ঢাকা ০৩:৩৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাওরে সমস্যার পাহাড়

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৪:৩৪:২৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ১২ অগাস্ট ২০১৮
  • ৪৫২ বার
হাওর বার্তা ডেস্কঃ কার্যকর উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহন ও বাস্তবায়নের অভাবে নেত্রকোনার অপার সম্ভবনাময় হাওর জনপদ খালিয়াজুরী আজো রয়েছে পশ্চাত্পদ। আধুনিক সভ্যতার অনেক অনুষঙ্গ এখনো পাড়ি দিতে পারেনি এখানকার সেই দুর্গম পথ।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, যোগাযোগ তথা জীবন-জীবিকার প্রতিটি স্তর আবহমানকাল ধরে উপেক্ষিত। লক্ষাধিক জনগোষ্ঠি অধ্যুষিত খালিয়াজুরীর হাওরপাড়ের অর্থনৈতিক অবস্থা রয়েছে মুখ থুবড়ে। এখানে বিকল্প কোনো কর্মসংস্থান না থাকায় এ অঞ্চলের মানুষ শুধুমাত্র কৃষি কাজ আর মাছ ধরার উপর নির্ভরশীল। অথচ, এ দুটি ক্ষেত্রই এখানে ধংস হতে চলছে। অন্যান্য উপজেলায় চাষাবাদে কৃষকরা ক্রমশ এগিয়ে গেলেও এখানে কৃষকরা বাধ্য হচ্ছেন কৃষি থেকে সরে দাঁড়াতে। একমাত্র বোরো ফসল উত্পাদন উপযোগী এ হাওরে অকাল বন্যার তাণ্ডব, জলাবদ্ধতা তৈরী, সেচ সংকট ও ধান রোপন আর কাটা-মাড়াইয়ে উন্নত প্রযুক্তির অভাবই কৃষকরা কৃষি কাজে পিছু হটছেন।
খালিয়াজুরী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম জানান, সর্বশেষ ২০১৭ সালে উপজেলায় ২১ হাজার হেক্টরেরও বেশি জমিতে বোরো আবাদ হয়েছিল। কিন্তু তখন ধান কাটার আগ মুহূর্তে আগাম বন্যায় তলিয়ে নিয়েছে সমস্ত ফসল। এ ফসল ঘরে উঠলে পাওয়া যেতো প্রায় সোয়া ৩শ কোটি টাকা মূল্যের প্রায় ৮০ হাজার মেট্রিক টন ধান। বিগত  ১৬ বছরে (২০০১-২০১৭ সাল পর্যন্ত) এ হাওরদ্বীপে অকাল বন্যায় ফসল মার গেছে নয়বার।
এলকাবাসীর অভিযোগ, বন্যার কবল থেকে ফসল রক্ষা বাঁধ তৈরীর জন্য সরকার প্রতি বছরই বরাদ্দ দিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এসব টাকার সিংহ ভাগই কাজ না করে লুটপাট করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারি আর জনপ্রতিনিধিরা।
ফসলের মাঠে আর যেন অকাল বন্যায় হানা না দেয় উঠে সে জন্য অভিজ্ঞ মহল বলছেন, এ অঞ্চলের নদ-নদী, খাল-বিল খননের মাধ্যমে বাড়াতে হবে পানি ধারন ক্ষমতা এবং সেনা বাহিনী দিয়ে টেকসই প্রযুক্তিতে নির্মাণ করতে হবে ফসল রক্ষা বাঁধ। এ খনন আর বাঁধ নির্মাণ হলে উপজেলায় প্রতি বছর ১৬ হাজার মেট্রিক টন ধানের খাদ্য চাহিদা পূরন হয়েও উদ্ধৃত্ত হবে ৬৪ হাজার মেট্রিক টন ধান। এখানকার এমন সম্ভবনাময় কৃষি ক্ষেত্রটি যুগের পর যুগ অবহেলায় পেরিয়ে গেলেও এতে নেয়া হচ্ছে না দীর্ঘ মেয়াদি কোন পরিকল্পনা ও কার্যকরি পদক্ষেপ।
অভিজ্ঞ মহল আরো বলছেন, সঠিক পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ নেই এ জনপদের আরেক সম্ভবনাময় মত্স্য সম্পদকে নিয়েও। মত্স্য বিভাগের তথ্য সূত্রে প্রকাশ, এ উপজেলায় বড় (২০ একরের উপরে) জলমহাল ৩৭ টি, ছোট জলমহাল (২০ একরের নীচে) ৩৬ টি। সরকারি ভাবে ইজারা দেয়া এসব জলমহাল থেকে ইজারাদাররা প্রতি বছর মাছ ধরে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার মেট্রিক টন। এর বাজার মূল্য প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা। জলমাহাল নীতিমালায় রয়েছে প্রতিটি জলমহালের ২৫ ভাগ স্থানে ইজারাদারদের উদ্যোগে অধিক হারে বাঁশ ও ডালপালা দিয়ে তৈরী করতে হবে মত্স্য অভয়ারন্য। এ অভয়ারণ্যের মাধ্যমে হবে মাছের বংশ রক্ষা ও বৃদ্ধি।
অভিযোগ আছে, ইজারাদাররা এখানকার কোনো জলমহালেই অভয়ারণ্য তৈরী না করে পুরো জলমহালের সব মাছ ধরে নেয়। এখানে বাস্তবায়ন নেই জাল যার জলা তার নীতিরও। সরকারি নিয়মে জলমহাল ভোগ দখল করার কথা প্রকৃত মত্স্যজীবিদের। কিন্তু তাদের অর্থনৈতিক দৈন্যতার সুযোগে এসব ভোগ করছেন অমত্স্যজীবী আর্থিক ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা। এখানকার ইজারাদাররা বর্ষা মৌসুমে তাদের জলমহালে সীমানা খুঁটি না দিয়ে সীমানার বাইরে হাওরের বিস্তর ভাসান পানিকে দখল করে রাখে ক্ষমতার দাপটে। ভাসান পানিতে জেলেদের মাছ ধরার অধিকার থাকলেও তা থেকে জেলেরা বছরের পর বছর ধরে হচ্ছে বঞ্চিত। জেলেদের দাবি, সরকারি-বেসরকারি বৃহত্ ঋণ সুবিধা আর জলমহালের সীমানা খুঁটি নির্মাণের মাধ্যমে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেয়া হোক।
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এ হাওরপাড়ে অধিকাংশ মানুষ খেটে খাওয়া ভ্থমিহীন। এখানে শিক্ষা ব্যাবস্থার দৈন্য দশা। পরিসংখ্যান বিভাগ সূত্র জানায়, উপজেলায় শিক্ষার হার মাত্র ৩০.৫ শতাংশ।
সরেজমিনে জানা গেছে, এখানে স্বাস্থ্য ব্যাবস্থা খুবই নাজুক। উপজেলায় একটি সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থাকলেও পাওয়া যায় না নুন্যতম চিকিৎসা সুবিধা। হাসপাতালটিতে নয় জন ডাক্তারের পদ আছে কিন্তু অনেক সময় হাসপাতালটি থাকে ডাক্তার শূন্য। এখানে কালেভদ্রেও হয় না কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা। পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের নিয়মিত কার্যক্রম না থাকায় এখানকার বেশির ভাগ পরিবারের সন্তান সংখ্যা ৪ থেকে ৫ জন।
হাওর গবেষকরা জানান,  এসব সমস্যা সমূহের সমাধান করাসহ খালিয়াজুরী সদর থেকে বোয়ালি কিংবা লেপসিয়া বাজার হয়ে মোহনগঞ্জের সঙ্গেঁ প্রায় ১০ কি. মি. উঁচু সড়ক কিংবা ফ্লাইওভার স্থাপন করলে উপজেলার অর্থনৈতিক দ্বার খুলবে।
তাছাড়া, বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের মাধ্যমে ৫০ কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মাণের অপেক্ষায় থাকা এখানকার পর্যটন কেন্দ্রটি স্থাপিত হলেও  এলাকাটি উন্নয়নে নতুন মোড় নেবে।
Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

হাওরে সমস্যার পাহাড়

আপডেট টাইম : ০৪:৩৪:২৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ১২ অগাস্ট ২০১৮
হাওর বার্তা ডেস্কঃ কার্যকর উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহন ও বাস্তবায়নের অভাবে নেত্রকোনার অপার সম্ভবনাময় হাওর জনপদ খালিয়াজুরী আজো রয়েছে পশ্চাত্পদ। আধুনিক সভ্যতার অনেক অনুষঙ্গ এখনো পাড়ি দিতে পারেনি এখানকার সেই দুর্গম পথ।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, যোগাযোগ তথা জীবন-জীবিকার প্রতিটি স্তর আবহমানকাল ধরে উপেক্ষিত। লক্ষাধিক জনগোষ্ঠি অধ্যুষিত খালিয়াজুরীর হাওরপাড়ের অর্থনৈতিক অবস্থা রয়েছে মুখ থুবড়ে। এখানে বিকল্প কোনো কর্মসংস্থান না থাকায় এ অঞ্চলের মানুষ শুধুমাত্র কৃষি কাজ আর মাছ ধরার উপর নির্ভরশীল। অথচ, এ দুটি ক্ষেত্রই এখানে ধংস হতে চলছে। অন্যান্য উপজেলায় চাষাবাদে কৃষকরা ক্রমশ এগিয়ে গেলেও এখানে কৃষকরা বাধ্য হচ্ছেন কৃষি থেকে সরে দাঁড়াতে। একমাত্র বোরো ফসল উত্পাদন উপযোগী এ হাওরে অকাল বন্যার তাণ্ডব, জলাবদ্ধতা তৈরী, সেচ সংকট ও ধান রোপন আর কাটা-মাড়াইয়ে উন্নত প্রযুক্তির অভাবই কৃষকরা কৃষি কাজে পিছু হটছেন।
খালিয়াজুরী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম জানান, সর্বশেষ ২০১৭ সালে উপজেলায় ২১ হাজার হেক্টরেরও বেশি জমিতে বোরো আবাদ হয়েছিল। কিন্তু তখন ধান কাটার আগ মুহূর্তে আগাম বন্যায় তলিয়ে নিয়েছে সমস্ত ফসল। এ ফসল ঘরে উঠলে পাওয়া যেতো প্রায় সোয়া ৩শ কোটি টাকা মূল্যের প্রায় ৮০ হাজার মেট্রিক টন ধান। বিগত  ১৬ বছরে (২০০১-২০১৭ সাল পর্যন্ত) এ হাওরদ্বীপে অকাল বন্যায় ফসল মার গেছে নয়বার।
এলকাবাসীর অভিযোগ, বন্যার কবল থেকে ফসল রক্ষা বাঁধ তৈরীর জন্য সরকার প্রতি বছরই বরাদ্দ দিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এসব টাকার সিংহ ভাগই কাজ না করে লুটপাট করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারি আর জনপ্রতিনিধিরা।
ফসলের মাঠে আর যেন অকাল বন্যায় হানা না দেয় উঠে সে জন্য অভিজ্ঞ মহল বলছেন, এ অঞ্চলের নদ-নদী, খাল-বিল খননের মাধ্যমে বাড়াতে হবে পানি ধারন ক্ষমতা এবং সেনা বাহিনী দিয়ে টেকসই প্রযুক্তিতে নির্মাণ করতে হবে ফসল রক্ষা বাঁধ। এ খনন আর বাঁধ নির্মাণ হলে উপজেলায় প্রতি বছর ১৬ হাজার মেট্রিক টন ধানের খাদ্য চাহিদা পূরন হয়েও উদ্ধৃত্ত হবে ৬৪ হাজার মেট্রিক টন ধান। এখানকার এমন সম্ভবনাময় কৃষি ক্ষেত্রটি যুগের পর যুগ অবহেলায় পেরিয়ে গেলেও এতে নেয়া হচ্ছে না দীর্ঘ মেয়াদি কোন পরিকল্পনা ও কার্যকরি পদক্ষেপ।
অভিজ্ঞ মহল আরো বলছেন, সঠিক পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ নেই এ জনপদের আরেক সম্ভবনাময় মত্স্য সম্পদকে নিয়েও। মত্স্য বিভাগের তথ্য সূত্রে প্রকাশ, এ উপজেলায় বড় (২০ একরের উপরে) জলমহাল ৩৭ টি, ছোট জলমহাল (২০ একরের নীচে) ৩৬ টি। সরকারি ভাবে ইজারা দেয়া এসব জলমহাল থেকে ইজারাদাররা প্রতি বছর মাছ ধরে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার মেট্রিক টন। এর বাজার মূল্য প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা। জলমাহাল নীতিমালায় রয়েছে প্রতিটি জলমহালের ২৫ ভাগ স্থানে ইজারাদারদের উদ্যোগে অধিক হারে বাঁশ ও ডালপালা দিয়ে তৈরী করতে হবে মত্স্য অভয়ারন্য। এ অভয়ারণ্যের মাধ্যমে হবে মাছের বংশ রক্ষা ও বৃদ্ধি।
অভিযোগ আছে, ইজারাদাররা এখানকার কোনো জলমহালেই অভয়ারণ্য তৈরী না করে পুরো জলমহালের সব মাছ ধরে নেয়। এখানে বাস্তবায়ন নেই জাল যার জলা তার নীতিরও। সরকারি নিয়মে জলমহাল ভোগ দখল করার কথা প্রকৃত মত্স্যজীবিদের। কিন্তু তাদের অর্থনৈতিক দৈন্যতার সুযোগে এসব ভোগ করছেন অমত্স্যজীবী আর্থিক ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা। এখানকার ইজারাদাররা বর্ষা মৌসুমে তাদের জলমহালে সীমানা খুঁটি না দিয়ে সীমানার বাইরে হাওরের বিস্তর ভাসান পানিকে দখল করে রাখে ক্ষমতার দাপটে। ভাসান পানিতে জেলেদের মাছ ধরার অধিকার থাকলেও তা থেকে জেলেরা বছরের পর বছর ধরে হচ্ছে বঞ্চিত। জেলেদের দাবি, সরকারি-বেসরকারি বৃহত্ ঋণ সুবিধা আর জলমহালের সীমানা খুঁটি নির্মাণের মাধ্যমে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেয়া হোক।
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এ হাওরপাড়ে অধিকাংশ মানুষ খেটে খাওয়া ভ্থমিহীন। এখানে শিক্ষা ব্যাবস্থার দৈন্য দশা। পরিসংখ্যান বিভাগ সূত্র জানায়, উপজেলায় শিক্ষার হার মাত্র ৩০.৫ শতাংশ।
সরেজমিনে জানা গেছে, এখানে স্বাস্থ্য ব্যাবস্থা খুবই নাজুক। উপজেলায় একটি সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থাকলেও পাওয়া যায় না নুন্যতম চিকিৎসা সুবিধা। হাসপাতালটিতে নয় জন ডাক্তারের পদ আছে কিন্তু অনেক সময় হাসপাতালটি থাকে ডাক্তার শূন্য। এখানে কালেভদ্রেও হয় না কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা। পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের নিয়মিত কার্যক্রম না থাকায় এখানকার বেশির ভাগ পরিবারের সন্তান সংখ্যা ৪ থেকে ৫ জন।
হাওর গবেষকরা জানান,  এসব সমস্যা সমূহের সমাধান করাসহ খালিয়াজুরী সদর থেকে বোয়ালি কিংবা লেপসিয়া বাজার হয়ে মোহনগঞ্জের সঙ্গেঁ প্রায় ১০ কি. মি. উঁচু সড়ক কিংবা ফ্লাইওভার স্থাপন করলে উপজেলার অর্থনৈতিক দ্বার খুলবে।
তাছাড়া, বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের মাধ্যমে ৫০ কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মাণের অপেক্ষায় থাকা এখানকার পর্যটন কেন্দ্রটি স্থাপিত হলেও  এলাকাটি উন্নয়নে নতুন মোড় নেবে।