ঢাকা ১০:৫১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মুখ তুললেই এখনো আকাশ

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৫:৪৬:১৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৮
  • ৪১২ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ অবিরাম দুঃসংবাদ। খ্যাপাটে ঘোড়ায় চড়ে ছুটে আসছে মৃত্যুর মিছিল। ঘর ও বাহির একাকার। মায়ের কোল থেকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে শিশু। উদ্‌ভ্রান্ত মানুষ ছুটছে কিসের পিছে নিজেই জানে না। বিতণ্ডা পরিণতি খুঁজছে হত্যায়। চলন্ত গাড়ি থেকে কাউকে ছুড়ে ফেলার আগে দুদণ্ড ভাবছে না কেউ। কেউ কেউ জমাট অভিমানে নিজেই ডেকে আনছে সমাপন। দেশ ও বিদেশ একই পাটাতনে এসে মিলছে যেন। বিশ্বগ্রামে দুর্দশাই যেন হয়ে উঠছে একমাত্র আন্তর্জাতিক। কি আফ্রিকা, কি ইউরোপ, কি এশিয়া, সবখানে এক অনিঃশেষ হাহাকার জমাট বেঁধে উঠছে।

সিরিয়া বা গাজায় স্নাইপারের গুলিবিদ্ধ শিশুটির শূন্য চোখের থেকে আলাদা নয় কুষ্টিয়ার আকিফার চোখ। আলাদা নয় মানুষের নিষ্ঠুরতা। শুধু চোখগুলো ভাষাহীন হয়ে পড়ার কারণটা আলাদা। কোথাও যুদ্ধের বাস্তবতায় চলছে বেশুমার হত্যা, কোথাও বেঁচে থাকাটাই যুদ্ধ। জার্মান দার্শনিক ফ্রিডরিখ নিৎশে অবশ্য বহু আগেই বলে গেছেন, যুদ্ধ অনিবার্য। সুতরাং যুদ্ধে নেমে পড়াটাই দস্তুর। কিন্তু নিৎশের যুদ্ধ যতটা বস্তুর পৃথিবীতে, যতটা গোলা-বারুদের তার চেয়ে বেশি চিন্তার; ইতির সঙ্গে নেতির।

মানুষ এ পৃথিবীতে যুদ্ধ করেই বেঁচে আছে। এটা কে না জানে। আদি থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিনিয়ত তাকে যুদ্ধ করে বাঁচতে হয়। আগের চেয়ে এখনকার বাস্তবতায় ফারাক এটাই যে আগে প্রকৃতির সঙ্গে সরাসরি লড়াইয়ে নামতে হয়েছিল মানুষকে। ক্রমে কিছু সুবিধাপ্রাপ্ত তাদের হয়ে যুদ্ধ লড়ার মতো কিছু দুর্ভাগাকে নিয়োগ করার ক্ষমতা অর্জন করে। এই নিযুক্ত ব্যক্তি ও কর্তার সম্বন্ধটি ক্রমে বদলে এসে আজকের দুনিয়ার জাতীয়তাবাদ, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্রসহ নানা তন্ত্র ও মন্ত্রের মধ্যস্থতার পাল্লায় পড়েছে। এতে বাস্তবতা কিন্তু বদলায়নি। সিরিয়ার যার হাতে যে মরছে, তাদের মধ্যে নেই কোনো পারস্পরিক বৈরিতা। একই অবস্থা ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে সত্য। যুদ্ধক্ষেত্রের উদাহরণ দিতে হয়, কারণ অপমৃত্যু ও এর কারণের মধ্যকার এ সম্বন্ধহীনতা বোঝার জন্য এটিই সবচেয়ে ভালো জায়গা। সহজে মগজে ঢোকে।

