হাওর বার্তা ডেস্কঃ মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান ও ক্রসফায়ারে শিকড় নড়েনি মাদক গডফাদারদের। বরং আগের মতোই দেদারছে চলছে মাদক ব্যবসা। রাজধানীর অলিগলিসহ সারা দেশের মাদক বিক্রির স্পটগুলোতে বিক্রেতা ও সেবনকারীদের আনাগোনা বেড়েছে। মাদকের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স ঘোষণার পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আটঘাট বেঁধে লেগেছিল মাদক নির্মূলে। দেশব্যাপী মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হয়। ছোট-বড় অনেক মাদক ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার করে ক্রসফায়ারে নিহত হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেয়া তথ্যমতে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযানে এখন পর্যন্ত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ২৩৩ জন। ৩৩ হাজার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে ৪৮ হাজার মাদক ব্যবসায়ী ও সেবনকারী।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের অভিযানে ৪২ হাজার ৮০৫ জন মাদক ব্যবসায়ী ও সেবনকারী গ্রেপ্তার হয়েছে। মামলা হয়েছে ৩৩ হাজারের উপরে। র্যাব সদর দপ্তরের তথ্যমতে, ৪ঠা মে থেকে বিশেষ অভিযানে সারা দেশে র্যাব ৩ হাজার ৩১৭টি অভিযান পরিচালনা করেছে। অভিযানকালে ৬৫ মাদক ব্যবসায়ী ও সেবী ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছে ৪ হাজার ৫৪৬ জন। অভিযানে ১৩৮ কোটি টাকার ১৩ লাখ টাকার বিভিন্ন ধরনের মাদক জব্দ করা হয়েছে। এ সময় র্যাব’র ভ্রাম্যমাণ আদালত ৭ হাজার ৮৭২ জনকে গ্রেপ্তার করেন। অভিযান চলাকালে সারা দেশে মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকদ্রব্যের আনাগোনা বেশ কমে যায়। আগে যেভাবে পাড়া-মহল্লায় হাত বাড়ালে মাদকদ্রব্য পাওয়া যেত সেটা অনেকটাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এছাড়া চিহ্নিত মাদক বিক্রির স্পটেও তেমন মাদক ব্যবসায়ীকে দেখা যায়নি। গা-ঢাকা দিয়েছিল দেশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীরা। কিন্তু অভিযানে স্থবিরতা আসার পর থেকেই ফের চাঙ্গা হচ্ছে মাদক ব্যবসা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অভিযান চলাকালে চিহ্নিত অনেক মাদক গডফাদাররা গা-ঢাকা দিয়েছিল। যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের অনেকেই চুনোপুঁটি। ইদানীং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা কিছুটা কমে যাওয়ায় তারা আবার ব্যবসার হাল ধরছেন। নিয়ে আসছেন ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্যের চালান। যোগাযোগ বাড়াচ্ছেন তাদের ক্রেতা ও ছোটখাটো মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। নিয়মিত অভিযানে এখনও অনেক মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকদ্রব্যে আটক হচ্ছে। তবে এখনও অনেক বড় বড় মাদক ব্যবসায়ী দেশের বাইরে পলাতক আছে। ডিএনসি কর্মকর্তারা জানান, মাদক বিরোধী বিশেষ অভিযানে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রায় ৮ শতাধিক মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা দেয়া হয়েছিল। যেখানে দেশের শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের নাম ছিল। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও পুলিশের বিশেষ অভিযানে এই ৮ শতাধিক মাদক ব্যবসায়ীর মধ্য থেকে ২২ জনকে ক্রসফায়ারে দেয়া হয়েছে। আরো অনেককে গ্রেপ্তার করে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। এরমধ্যে বড় মাপের কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গোয়েন্দা শাখার অতিরিক্ত পরিচালক নজরুল ইসলাম শিকদার সাংবাদিককে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স ঘোষণার পর বিশেষ অভিযানে মাদকের ছড়াছড়ি অনেক কমে গিয়েছিল। অভিযানে মাদকের গডফাদারা গা-ঢাকা দেয়াতে তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। এদের অনেকেই এখনও পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আর গডফাদারদের ধরতে না পারলে মাদক নির্মূল করা যাবে না। তিনি বলেন, ডিএনসি’র নিয়মিত অভিযানে দেশের বিভিন্ন স্থানে এখনও ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্য আটক হচ্ছে। তবে বছরের শুরুতে যেরকম মাদকের ছড়াছড়ি ছিল তা অনেকটা কমে গেছে। চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীরা কৌশল পাল্টে নতুন লোক দিয়ে ব্যবসা করছে। এছাড়া মোবাইল বিক্রেতার মাধ্যমে পরিচিত ব্যক্তিদের কাছে কৌশলে পাঠিয়ে দিচ্ছে ইয়াবা।
খোঁজ নিয়ে ও সরজমিন রাজধানীর, কাওরানবাজার রেললাইন বস্তি, মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প, খিলগাঁও, গেণ্ডারিয়া, জুরাইন, চানখাঁরপুল, যাত্রবাড়ীসহ আরো কিছু এলাকায় গিয়ে দেখা যায় এসব স্পটে এখনো প্রায় আগের মতোই ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক কেনাবেচা হচ্ছে। তবে আগের চেয়ে কৌশল কিছুটা পাল্টানো হয়েছে। পূর্ব পরিচিত ও পরিচিতদের সুপারিশে বিক্রি করা হয় মাদক। অপরিচিত ব্যক্তিদের কাছে মাদক বিক্রির ক্ষেত্রে বেশকিছু সতর্কতা মানা হয়। পরিচয় গোপন করে একাধিক মাদক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অভিযান চলাকালে ব্যবসা হয়নি। পুলিশি ঝামেলা এড়াতে আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে। ঢাকার বাইরে থেকে কোনো চালান আনা সম্ভব হয়নি। এমনকি যাদের কাছ থেকে নিয়মিত চালান আসতো তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। কোরবানি ঈদের কিছুদিন আগে থেকে আবার যোগাযোগ বাড়ছে। ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে ইয়াবার চালান আসছে। তবে বিক্রির ক্ষেত্রে অনেক সাবধানতা মানা হচ্ছে। কখনও হোম ডেলিভারি, আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কাজ করা হচ্ছে। তবে এসব ক্ষেত্রে নতুন ও অপরিচিতদের দিয়ে কাজ করানো হয়।
দেশের কোথাও না কোথাও প্রায় প্রতিদিনই ছোট বড় অনেক ইয়াবার চালান আটক করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ডিএনসি গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে সারা দেশে তাদের ইয়াবা চালান আসা-যাওয়ার ১১ শতাধিক রোড ও স্পট রয়েছে। আগে নিয়মিত এসব রোড ও স্পট দিয়ে ইয়াবার চালান আসতো। কিন্তু মাদক বিরোধী অভিযানের পরেও ওই একই স্থান দিয়ে চালান আসছে। তবে একটু কৌশল পাল্টে নির্দিষ্ট স্পটের আশপাশ দিয়ে এখন চালান আনা হয়। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব চালান পৌঁছে যাচ্ছে গন্তব্যে। পুলিশ ও র্যাব’র বিশেষ নজরদারি থাকাতে এসব অনেক চালান আটক হচ্ছে। সোমবার রাজধানীর মতিঝিল দিলকুশা এলাকায় একটি কুরিয়ার সার্ভিসে ৪টি পার্র্শ্বেল থেকে ৪০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে র্যাব-১০ সদস্যরা। চট্টগ্রামের লোহাগড়া থেকে আসা ফেস ক্রিমের ৪০ কৌটায় বিশেষ কায়দায় এসব ইয়াবা লুকানো ছিল। ১৬ই আগস্ট কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলা থেকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ১০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে উপজেলার খানকারডেইল এলাকায় অভিযান চালিয়ে এসব ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এর আগে একই উপজেলা থেকে ৩ লাখ ৪০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। যার আনুমানিক বাজার দর ১০ কোটি টাকা।
সূত্র বলছে, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা এখন ইয়াবা ব্যবসায় পুরোপুরি সক্রিয় হচ্ছেন। অনেক রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বড় বড় ইয়াবার চালান নিয়ে আসছেন। তবে তাদের ব্যবহার করছেন দেশের ব্যবসায়ীরা। মাদকবিরোধী অভিযানে রোহিঙ্গাদের ওপর কোনো প্রভাব পড়েনি। গত এক বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে প্রায় ৩ লাখের উপরে ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। ৭৯টি মাদক মামলায় ১১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায় রয়েছে বড় মাপের ১৩ রোহিঙ্গার নাম। এছাড়া শতাধিক স্পটে মাদকের কেনাবেচা হয়। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে প্রায়ই রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে ইয়াবা আটক করা হয়েছে। গত ২০শে আগস্ট র্যাব-৭ লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে ৫০ লাখ টাকা মূল্যের ১০ হাজার পিস ইয়াবাসহ দু’জনকে আটক করেছে।
র্যাব’র আইন ও গণমাধ্যম বিভাগের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান সাংবাদিককে বলেন, মাদকবিরোধী অভিযান এখনও চলছে। তবে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করায় আগের চেয়ে এখন অনেকটা মাদক ও মাদক ব্যবসায়ীদের দৌড়-ঝাঁপ কমেছে। পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। আগে যেখানে হাত বাড়ালেই ইয়াবা পাওয়া যেত এখন সেটা হচ্ছে না। তিনি বলেন, তবে ২০/২৫ বছর ধরে মাদকের যে বিস্তার সেটা কয়েক মাসে বন্ধ করা সম্ভব না। আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে। আমরা তালিকাভুক্ত হাজার হাজার মাদক ব্যবসায়ী আটক করেছি। লাভজনক ব্যবসা হওয়ায় এখন অনেকেই নতুন করে ব্যবসা করতে চাইবে। সে বিষয়ে আমাদের নজরদারি আছে। মাদক বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আমরা অভিযান চালিয়ে যাব।