আওয়ামী লীগ জোটে মনোনয়ন নিয়ে নেতা-নেতাদের লড়াই

হাওর বার্তা ডেস্কঃ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শরীকদের সঙ্গে আসন বণ্টন নিয়ে বেকায়দায় পড়েছে আওয়ামী লীগ। একই আসনে দলের ও জোটের জয়লাভ করতে সক্ষম একাধিক প্রার্থী থাকায় এমন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে ক্ষমতাসীন দলটিকে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়ায় শরীকদের সঙ্গে আসন বণ্টনে ভিন্ন সমীকরণ করতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে। টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় দলটির নিজ দলের মধ্যে যেমন সক্ষম প্রার্থী হয়েছে, তেমনি জোটের শরীকদের মধ্যেও যোগ্য প্রার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। হিসাব করে দেখা গেছে, পঞ্চাশেরও বেশি আসনে একাধিক ‘হেভিওয়েট প্রার্থী’ রয়েছেন, যাদের মনোনয়ন দিলে বিজয় লাভ করত পারবে বলে দলের নেতাকর্মীদের বিশ্বাস। তারা সকলেই আবার নৌকার টিকেট পেতে জোর লবিং করছেন বলে জানা গেছে।

জানা যায়, আসন্ন নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের মনোনয়ন কাকে বাদ দিয়ে কাকে দিবে এ নিয়ে বোঝাপড়ায় রয়েছে দলের হাইকমান্ড। এবার ভোটে হবে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। আটঘাট বেঁধেই মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন প্রার্থীরা। হেভিওয়েটদের টেনশনের পাশাপাশি আসন হাতছাড়া হওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে। সংসদ নির্বাচনে প্রতিটি আসনের সমান গুরুত্ব হলেও হেভিওয়েট প্রার্থীর দিকেই দৃষ্টি সবার। মনোয়ন দেয়ার ক্ষেত্রে চিরবৈরি দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরের দিকে নজর রাখছে। শেষ বেলায় মনোনয়ন চূড়ান্ত করবে তারা।

দলীয় সূত্রে জানা যায়, এবার ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ প্রতিটি আসনেই জনপ্রিয়তা ও সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিতে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেয়ার কথা জোটকে অবগত করা হয়েছিল। এখন হেভিওয়েট প্রার্থীরা দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা ও কথা বলতে ভিড় করছেন গণভবনে।

হেভিওয়েট প্রার্থীদের মনোনয়ন নিয়ে এরই মধ্যে কয়েকটি আসনে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। বর্তমানে হেভিওয়েট নেতাদের লড়াইয়ের মধ্যে রয়েছে দলের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা। তাদের মধ্যে মাদারীপুর-৩ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বর্তমানে সংসদ সদস্য রয়েছেন। এই আসন থেকেই ২০১৪ সালের নির্বাচনে পাশ করা এমপি সৈয়দ আবুল হোসেন পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে বাদ পড়েন। এবার এ আসনেই মনোনয়নপ্রাপ্তির দৌড়ে আছেন বাহাউদ্দিন নাছিম, সৈয়দ আবুল হোসেন ও আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান (গোলাপ)। তিন হেভিওয়েট ছাড়াও অন্য জনকে মনোনয়ন দিতে পারে মহাজোট।

শরীয়তপুর-১ আসনে বি এম মোজাম্মেল হকও দু-বারের সংসদ সদস্য। এই আসনে দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইকবাল হোসেন। এবার ইকবাল হোসেনের মনোনয়ন পাওয়ার জোরালো আলোচনা রয়েছে। শরীয়তপুর-২ আসনে দীর্ঘদিনের সংসদ সদস্য সাবেক ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী। এই আসনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক একেএম এনামুল হক শামীম ও শওকত আলীর ছেলে খালেদ শওকত আলী মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।

ঢাকা-১ আসন (দোহার-নবাবগঞ্জ) বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত। ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ছয়টি সংসদ নির্বাচনে এই আসনে চারবার জয় পেয়েছে বিএনপি। একবার করে জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি (জাপা)। বর্তমানে এ আসনের সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির সালমা ইসলাম। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি চায় আসন উদ্ধার করতে। আর জাপা চায় জয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে। এই আসনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন দলের সভানেত্রীর বেসরকারি খাত উন্নয়নবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি নির্মল রঞ্জন গুহ।

ঢাকা-১৮ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সাহারা খাতুন। এই আসনে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। মহাজোটের সমীকরণে কপাল পুড়তে পারে সাবেক এ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর।

নরসিংদী-৫ (রায়পুরা) আসনে সাবেক মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু অসুস্থ। এ আসনে তার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রিয়াজুল কবিরের (কাওছার) নাম আলোচনায় আছে।

নোয়াখালী-৪ আসনে একরামুল করিম চৌধুরী দু’বারের সংসদ সদস্য। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। প্রার্থী হিসেবেও বেশ শক্তিশালী। কিন্তু তার কপাল পুড়তে পারে মহাজোটের কারণে। এই আসনে প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে আছেন যুক্তফ্রন্টের নেতা ও বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান।

দেশের ভিআইপি আসন সিলেট-১ এর জন্য বর্তমান এমপি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। নিজের ভাই ড. এম এ মোমেন যাতে পান, সেদিকেই তার তৎপরতা বেশি।

পাবনা-১ আসনের বর্তমান এমপি সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু। এ আসনে মনোনয়নপত্র নিয়েছেন সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ।

চাঁদপুর-২ (মতলব উত্তর-মতলব দক্ষিণ) আসনে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া এবং তার ছেলে সাজেদুল হোসেন চৌধুরী দীপু, যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মুজিবুর রহমান চৌধুরী, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট নুরুল আমিন রুহুল এবং তরুণ শিল্পপতি আওয়ামী লীগ নেতা এম ইসফাক আহসান।

চাঁদপুর-৩ (সদর-হাইমচর) আসনে মনোনয়পত্র সংগ্রহ করেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি। এ আসনে হেভিওয়েট প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী ও আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রেদওয়ান খান বোরহান।

দেশের অন্যতম হেভিওয়েট আসন হিসেবে পরিচিত ফরিদপুরের-১ সংসদীয় আসন। দলের টিকিট পেতে কেন্দ্র এবং তৃণমূলের দৃষ্টি আকর্ষণে অবলম্বন করা হচ্ছে নানা পন্থা। আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এ আসনে নৌকার পক্ষে গণসংযোগ চালাচ্ছেন বর্তমান এমপি আব্দুর রহমান, সাবেক এমপি কাজী সিরাজুল ইসলাম, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত সিকদার, আওয়ামী কৃষক লীগের সহসভাপতি আরিফুর রহমান দোলন ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপকমিটির সহ-সম্পাদক খান মইনুল ইসলাম মোস্তাকসহ আরও কয়েকজন।

বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত সিলেট-৬ আসনে এবার মহাজোটের প্রার্থী হতে যাচ্ছেন সদ্য বিকল্পধারায় যোগ দেওয়া সাবেক বিএনপি নেতা শমসের মবিন চৌধুরী। এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালিকায় বর্তমান সংসদ সদস্য ও শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের নাম রয়েছে। গত নির্বাচনে ফেনী-১ আসনে জাসদের শিরিন আক্তার জোটের মনোনয়ন পেয়ে ছিলেন। শিরিন আক্তার এবারও ১৪ দলীয় জোটের মনোনয়ন পাচ্ছেন বলে জানা গেছে। তবে এ আসনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক প্রটোকল অফিসার আলাউদ্দিন চৌধুরী নাসিম আওয়ামী লীগের মনোনয়নের জন্য লড়ছেন।

ফেনী-২ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারী। অন্যদিকে মনোনয়ন চেয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য জয়নাল হাজারী।

বাগেরহাট-৪ (মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলা) আসনে মনোনয়নের জন্য লড়ছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান সংসদ সদস্য ডা. মোজাম্মেল হোসেন, ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য আমিরুল ইসলাম মিলন।

ঝিনাইদহ-৩ (মহেশপুর ও কোটচাঁদপুর) আসনে বর্তমান এমপি নবী নেওয়াজ, সাবেক এমপি শফিকুল আজম খান চঞ্চল, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সহ সম্পাদক টিএম আজিবুর রহমান মোহন, থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাজ্জাতুজ জুম্মা চৌধুরী ও মায়া তালুকদার মনোনয়ন চান।

মাগুরা-১ (শ্রীপুর ও সদরের কিছু অংশ) আসনে মনোনয়ন পেতে তৎপরতা চালাচ্ছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মেজর (অব.) আবদুল ওয়াহাব এমপি, সংরক্ষিত আসনের এমপি কামরুল লায়লা জলি, প্রধানমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব অ্যাডভোকেট সাইফুজ্জামান শিখর, সাবেক জেলা পরিষদ প্রশাসক ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাড. সৈয়দ শরিফুল ইসলাম, উপজেলা আওয়ামী লীগে নেতা কুতুবুল্লাহ কুটি।

খুলনা-৪ (রূপসা, তেরখাদা ও দিঘলিয়া) আসনে সাবেক হুইপ, বর্তমান সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মোস্তফা রশিদী সুজা, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, সাবেক সংসদ সদস্য মোল্লা জালাল উদ্দিন, জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সাংগঠনিক সম্পাদক কামরুজ্জামান জামাল মনোনয়ন চায়।

মৌলভীবাজার-২ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুল মতিন ছাড়াও মনোনয়ন ফরম কিনেছেন কুলাউড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আসম কামরুল ইসলাম, কুলাউড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এ কে এম সফি আহমদ সলমান, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক শফিউল আলম নাদেল, বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক এআইজি সৈয়দ বজলুল করিম বিপিএম। এবার বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারায় হয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করবেন এম এম শাহীন। তিনি পেতে পারেন বলে অনেকেই প্রত্যাশা করছেন।

কুমিল্লা-৭ (চান্দিনা) আসনে সাবেক ডেপুটি স্পিকার, আ’লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক মো. আলী আশরাফ এমপি। অপরদিকে রয়েছে হেভিওয়েট প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি, স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত।

ক্ষমতাসীন দলের একাধিক প্রভাবশালী নেতা জানান, আগামী নির্বাচনে হেভিওয়েট প্রার্থী থেকে যাদের নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে তাদের মনোনয়ন বিএনপি নির্বাচনে এলেও পরিবর্তন হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। বিএনপি নির্বাচন করবে ধরে নিয়েই এই তালিকা করা হয়েছে।

আসন্ন একাদশ সংসদ নির্বাচনে কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হলে আওয়ামী লীগ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হবে বলে জানিয়েছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর