হাওর বার্তা ডেস্কঃ দেশে এখন সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও প্রাণঘাতী মাদক হচ্ছে ইয়াবা। এই মরণ নেশায় বুঁদ হয়ে আছে দেশের যুব সমাজ। গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-বাজারে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে কী নগরে—সব খানে হাত বাড়ালেই মিলছে ইয়াবা ট্যাবলেট। একটা সময় গাঁজাই ছিল দেশীয় মাদক। প্রচলিত ওই মাদকের বাইরে আসা শুরু হয় হেরোইন। এরপর ভারত সীমান্ত দিয়ে আসে ফেনসিডিল। হেরোইন, ফেনসিডিল বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার মধ্যেই সীমান্ত দিয়ে আসা শুরু হয় ইয়াবা। দেশে এবার ইয়াবার প্রাণনাশী থাবা বন্ধে যখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ অভিযান চলছে ঠিক সেই মুহূর্তে সন্ধান মিলেছে নতুন এই মাদকের। যা ইয়াবার চেয়ে ভয়ঙ্কর! নতুন মাদকের সন্ধান পাওয়ার পর নড়েচড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
পূর্ব আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়া থেকে আসা নতুন ধরনের এই মাদকের প্রচলিত নাম ‘খাট’। আর এর বৈজ্ঞানিক নাম ‘এনপিএস’ (নিউ সাইকোট্রফিক সাবসটেনসেস)। বিশ্বে ইয়াবাকে ছাড়িয়ে গেছে এই ‘এনপিএস’। বিশ্বে মাদক সেবনপ্রবণ ৮০টি দেশ এবং অঞ্চলে জরিপ করে ৭০টিতেই এনপিএসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। গত বছর জাতিসংঘ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ইউনাইটেড নেশন্স অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম (ইউএনওডিসি) এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এনপিএস’ সেবনকারীর শেষ গন্তব্য ধীরে ধীরে আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া।
‘এনপিএস’ সেবনের পর তা মানবদেহে ইয়াবার চেয়ে ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। নতুন এই মাদকটি ফেনসিডিল-ইয়াবার মতো সীমান্তপথে নয়, আকাশপথে পাচার হয়ে এসেছে। গত শুক্রবার দুপুরে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ৮৬১ কেজি ওজনের একটি চালান ধরা পড়েছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। যার বাজার মূল্য ১ কোটি ২৯ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ টাকা। এ ঘটনায় পাচারকারীকেও আটক করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি)। চালানটি পূর্ব আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়া থেকে কয়েক দিন আগে গ্রিনটির (সবুজ চা) প্যাকেটের আড়ালে আনা হয়েছিল। যা বাংলাদেশ থেকে খালাস হয়ে ভারতের যাওয়ার কথা ছিল।
এদিকে ডিএনসির রাসায়নিক পরীক্ষক আবু হাসান বলেন, বাংলাদেশে এই ধরনের মাদক নতুন। আফ্রিকার দেশগুলোতে এই ধরনের মাদক সেবন করার কথা শোনা যায়। এখানে ক্যাথিনিন জাতীয় পদার্থ থাকে যা ইয়াবার মিথাইন এমফিটামিনের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। এটি সাধারণত যৌন আকাঙ্ক্ষা বাড়াতে, রাত জেগে থাকতে এই মাদক ব্যবহার হলেও এটি সেবনে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।