এ প্রসঙ্গে ইতালীয় গল্পকার ইতালো কালভিনোর একটি গল্পের কথা মনে পড়ছে। গল্পের নায়ক একজন অপমানিত ও ক্ষুব্ধ ব্যক্তি, নাম লিগি। সে ক্ষুব্ধ আলবার্তো নামের এক ব্যক্তির ওপর, যে তাকে অপমান করেছে, যার নিবাস পাশের দেশে। সেই দেশের সঙ্গে লিগির দেশের যুদ্ধ বাধে। লিগিও যেতে চায় সে যুদ্ধে। উদ্দেশ্য আলবার্তোকে হত্যা করা। শুনে লিগির দেশ তাকে সৈনিকের প্রশিক্ষণ দেয়, আর বলে দেয় ব্যক্তিগত শত্রুতাবশত কাউকে হত্যা করাটা যুদ্ধের উদ্দেশ্য নয়। নানা বাগ্‌বিতণ্ডার পর লিগি শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে যেতে রাজি হয়। শত্রু দেশে গিয়ে আলবার্তোর খোঁজে থাকা লিগি বিধ্বংসী যুদ্ধে মেতে ওঠে। প্রচুর শত্রুসেনা নিহত হয় তার হাতে। কিন্তু আলবার্তোকে পায় না সে। যত দিনে পায়, তত দিনে শান্তির ধবধবে সাদা পতাকা দেখিয়ে যুদ্ধের মীমাংসা হয়ে গেছে। এবারে আলবার্তোকে খুঁজতে এবং অহেতুক হত্যা করা লোকেদের পরিবারের কাছে ক্ষমা চাইতে সেই দেশে যায় লিগি। একদিন আলবার্তোকে খুঁজে পায় সে। যথারীতি হত্যাও করে। কিন্তু এবার আর আগের মতো তার কোনো পুরস্কার মেলে না। বরং ফাঁসিতে ঝুলতে হয় তাকে।

কালভিনো সাংবাদিক ছিলেন। বিচিত্র ও নিষ্ঠুর সব তথ্যের পৃথিবীতে বিচরণ ছিল তাঁর। তাই তিনি বিশ্বসমাজ ও রাজনীতির বিকট চিত্রটি সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তিনি জানতেন, আজকের মানুষ যে নীতি-আদর্শের কথা বলে আসছে, তার ভেতরটা একেবারে ফাঁকা; টোকা দিলেই বিকট শব্দে ঠনঠন করে উঠবে। মানবাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে যত মানুষ নিহত ও নিঃস্ব হয়েছে ও হচ্ছে, উন্নয়নের চোরাবালিতে নাম-পরিচয়সর্বস্ব নিয়ে যতজন তলিয়ে গেছে ও যাচ্ছে, শুধু তাদের হিসাব নিলেই এ সত্য ধরা দেবে তার সমস্ত প্রকরণ নিয়ে। আর বিশ্বপ্রকৃতির হিসাব নিতে গেলে, প্রতিবছর মানবসৃষ্ট কারণে বিলুপ্ত হওয়া প্রজাতির খোঁজ নিতে গেলে, জীবন মুখ লুকাবে লহমার বিরতিতে।

প্রতিদিন মৃত্যু হচ্ছে। জীবনের নিয়মে মৃত্যু আসে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু কিছু মৃত্যু আমাদের হৃদয়কে মুহূর্তের জন্য রক্তশূন্য করে দেয়। কিছু মৃত্যু আমাদের চোখের সামনে তির্যক হাসি দিয়ে ঝুলতে থাকে। কিছু মৃত্যু আছে, যা প্রখর কিছু চোখের জন্ম দেয়, বিষাদের তির থেকে যে চোখ আমাদের কাছে নিয়ে আসে প্রশ্নবাণ। আমরা সে চোখের দিকে তাকাতে পারি না। আমরা ভুলে থাকতে চাই সে চোখ। আকিফার মৃত্যু রিনা খাতুনকে এমনই দুটি চোখ দিয়েছে। আকিফার বাবা হারুন অর রশিদের সজল চোখ এখন আমাদের আশ্বস্ত করে তুলছে। আমরা মুখ ঘুরিয়ে অন্য কোনো দৃশ্য দেখতে চাই।

হারুন অর রশিদ বলেছেন, ভিডিওটা যোগাযোগমন্ত্রী দেখবেন কি না। তাঁর এ প্রশ্ন কিংবা আহ্বানে যন্ত্রণার প্রতিধ্বনি শোনা যায়। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে এক স্তব্ধতা গ্রাস করতে চায় সবাইকে। কিন্তু শেষতক আর তা হয় না। স্তব্ধতার এত শক্তি কই যে গ্রাস করবে? তাই অভিজ্ঞ চোখেরা ফের নির্বাচন কমিশনের দিকে, অঢেল উন্নয়ন ও তৎসংশ্লিষ্ট অমৃতবচনের দিকে, মসনদের সুখবঞ্চিতদের অভিযোগের দিকে ঘুরে যায়। অভ্যস্ত চোখ জরিপ করতে শুরু করে বাঁটোয়ারার। ভোট-প্রকৌশল ও সে অভিমুখী যাত্রার অনিশ্চয়তা ঘুমোতে দেয় না। আমরা সেসব হিসাব সামনে নিয়ে ব্যস্ত করে তুলেছি নিজেকে এবং অন্যদের। কারণ, আমরা জানি আকিফার মতো শিশুদের মৃত্যু কতটা যন্ত্রণার।

ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধের বাস্তবতায় মৃত্যুকে অনেক আগেই মেনে নিয়েছে মানুষ। নিহত লোকজনকে মহিমান্বিত করতে শহীদের মতো নানা অভিধাও তৈরি করেছে। কিন্তু নিতান্ত বেখেয়ালের দুর্ঘটনায়, পলকের ক্রোধের বলি হতে হয় যখন কাউকে, তখন তার স্বজনদের কী বলা যেতে পারে? তার চোখের শূন্য কিন্তু তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে দাঁড়ানো যায় কী করে? তাই কেউ কিছু বলছে না, বলতে গিয়ে গিলে ফেলছে, দাঁড়াতে গিয়ে ফের ছুটছে। অবিরত। এক খবর থেকে আরেক খবরে গঙ্গাফড়িংয়ের মতো লাফিয়ে যাচ্ছে সবাই। দুঃসংবাদের পাহাড় বুকে পুষে ঠোঁটে টানছে স্মিত হাসি। কিন্তু হাসছে না কেউ। এক অতল বিষাদ চেপে বসে আছে। আমরা নড়তে ভুলে যাচ্ছি; আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠছি। ভুলে যাচ্ছি জীবিত থাকা ও বেঁচে থাকার পার্থক্য। আমরা মুখ তুলছি না আর। অথচ মাথা তুললেই এখনো আকাশ। সেদিকে চোখ রেখে আমরাও জেগে উঠতে পারি, পারি বেঁচে উঠতে। এই বেঁচে ওঠার ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছুই।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

মুখ তুললেই এখনো আকাশ

আপডেট টাইম : ০৫:৪৬:১৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৮

হাওর বার্তা ডেস্কঃ অবিরাম দুঃসংবাদ। খ্যাপাটে ঘোড়ায় চড়ে ছুটে আসছে মৃত্যুর মিছিল। ঘর ও বাহির একাকার। মায়ের কোল থেকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে শিশু। উদ্‌ভ্রান্ত মানুষ ছুটছে কিসের পিছে নিজেই জানে না। বিতণ্ডা পরিণতি খুঁজছে হত্যায়। চলন্ত গাড়ি থেকে কাউকে ছুড়ে ফেলার আগে দুদণ্ড ভাবছে না কেউ। কেউ কেউ জমাট অভিমানে নিজেই ডেকে আনছে সমাপন। দেশ ও বিদেশ একই পাটাতনে এসে মিলছে যেন। বিশ্বগ্রামে দুর্দশাই যেন হয়ে উঠছে একমাত্র আন্তর্জাতিক। কি আফ্রিকা, কি ইউরোপ, কি এশিয়া, সবখানে এক অনিঃশেষ হাহাকার জমাট বেঁধে উঠছে।

সিরিয়া বা গাজায় স্নাইপারের গুলিবিদ্ধ শিশুটির শূন্য চোখের থেকে আলাদা নয় কুষ্টিয়ার আকিফার চোখ। আলাদা নয় মানুষের নিষ্ঠুরতা। শুধু চোখগুলো ভাষাহীন হয়ে পড়ার কারণটা আলাদা। কোথাও যুদ্ধের বাস্তবতায় চলছে বেশুমার হত্যা, কোথাও বেঁচে থাকাটাই যুদ্ধ। জার্মান দার্শনিক ফ্রিডরিখ নিৎশে অবশ্য বহু আগেই বলে গেছেন, যুদ্ধ অনিবার্য। সুতরাং যুদ্ধে নেমে পড়াটাই দস্তুর। কিন্তু নিৎশের যুদ্ধ যতটা বস্তুর পৃথিবীতে, যতটা গোলা-বারুদের তার চেয়ে বেশি চিন্তার; ইতির সঙ্গে নেতির।

মানুষ এ পৃথিবীতে যুদ্ধ করেই বেঁচে আছে। এটা কে না জানে। আদি থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিনিয়ত তাকে যুদ্ধ করে বাঁচতে হয়। আগের চেয়ে এখনকার বাস্তবতায় ফারাক এটাই যে আগে প্রকৃতির সঙ্গে সরাসরি লড়াইয়ে নামতে হয়েছিল মানুষকে। ক্রমে কিছু সুবিধাপ্রাপ্ত তাদের হয়ে যুদ্ধ লড়ার মতো কিছু দুর্ভাগাকে নিয়োগ করার ক্ষমতা অর্জন করে। এই নিযুক্ত ব্যক্তি ও কর্তার সম্বন্ধটি ক্রমে বদলে এসে আজকের দুনিয়ার জাতীয়তাবাদ, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্রসহ নানা তন্ত্র ও মন্ত্রের মধ্যস্থতার পাল্লায় পড়েছে। এতে বাস্তবতা কিন্তু বদলায়নি। সিরিয়ার যার হাতে যে মরছে, তাদের মধ্যে নেই কোনো পারস্পরিক বৈরিতা। একই অবস্থা ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে সত্য। যুদ্ধক্ষেত্রের উদাহরণ দিতে হয়, কারণ অপমৃত্যু ও এর কারণের মধ্যকার এ সম্বন্ধহীনতা বোঝার জন্য এটিই সবচেয়ে ভালো জায়গা। সহজে মগজে ঢোকে।

এ প্রসঙ্গে ইতালীয় গল্পকার ইতালো কালভিনোর একটি গল্পের কথা মনে পড়ছে। গল্পের নায়ক একজন অপমানিত ও ক্ষুব্ধ ব্যক্তি, নাম লিগি। সে ক্ষুব্ধ আলবার্তো নামের এক ব্যক্তির ওপর, যে তাকে অপমান করেছে, যার নিবাস পাশের দেশে। সেই দেশের সঙ্গে লিগির দেশের যুদ্ধ বাধে। লিগিও যেতে চায় সে যুদ্ধে। উদ্দেশ্য আলবার্তোকে হত্যা করা। শুনে লিগির দেশ তাকে সৈনিকের প্রশিক্ষণ দেয়, আর বলে দেয় ব্যক্তিগত শত্রুতাবশত কাউকে হত্যা করাটা যুদ্ধের উদ্দেশ্য নয়। নানা বাগ্‌বিতণ্ডার পর লিগি শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে যেতে রাজি হয়। শত্রু দেশে গিয়ে আলবার্তোর খোঁজে থাকা লিগি বিধ্বংসী যুদ্ধে মেতে ওঠে। প্রচুর শত্রুসেনা নিহত হয় তার হাতে। কিন্তু আলবার্তোকে পায় না সে। যত দিনে পায়, তত দিনে শান্তির ধবধবে সাদা পতাকা দেখিয়ে যুদ্ধের মীমাংসা হয়ে গেছে। এবারে আলবার্তোকে খুঁজতে এবং অহেতুক হত্যা করা লোকেদের পরিবারের কাছে ক্ষমা চাইতে সেই দেশে যায় লিগি। একদিন আলবার্তোকে খুঁজে পায় সে। যথারীতি হত্যাও করে। কিন্তু এবার আর আগের মতো তার কোনো পুরস্কার মেলে না। বরং ফাঁসিতে ঝুলতে হয় তাকে।

কালভিনো সাংবাদিক ছিলেন। বিচিত্র ও নিষ্ঠুর সব তথ্যের পৃথিবীতে বিচরণ ছিল তাঁর। তাই তিনি বিশ্বসমাজ ও রাজনীতির বিকট চিত্রটি সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তিনি জানতেন, আজকের মানুষ যে নীতি-আদর্শের কথা বলে আসছে, তার ভেতরটা একেবারে ফাঁকা; টোকা দিলেই বিকট শব্দে ঠনঠন করে উঠবে। মানবাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে যত মানুষ নিহত ও নিঃস্ব হয়েছে ও হচ্ছে, উন্নয়নের চোরাবালিতে নাম-পরিচয়সর্বস্ব নিয়ে যতজন তলিয়ে গেছে ও যাচ্ছে, শুধু তাদের হিসাব নিলেই এ সত্য ধরা দেবে তার সমস্ত প্রকরণ নিয়ে। আর বিশ্বপ্রকৃতির হিসাব নিতে গেলে, প্রতিবছর মানবসৃষ্ট কারণে বিলুপ্ত হওয়া প্রজাতির খোঁজ নিতে গেলে, জীবন মুখ লুকাবে লহমার বিরতিতে।

প্রতিদিন মৃত্যু হচ্ছে। জীবনের নিয়মে মৃত্যু আসে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু কিছু মৃত্যু আমাদের হৃদয়কে মুহূর্তের জন্য রক্তশূন্য করে দেয়। কিছু মৃত্যু আমাদের চোখের সামনে তির্যক হাসি দিয়ে ঝুলতে থাকে। কিছু মৃত্যু আছে, যা প্রখর কিছু চোখের জন্ম দেয়, বিষাদের তির থেকে যে চোখ আমাদের কাছে নিয়ে আসে প্রশ্নবাণ। আমরা সে চোখের দিকে তাকাতে পারি না। আমরা ভুলে থাকতে চাই সে চোখ। আকিফার মৃত্যু রিনা খাতুনকে এমনই দুটি চোখ দিয়েছে। আকিফার বাবা হারুন অর রশিদের সজল চোখ এখন আমাদের আশ্বস্ত করে তুলছে। আমরা মুখ ঘুরিয়ে অন্য কোনো দৃশ্য দেখতে চাই।

হারুন অর রশিদ বলেছেন, ভিডিওটা যোগাযোগমন্ত্রী দেখবেন কি না। তাঁর এ প্রশ্ন কিংবা আহ্বানে যন্ত্রণার প্রতিধ্বনি শোনা যায়। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে এক স্তব্ধতা গ্রাস করতে চায় সবাইকে। কিন্তু শেষতক আর তা হয় না। স্তব্ধতার এত শক্তি কই যে গ্রাস করবে? তাই অভিজ্ঞ চোখেরা ফের নির্বাচন কমিশনের দিকে, অঢেল উন্নয়ন ও তৎসংশ্লিষ্ট অমৃতবচনের দিকে, মসনদের সুখবঞ্চিতদের অভিযোগের দিকে ঘুরে যায়। অভ্যস্ত চোখ জরিপ করতে শুরু করে বাঁটোয়ারার। ভোট-প্রকৌশল ও সে অভিমুখী যাত্রার অনিশ্চয়তা ঘুমোতে দেয় না। আমরা সেসব হিসাব সামনে নিয়ে ব্যস্ত করে তুলেছি নিজেকে এবং অন্যদের। কারণ, আমরা জানি আকিফার মতো শিশুদের মৃত্যু কতটা যন্ত্রণার।

ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধের বাস্তবতায় মৃত্যুকে অনেক আগেই মেনে নিয়েছে মানুষ। নিহত লোকজনকে মহিমান্বিত করতে শহীদের মতো নানা অভিধাও তৈরি করেছে। কিন্তু নিতান্ত বেখেয়ালের দুর্ঘটনায়, পলকের ক্রোধের বলি হতে হয় যখন কাউকে, তখন তার স্বজনদের কী বলা যেতে পারে? তার চোখের শূন্য কিন্তু তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে দাঁড়ানো যায় কী করে? তাই কেউ কিছু বলছে না, বলতে গিয়ে গিলে ফেলছে, দাঁড়াতে গিয়ে ফের ছুটছে। অবিরত। এক খবর থেকে আরেক খবরে গঙ্গাফড়িংয়ের মতো লাফিয়ে যাচ্ছে সবাই। দুঃসংবাদের পাহাড় বুকে পুষে ঠোঁটে টানছে স্মিত হাসি। কিন্তু হাসছে না কেউ। এক অতল বিষাদ চেপে বসে আছে। আমরা নড়তে ভুলে যাচ্ছি; আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠছি। ভুলে যাচ্ছি জীবিত থাকা ও বেঁচে থাকার পার্থক্য। আমরা মুখ তুলছি না আর। অথচ মাথা তুললেই এখনো আকাশ। সেদিকে চোখ রেখে আমরাও জেগে উঠতে পারি, পারি বেঁচে উঠতে। এই বেঁচে ওঠার ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছুই।