হাওর বার্তা ডেস্কঃ রাজধানীতে শীতের প্রভাব না পড়লেও পুরোদমে শীত নেমেছে গ্রামাঞ্চলে। প্রতিদিন ভোরে এভাবেই কুয়াশায় ঝাপসা হয় চারপাশ। সবুজ প্রকৃতিতে ছড়িয়ে থাকে শিশিরকণা। আর শত শীত-কুয়াশা উপেক্ষা করেই জীবিকার তাগিদে কাজে বেরুতে হয় কর্মজীবী মানুষকে ছবি : সংগৃহীত
শীতার্ত, বানভাসিসহ যে-কোনো দুর্যোগগ্রস্ত এবং বছরের যে-কোনো সময় যে-কোনো অভাবী ও বিপদগ্রস্তের পাশে দাঁড়ানো তথা অন্ন, বস্ত্র, প্রয়োজনীয় ওষুধ বা নগদ টাকাসহ যে-কোনো উপায়ে তাদের সহযোগিতা করা প্রত্যেক বিবেকবান মানুষের জন্য অবশ্য কর্তব্য। কেননা আল্লাহপাকের নির্দেশ হলো ‘আল্লাহ তোমার প্রতি যেমন ইহসান (দয়া বা অনুগ্রহ) করেছে তুমিও সেরূপ ইহসান (দয়া বা অনুগ্রহ) করো।’ (সূরা কাসাস : ৭৭)।
অন্য আয়াতে আল্লাহপাকের ঘোষণা (অসহায় ও বিপদগ্রস্তদের জন্য অর্থ ব্যয়ে উৎসাহ ও নির্দেশ মিশ্রিত) হলো ‘পূর্ব ও পশ্চিম দিকে মুখ ফেরানোতে তোমাদের কোনো কল্যাণ নেই; কিন্তু কল্যাণ রয়েছে কেউ আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতা, আসমানি কিতাব এবং নবীদের প্রতি ঈমান আনলে এবং আল্লাহর ভালোবাসায় আত্মীয়স্বজন, এতিম, মিসকিন, মুসাফির এবং দাসমুক্তির জন্য অর্থদান করলে, নামাজ প্রতিষ্ঠা করলে ও জাকাত প্রদান করলে এবং প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা পূর্ণ করলে, অর্থ সংকটে দুঃখ-ক্লেশে ও সংগ্রাম সংকটে ধৈর্য ধারণ করলে। এরাই তারা, যারা সত্যপরায়ণ এবং তারাই মুত্তাকি।’ (সূরা বাকারা : ১৭৭)। আরেক আয়াতে আল্লাহপাক বলেন, ‘তারা আল্লাহর প্রতি তাদের ভালোবাসার কারণে অভাবগ্রস্ত, এতিম ও বন্দিকে আহার্য দান করে। তারা বলে, শুধু আল্লাহর সাক্ষাৎ (সন্তুষ্টি) লাভের জন্য আমরা তোমাদের আহার্য দান করি এবং তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না।’ (সূরা দাহর : ৮-৯)। তাছাড়া ধনীদের সম্পদে গরিব-দুঃখীদের অধিকার রয়েছে, যা আদায় করা ধনীদের জন্য আবশ্যক। আল্লাহপাক বলেন, ‘তাদের (ধনীদের) ধনসম্পদে অভাবগ্রস্ত ও সুবিধাবঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।’ (সূরা জারিয়াত : ১৯)।
অভাবী ও বিপদগ্রস্তদের সাহায্য-সহযোগিতা করার তাগিদ দিয়ে রাসুল (সা.) বলেছেন ‘তোমরা সায়েলকে (যারা সাহায্যের জন্য হাত পাতে) কিছু না কিছু দাও, আগুনে পোড়া একটা খুর হলেও।’ (নাসাঈ, আহমাদ)। অন্য হাদিসে তিনি বলেছেন ‘তোমরা ক্ষুধার্তকে খাদ্য দাও, রুগ্ণ ব্যক্তির সেবা করো এবং বন্দিকে মুক্ত করো অথবা ঋণের দায়ে আবদ্ধ ব্যক্তিকে ঋণমুক্ত করো।’ (বোখারি)।
অসহায় ও বিপদগ্রস্তকে সাহায্য-সহযোগিতার ক্ষেত্রে জাতি, গোত্র, ধর্ম ও বর্ণগত ভেদাভেদ করার কোনো সুযোগ নেই। তারা (দরিদ্র ও বিপদাপন্নরা) যদি মুসলিম হয় তবে তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করা ঈমানি দায়িত্ব ও কর্তব্য। কারণ ইসলামের দৃষ্টিতে দেশের, এমনকি পৃথিবীর যে-কোনো প্রান্তেরই হোক না কেন প্রত্যেক মোমিন একে অপরের ভাই। আল্লাহপাক বলেন, ‘নিশ্চয়ই মোমিনরা পরস্পর ভাই ভাই।’ (সূরা হুজরাত : ১০)। তাই এক ভাই বিপদে পড়লে অন্য ভাই এগিয়ে আসবে এটাই ঈমানের দাবি ও নিদর্শন। তাছাড়া হাদিসে সব মোমিনকে একটি দেহের মতো বলা হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তুমি মোমিনদের পরস্পর দয়া, ভালোবাসা ও সহানুভূতিতে একটি দেহের মতো দেখতে পাবে। যখন দেহের কোনো একটি অংশ ব্যথা অনুভব করে, তখন পুরো দেহ নিদ্রাহীনতা ও জ্বরের দ্বারা সাড়া দেয়।’ (বোখারি ও মুসলিম)। সুতরাং যে-কোনো এলাকার যে-কোনো মোমিন বিপদে পড়লে দেহের অঙ্গের মতো তাকে রক্ষা করা বা সহযোগিতা করা অন্য মোমিনের জন্য আবশ্যক হয়ে যায়।
অবশ্য নিজের ক্ষতি করে মোটা অঙ্কের দান করার কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই। আল্লাহপাক বলেন, ‘আর ব্যয় করো আল্লাহর পথে, তবে নিজের জীবনকে ধ্বংসের মুখোমুখি করো না। আর মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করো। আল্লাহ অনুগ্রহকারীদের ভালোবাসেন।’ (সূরা বাকারা : ১৯৫)।
কিন্তু সামর্থ্য অনুযায়ী অবশ্যই অসহায় ও বিপদগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াতে হবে। এক্ষেত্রে দান বা টাকার পরিমাণ অতি অল্প হলেও ইসলামে তার গুরুত্ব অনেক বেশি। মহান আল্লাহ চাইলে অল্প দানের বিনিময়ে পাহাড়সম নেকি দিতে পারেন। যেমন আল্লাহপাক বলেন, ‘যারা আল্লাহর পথে তাদের সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি বীজের মতো, যা উৎপন্ন করল সাতটি শিষ। প্রতিটি শিষে রয়েছে একশ দানা। আর আল্লাহ যাকে চান তার জন্য বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’ (সূরা বাকারা : ২৬১)। এ ব্যাপারে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি দানসদকা করে, তা একটি খেজুর পরিমাণও হোক না কেন, আল্লাহ তা নিজ হাতে গ্রহণ করেন। তবে শর্ত এই যে, তা বৈধ পথে উপার্জিত হতে হবে। কেননা আল্লাহ এ বস্তুকেই পছন্দ করেন এবং তা বৃদ্ধি করে নেন আর তা এতটাই যে, এ খেজুর এক পাহাড় পরিমাণ হয়ে যায়।’ (বোখারি ও মুসলিম)।
আর যাদের অর্থ ব্যয়ের সামর্থ্য নেই, তারা বিভিন্নভাবে যেমন শীতবস্ত্র বা যে-কোনো ত্রাণ ক্রয়ে, ভুক্তভোগীদের কাছে তা পৌঁছাতে বা বিতরণের কাজে সাহায্য করতে পারেন। আবার মৌখিক পরামর্শ বা শারীরিকভাবেও ভুক্তভোগীদের উপকার করা যেতে পারে। এতেও অক্ষম হলে তবে অন্তত অসহায় ও বিপদগ্রস্তদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ বা তাদের সান্ত¡না দেওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। কারণ মানবিক সাহায্য-সহযোগিতার ক্ষেত্রে যে-কোনো কর্ম বা চেষ্টার গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। তার প্রমাণ একটি হাদিসে পাওয়া যায়। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘একটি রুটি দানের কারণে তিন ব্যক্তিকে জান্নাতে পাঠানো হবে ১. আদেশদাতা, ২. রন্ধনকর্তা, ৩. সেই পরিবেশনকর্তা যে রুটি নিয়ে গরিবদের মধ্যে পরিবেশন করেছে।’ (হাকিম, তাবারানি)। কিন্তু কোনো ক্রমেই কোনো অসহায়, এতিম বা সায়েলকে ধমকানো যাবে না। কেননা আল্লাহপাকের নিষেধাজ্ঞা হলো ‘সুতরাং আপনি এতিমের প্রতি কঠোর হবেন না এবং সওয়ালকারীকে ধমক দেবেন না।’ (সূরা দোহা : ৯-১০)।
অপরের উপকারকারীরা অসংখ্য নেকি পেয়ে থাকেন। রাসুল (সা.) বলেন ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের উপকার করার জন্য গমন করে, তাকে ১০ বছর নফল ইতিকাফ করার চেয়েও বেশি নেকি দেওয়া হয়। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একদিন ইতিকাফ করে, তার থেকে জাহান্নামকে তিন খন্দক দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়। প্রত্যেক খন্দকের দূরত্ব হলো ‘খাফিকদ্বয়’ তথা আসমান থেকে জমিনের দূরত্বের সমপরিমাণ।’ (মুসতাদরাকে হাকিম)।
অন্যের উপকার করার ফলে এরূপ ব্যক্তিরা গোনাহ মাপ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফেরেশতাদের দোয়া পেয়ে থাকেন এবং তাদের মর্যাদাও বৃদ্ধি পায়। যেমন রাসুল (সা.) বলেছেন ‘কোনো ব্যক্তি যখন কোনো মুসলমান ভাইয়ের উপকারের জন্য গমন করে এবং উপকারটি সম্পাদন করে, তখন আল্লাহ তার মাথার ওপর ৭৫ হাজার ফেরেশতার ছায়া সৃষ্টি করে দেন। এ ফেরেশতারা তার জন্য দোয়া করতে থাকেন। উপকারটা সকালে করা হলে বিকাল পর্যন্ত দোয়া চলে, আর বিকালে করা হলে সকাল পর্যন্ত দোয়া চলে, আর সে ব্যক্তির প্রত্যেক কদমে একটি করে গোনাহ মাফ হয় ও একটি করে মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।’ (ইবনে হিব্বান)।
সুতরাং মানবিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন, দুনিয়া ও পরকালে কল্যাণ লাভ এবং আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতা থেকে বাঁচার জন্য মৃত্যু আসার আগেই মৌখিক, শারীরিক ও আর্থিকসহ যে-কোনো উপায়ে অসহায়, গরিব-দুঃখীকে সাহায্য-সহযোগিতা করতে হবে। অন্যথায় একদিন আফসোস করতে হবে। পবিত্র কোরআনে এসেছে ‘সে বলবে, হে আমার পালনকর্তা, আমাকে আরও কিছুকাল অবকাশ দিলেন না কেন? তাহলে আমি দানসদকা করতাম এবং সৎকর্মীদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।’ (সূরা মুনাফিকুন : ১০)।