মাদকবিষয়ক আন্তর্জাতিক জার্নালগুলো বলছে, ‘এনপিএস’ বিষয়ে স্পষ্ট করে পরিভাষা বিশ্লেষণ করা কঠিন। তবে এনপিএসকে সংজ্ঞায়িত করা হয়, অপব্যবহারের পদার্থ, যা ১৯৬১ সালের প্রচলিত মাদক আইন অথবা ১৯৭১ সালের ওষুধ আইনে নিয়ন্ত্রণযোগ্য নয়। কিন্তু এটা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অনেক এনপিএস প্রথমবারের মতো সংশ্লেষণ বা সমন্বয় হয় ৪০ বছর আগে। কিন্তু সম্প্রতি এটি বাজারে ক্ষতিকারক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যা আইনের মধ্যে পড়ে না বা যা নিয়ে আইন তৈরিও হয়নি। এতে করে পুলিশ প্রশাসনও হিমশিম খাচ্ছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) ঢাকা মেট্রো অঞ্চলের সহকারী পরিচালক খোরশেদ আলম জানান, গোপন সংবাদে ডিএনসির গোয়েন্দা শাখার অতিরিক্ত পরিচালক নজরুল ইসলাম শিকদারের নেতৃত্বে অভিযানে বিমানবন্দরের কার্গো গুদাম এলাকা থেকে ৪৬৮ কেজি ওজনের চালানটি জব্দ করা হয়। পরে রাজধানীর শান্তিনগর প্লাজার দোতলায় অভিযান চালিয়ে আরো প্রায় ৪০০ কেজি ওজনের মাদক জব্দ করা হয়। এ সময় নাজিম নামে একজনকে আটক করা হয়। নাজিম শান্তিনগরের নওয়াহিন এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপক। এই প্রতিষ্ঠানের ঠিকানায় চালানটি দেশে আসে। এই চালানের সঙ্গে নওয়াহিন এন্টারপ্রাইজের মালিকও জড়িত। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়া থেকে কয়েকটি রুটে ঘুরে চালানটি পার্সেলের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসে। এর গন্তব্য ছিল ভারত। ইথিওপিয়া থেকে জাহিদ মোহাম্মদ ইউসুফ নামে এক ব্যক্তি চালানটি ঢাকায় পাঠান। আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) এ চালানটি আটকে সহায়তা করে। বাংলাদেশে অপ্রচলিত মাদক ‘খাট’ কিংবা ‘এনপিএস’ মূলত ইয়াবার কাঁচামাল এমফিটামিনের মতোই মাদকদ্রব্য। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এ ধরনের মাদকের চালান জব্দ করা হলো। এর আগেও একইভাবে মাদক পাচার হয়েছে বলেও ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তদন্তকারীরা বলছেন, ‘খাট’ বা ‘এনপিএস’ দেশে প্রচলিত নয় বলে মাদকের তালিকায় নেই। তবে এটি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের অন্য মাদকের বিবেচনায় ‘খ’ ক্যাটাগরির মাদক হবে। এরই মধ্যে মাদকের চালানটি পরীক্ষার জন্য কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক নজরুল ইসলাম শিকদার জানান, এক ধরনের গাছ থেকে ‘এনপিএস’ তৈরি হয়। নতুন এ মাদকটি অনেকটা চায়ের পাতার গুঁড়ার মতো। পানির সঙ্গে মিশিয়ে তরল করে সেবন করা হয়। সেবনের পর মানবদেহে এক ধরনের উত্তেজনার সৃষ্টি করে। অনেকটা ইয়াবার মতো প্রতিক্রিয়া হয়। ‘এনপিএস’ বা ‘খাট’ ইয়াবার মতো কাজ করলেও গ্রিনটির মতো প্যাকেটে করে পাচার করা হয়। দেশে আবার নতুন করে প্যাকেট করে বাইরে পাঠানো হয়। কেনাবেচার পাশাপাশি ‘এনপিএস’ বা ‘খাট’ বাংলাদেশকে পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করে আসছিল শান্তিনগরের নওয়াহিন এন্টারপ্রাইজ। চায়ের প্যাকেটের আড়ালেই এটি অন্য দেশে পাঠিয়ে আসছে চক্রটি। এর আগে আরো দুইবার এই মাদকের চালান দেশে আনার পর বাইরে পাচার হয়েছে বলে জানতে পেরেছে ডিএনসি।
চালানের ঘটনায় আটক নাজিম ডিএনসির কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন, এনপিএসের চালানটি আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবার জিয়াদ মোহাম্মাদ ইউসুফ বাংলাদেশে পাঠিয়েছেন। ইউসুফের সঙ্গে দুবাইতে পরিচয় হয় নাজিমের। সেখান থেকে দেশে আসার পর ‘গ্রিনটির’ আড়ালে ঢাকায় পাঠানোর পর তা আবার প্যাকেট করে ইউরোপ-আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় পাঠানোর চুক্তি হয়। এর জন্য প্রতি চালানে নাজিম দেড় হাজার ডলার করে পেতেন। নাজিম জানিয়েছেন, দুবাইয়ে থাকাকালীন ইউসুফের মাধ্যমেই পরিচয় হয় এই মাদকের আরেক ব্যবসায়ী দুবাই প্রবাসী আবিদের সঙ্গে। ব্যবসায়িক কাজে নাজিম দীর্ঘদিন দুবাইতে ছিলেন। সেখানে তার একটি বন্ধু সার্কেল গড়ে উঠে। ওই সার্কেলে ইউসুফ ছিলেন। তবে নাজিম দাবি করেছেন, জব্দ মাদককে তিনি ‘চা’ বলেই জানতেন।