হাওর বার্তা ডেস্কঃ ঝড়-ঝঞ্জাট, অকাল বন্যা, পাহাড়ি ঢল আর প্রাকৃতিক দুর্যোগেও থামে না যে জনপদের পথ চলা। এই জনপদ হচ্ছে হাওর জনপদ। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও দমেনি হাওর জনপদের বাসিন্দা। বছরের পর বছর অকাল বন্যা, পাহাড়ি ঢল আর প্রাকৃতিক দুর্যোগে যাদের বছরের খোরাকি নিয়ে যায়। তবুও তারা আশায় বুক বাঁধে আগামীর জন্য। এই আশা-নিরাশার দোলাচলে সুনামগঞ্জের হাওর জনপদের মানুষের জীবন। এ জনপদের একমাত্র ভরসা বোরো ফসল। গত দু’বছর আকাল বন্যা আর শিলাবৃষ্টিতে ফসল হারানোর পরও এ জনপদের মানুষ ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে ফসল ফলিয়েছে এবার। এবারও গোলায় তুলতে পারেনি শতভাগ।
সরেজমিনে হাওর জনপদ ঘুরে মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
জেলার শাল্লা উপজেলার ছায়ার হাওরপাড়ের বাসিন্দা সালাউদ্দিন সাংবাদিককে জানান, গত দু’বছর অকাল বন্যা ও শিলাবৃষ্টিতে কোনো কৃষক বোরো ফসল গোলায় তুলতে পারেননি। ঋণ করে দুটি বছর পরিবার-পরিজন নিয়ে কোনোরকম জীবনযাপন করছেন। এ বছর ফসল ভালো হয়েছে। কিন্তু দু’বছরের পুঞ্জিভূত ঋণ পরিশোধ করতেই এখন হিমশিম খাচ্ছেন।
একই উপজেলার শরীফপুর গ্রামের বাসিন্দা আজমান আলী জানান, এবার ফসল ভালো হয়েছে। গত দু’বছরের ঋণ শোধ করে গোলা খালি হয়ে যাচ্ছে। কোনরকম খেয়ে পরে বাঁচতে পারলেও আগামীতে কিভাবে ফসল ফলাবেন এই নিয়ে চিন্তায় আছেন। কোথায় পাবেন হাল-চাষের জন্য টাকা। এ দুঃচিন্তায় দিন কাটছে তার।
একই উপজেলার আটগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মামুন আল কাওছার সাংবাদিককে জানান, এবার হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ ভালো হয়েছে। এটাই মূল কথা নয়। প্রকৃতিও অনুকূলে ছিল। ফলে এবার বোরো ধানের ভালো ফলন হয়েছে। তবুও যেন কৃষকের গোলায় ধান নেই। এর কারণ গত দু’বছরের ধারদেনা পরিশোধ করে এখন তারা নিঃস্বপ্রায়।
হাওরবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একমাত্র বোরো ফসল গোলায় তোলার পর এ অঞ্চলের মানুষের কোনো কাজ থাকে না। তাদের এক বিরাট অংশ বেকার হয়ে পড়ে। এসময়টায় কেউ কেউ মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু ইজারাদারের লাঠিয়াল বাহিনীর কারণে হাওরের ভাসান পানিতে মাছ ধরতে পারে না প্রান্তিক মানুষ।
জেলার তাহিরপুর উপজেলার ছিলানীতাহিরপুর আব্দুল ওয়াহাব সাংবাদিককে জানান, এবার তিনি ৯ কেদার বোরো জমি চাষাবাদ করেছিলেন। যা পেয়েছেন তা গত দু’বছরের ধারদেনা পরিশোধ করে শেষ হয়ে গেছে। ফলে আগামী বছরও ধারদেনা করে ফসল করতে হবে। কারণ বোরো ফসল ছাড়া তার আর কোনো কর্মসংস্থান নেই।
এদিকে নাগরিক সংহতির মহাসচিব শরীফুজ্জামান শরীফ সম্প্রতি টাংগুয়ার হাওর, মাটিয়ান হাওরসহ বেশ কয়েকটি হাওর এলাকা ঘুরে এসেছেন। তিনি জানান, সেখানকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে এটাই বুঝতে পেরেছেন এলাকার জন্য বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন।
পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা সাংবাদিককে জানান, ভৌগলিক অবস্থানের কারণে সুনামগঞ্জের হাওর জনপদের মানুষ একটি মাত্র বোরো ফসলের উপর নির্ভরশীল। এ ফসল গোলায় তোলার পর এ জনপদের ৮০ ভাগ কর্মক্ষম মানুষ বেকার হয়ে পড়ে। হাওর জনপদকে ঘিরে কৃষি ও মৎস্য ভিত্তিক শিল্পকারখানা গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি।
হাওর বাঁচাও, সুনামগঞ্জ বাঁচাও কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান সাংবাদিককে জানান, সুনামগঞ্জের হাওর জনপদের মানুষের প্রধান সম্বল হচ্ছে বোরো ফসল। অকাল বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে এ জনপদের মানুষের অর্থনৈতিক মানদণ্ড ভেঙে গেছে। দিন দিন এ এলাকার মানুষ সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়ছে। এর ফলে বেকারত্বের সংখ্যা বাড়ছে। এ জনপদের মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলতে হলে হাওর এলাকায় বিকল্প কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলাম সাংবাদিককে জানান, সুনামগঞ্জের নদ, খাল ও জলাদার খননে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় একটি খসড়া পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এছাড়াও হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ কাম রাস্তা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
তিনি জানান, হাওরের উৎপাদিত ধান মারাইয়ের জন্য হাওর সাইলো করার পরিল্পনাও নেওয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসক আরো জানান, জলমহাল ইজারাদারদের জলমহালের সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এরপরও যদি কোন ইজারাদার জলমহালের সীমানার বাইরে হাওরে প্রান্তিক মানুষদের মাছ ধরতে না দেয়। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।