ঢাকা ০৭:৫৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মহান মুক্তিযুদ্ধে আলেম সমাজের অবদান

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:৫৩:৫৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮
  • ৫২৫ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আলেম সমাজের মাঝে যিনি সর্বপ্রথম পশ্চিম পাকিস্তানের জালেম শাসকদের জুলুম-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে মুক্তি সংগ্রামের হুংকার দিয়েছিলেন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে সর্বদলীয় মুক্তিসংগ্রাম পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তিনি আলেম সমাজেরই এক উজ্জ্বল নক্ষত্র মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (রহ.)

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে যখন মজলুম বাঙালি জাতি মুক্তির অমানিশায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, তখন বাংলাদেশের গুটিকয়েক নামধারী ইসলামি সংগঠন বা গোষ্ঠী ছাড়া অধিকাংশ ওলামায়ে কেরাম, পীর-মাশায়েখ মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কোনো কোনো ওলামায়ে কেরাম বয়ান-বক্তৃতার মাধ্যমে জনসাধারণকে মহান মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছেন। আবার কেউ কেউ নিজের জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে লড়াই করেছেন।

আলেম সমাজের মাঝে যিনি সর্বপ্রথম পশ্চিম পাকিস্তানের জালেম শাসকদের জুলুম-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে মুক্তি সংগ্রামের হুংকার দিয়েছিলেন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে সর্বদলীয় মুক্তিসংগ্রাম পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তিনি আলেম সমাজেরই এক উজ্জ্বল নক্ষত্র মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (রহ.)। মহান মুক্তিযুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনকারী ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক ছিলেন আলেম সমাজেরই আরেক উজ্জ্বল নক্ষত্র মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ (রহ.)। তার পরামর্শে অসংখ্য মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। আর এ কারণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। শুধু তা-ই নয়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আলেমকুল শিরোমণি মাওলানা হাফেজ্জি হুজুর (রহ.) দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ওপর জুলুম করেছে সুতরাং তারা জালেম। জুলুম আর ইসলাম এক হতে পারে না। তুমি যদি মুসলমান হও, তবে পাকিস্তানিদের পক্ষে যাও কীভাবে? এটা তো জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের প্রতিরোধ।

২৬ মার্চ পাকিস্তানি হানাদারদের গুলিতে শহীদ হন হাতিরপুল জামে মসজিদের ইমাম। বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ আলেম মাওলানা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ (রহ.) এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আমার দায়িত্ব ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা ও যুবসমাজকে যুদ্ধে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা।’ মহান মুক্তিযুদ্ধে মাওলানা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ (রহ.) এর ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ যশোর জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি রওশন আলী তাকে প্রশংসাপত্র ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ প্রদান করেছিলেন।

এছাড়াও আল্লামা দানেশ, মাওলানা ওবায়দুল্লাহ বিন সাইদ জালালাবাদী, মাওলানা আহমদুল্লাহ আশরাফ, মাওলানা এমদাদুল হক আড়াইহাজারী, মাওলানা ফরিদউদ্দিন মাসউদসহ অনেক দেশপ্রেমিক ওলামায়ে কেরাম বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক সার্টিফিকেট প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা।

এছাড়া আরও অসংখ্য ওলামায়ে কেরাম, পীর-মাশায়েখ তাদের নিজ খানকা ও মাদ্রাসাগুলো সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন এবং সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের নিজ গৃহে আশ্রয় দিয়ে নিজেদের অপর্যাপ্ত খাবার খেয়েছেন তাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে। বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ বুজুর্গ মাওলানা ইসহাক (রহ.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত চরমোনাই খানকা, কুমিল্লার মুরাদনগরের কাশিমপুরের পীর সাহেবের খানকা, পটিয়া মাদ্রাসা ও যশোর রেলস্টেশন মাদ্রাসা এর অন্যতম সাক্ষী। মাওলানা আবুল হাসান যশোরী, আল্লামা শামসুদ্দিন কাসেমী, মাওলানা মোস্তফা আজাদসহ অসংখ্য ওলামায়ে কেরাম স্বাধীনতা সংগ্রামকে শুধু সমর্থন দিয়েই ক্ষান্ত হননি, বরং পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে লড়াই করেছেন। সুতরাং এ কথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় অধিকাংশ ওলামায়ে কেরামের রাজনৈতিক ও নৈতিক অবস্থান ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে।

পরিতাপের বিষয় হলো, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গুটিকয়েক ইসলামের নামধারী বা লেবাসধারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিতর্কিত ভূমিকার দায় পুরো আলেম সমাজের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে একটি সংঘবদ্ধ মহল সর্বদা অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে ওলামায়ে কেরাম, পীর-মাশায়েখদের অবদান ও আত্মত্যাগকে তারা শুধু অস্বীকারই করছে না; বরং ঢালাওভাবে পুরো আলেম সমাজের গায়ে রাজাকার ও দেশদ্রোহীতার তকমা লাগাতে অহর্নিশ হীন কসরত করে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের জেনে রাখা উচিত, উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো মুক্তিযোদ্ধার অবদান ও আত্মত্যাগকে অস্বীকার করা অকৃতজ্ঞতা ও দেশদ্রোহীতার শামিল।

তথ্যসূত্র : আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে, জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা ইত্যাদি।

লেখক : প্রিন্সিপাল, মারকাযুল উলুম আজিজিয়া মাদ্রাসা কাজলা (ভাঙ্গাপ্রেস), যাত্রাবাড়ী, ঢাকা

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

মহান মুক্তিযুদ্ধে আলেম সমাজের অবদান

আপডেট টাইম : ১১:৫৩:৫৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আলেম সমাজের মাঝে যিনি সর্বপ্রথম পশ্চিম পাকিস্তানের জালেম শাসকদের জুলুম-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে মুক্তি সংগ্রামের হুংকার দিয়েছিলেন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে সর্বদলীয় মুক্তিসংগ্রাম পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তিনি আলেম সমাজেরই এক উজ্জ্বল নক্ষত্র মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (রহ.)

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে যখন মজলুম বাঙালি জাতি মুক্তির অমানিশায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, তখন বাংলাদেশের গুটিকয়েক নামধারী ইসলামি সংগঠন বা গোষ্ঠী ছাড়া অধিকাংশ ওলামায়ে কেরাম, পীর-মাশায়েখ মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কোনো কোনো ওলামায়ে কেরাম বয়ান-বক্তৃতার মাধ্যমে জনসাধারণকে মহান মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছেন। আবার কেউ কেউ নিজের জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে লড়াই করেছেন।

আলেম সমাজের মাঝে যিনি সর্বপ্রথম পশ্চিম পাকিস্তানের জালেম শাসকদের জুলুম-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে মুক্তি সংগ্রামের হুংকার দিয়েছিলেন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে সর্বদলীয় মুক্তিসংগ্রাম পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তিনি আলেম সমাজেরই এক উজ্জ্বল নক্ষত্র মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (রহ.)। মহান মুক্তিযুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনকারী ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক ছিলেন আলেম সমাজেরই আরেক উজ্জ্বল নক্ষত্র মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ (রহ.)। তার পরামর্শে অসংখ্য মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। আর এ কারণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। শুধু তা-ই নয়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আলেমকুল শিরোমণি মাওলানা হাফেজ্জি হুজুর (রহ.) দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ওপর জুলুম করেছে সুতরাং তারা জালেম। জুলুম আর ইসলাম এক হতে পারে না। তুমি যদি মুসলমান হও, তবে পাকিস্তানিদের পক্ষে যাও কীভাবে? এটা তো জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের প্রতিরোধ।

২৬ মার্চ পাকিস্তানি হানাদারদের গুলিতে শহীদ হন হাতিরপুল জামে মসজিদের ইমাম। বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ আলেম মাওলানা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ (রহ.) এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আমার দায়িত্ব ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা ও যুবসমাজকে যুদ্ধে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা।’ মহান মুক্তিযুদ্ধে মাওলানা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ (রহ.) এর ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ যশোর জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি রওশন আলী তাকে প্রশংসাপত্র ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ প্রদান করেছিলেন।

এছাড়াও আল্লামা দানেশ, মাওলানা ওবায়দুল্লাহ বিন সাইদ জালালাবাদী, মাওলানা আহমদুল্লাহ আশরাফ, মাওলানা এমদাদুল হক আড়াইহাজারী, মাওলানা ফরিদউদ্দিন মাসউদসহ অনেক দেশপ্রেমিক ওলামায়ে কেরাম বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক সার্টিফিকেট প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা।

এছাড়া আরও অসংখ্য ওলামায়ে কেরাম, পীর-মাশায়েখ তাদের নিজ খানকা ও মাদ্রাসাগুলো সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন এবং সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের নিজ গৃহে আশ্রয় দিয়ে নিজেদের অপর্যাপ্ত খাবার খেয়েছেন তাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে। বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ বুজুর্গ মাওলানা ইসহাক (রহ.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত চরমোনাই খানকা, কুমিল্লার মুরাদনগরের কাশিমপুরের পীর সাহেবের খানকা, পটিয়া মাদ্রাসা ও যশোর রেলস্টেশন মাদ্রাসা এর অন্যতম সাক্ষী। মাওলানা আবুল হাসান যশোরী, আল্লামা শামসুদ্দিন কাসেমী, মাওলানা মোস্তফা আজাদসহ অসংখ্য ওলামায়ে কেরাম স্বাধীনতা সংগ্রামকে শুধু সমর্থন দিয়েই ক্ষান্ত হননি, বরং পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে লড়াই করেছেন। সুতরাং এ কথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় অধিকাংশ ওলামায়ে কেরামের রাজনৈতিক ও নৈতিক অবস্থান ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে।

পরিতাপের বিষয় হলো, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গুটিকয়েক ইসলামের নামধারী বা লেবাসধারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিতর্কিত ভূমিকার দায় পুরো আলেম সমাজের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে একটি সংঘবদ্ধ মহল সর্বদা অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে ওলামায়ে কেরাম, পীর-মাশায়েখদের অবদান ও আত্মত্যাগকে তারা শুধু অস্বীকারই করছে না; বরং ঢালাওভাবে পুরো আলেম সমাজের গায়ে রাজাকার ও দেশদ্রোহীতার তকমা লাগাতে অহর্নিশ হীন কসরত করে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের জেনে রাখা উচিত, উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো মুক্তিযোদ্ধার অবদান ও আত্মত্যাগকে অস্বীকার করা অকৃতজ্ঞতা ও দেশদ্রোহীতার শামিল।

তথ্যসূত্র : আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে, জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা ইত্যাদি।

লেখক : প্রিন্সিপাল, মারকাযুল উলুম আজিজিয়া মাদ্রাসা কাজলা (ভাঙ্গাপ্রেস), যাত্রাবাড়ী, ঢাকা