নাব্যহ্রাসের কারণে বিলুপ্ত হওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছের উৎপাদন। স্থানীয় কৃষিজীবীরা জানান দীর্ঘদিন থেকে ভরাট হওয়া নদী, খাল, গাঙ, জলাশয়, জলাধার ও হাওরগুলোর পুনঃখনন না হওয়াতে বর্ষা কিংবা শুষ্ক মৌসুমে আগের মতো তারা চাষাবাদ করতে পারছেন না। শীতকালে আগে কৃষকরা সেচ সুবিধা পেয়েছিল।

তখন কৃষিক্ষেত্রে এসেছিল অভাবনীয় সাফল্য। এই নদীগুলো দিয়ে একসময় বড় লঞ্চ, নৌকা চলাচল করত। দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যবসায়-বাণিজ্য ছিল এই নৌপথকে ঘিরে। অথচ এখন শুষ্ক মৌসুমে মানুষ পায়ে হেঁটে এই নদীগুলো পার হয়। এরই সাথে বড় সড়কগুলোর পাশে থাকা দেশীয় প্রজাতীর মাছের নিরাপদ অভয়াশ্রম এই জলাশয় গুলোও এখন নেই বললেই চলে। জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি প্রবীণ রাজনীতিবীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা এ্যাডভোকেট মুজিবুর রহমান মুজিব ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) মৌলভীবাজার জেলা সমন্বয়ক আ. স. ম ছালেহ সুহেল সাংবাদিককে বলেন দেশীয় প্রজাতির মাছসহ জলজপ্রাণি,উদ্ভিদ ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ভরাট হওয়া এজেলার স্থানীয় খাল, জলাশয়, বিল, নদী, গাঙ ও হাওরগুলো পরিকল্পিত ভাবে দ্রুত খননের  প্রয়োজন। এগুলো পুনখনন হলে তখন অবৈধ দখলও থাকবে না। বন্যা ও খরা থেকে জলজপ্রাণী, উদ্ভিদ, পরিবেশ,প্রতিবেশ ও দুর্লভ প্রজাতির নানা জীববৈচিত্র্যও রক্ষা পাবে।

সূত্রঃ মানবজমিন

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর