হাওর বার্তা ডেস্কঃ কিশোরগঞ্জে প্রতিদিন নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে মধ্য আষাঢ়ে অবিরাম বৃষ্টি আর উজানের ঢলে। জেলার হাওরাঞ্চলে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ নদী ভাঙন। আর পানি বাড়ার সাথে ক্রমেই বাড়ছে নদী ভাঙনের তীব্রতা। প্রতিনিয়ত বিলীন হচ্ছে ফসলী জমি, বসতভিটা ও গাছপালা। এতে ভাঙন আতংকে দিন কাটাচ্ছেন নদী পাড়ের মানুষরা।
এক ফসলের উপর নির্ভরশীল হাওরবাসীকে প্রতিবছরই কোন না কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে বাঁচতে হয়। তার উপর নিজের বসতবাড়ি হারানো যেন ‘মরার উপর খরার ঘা’।
গত ১ সপ্তাহে নিকলী উপজেলার ছাতিরচরসহ জেলার কয়েকটি এলাকায় নতুন করে ভাঙনের শিকার হয়েছে শতাধিক পরিবার। ভাঙনের হুমকিতে এসব এলাকার হাজার হাজার মানুষ। ভাঙনের শিকার মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছে। অবিরাম ভাঙনের মুখে ঘরবাড়ি সরাতে হিমশিম খাচ্ছে ভাঙন কবলিত মানুষজন।
শুধু ছাতিরচর নয়, বাজিতপুরের দিঘীরপাড় ইউনিয়নের আছানপুরসহ পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে ঘোড়াউত্রা নদীর উত্তাল স্রোতে প্রকট আকারে ভাঙন কবলিত হয়ে কয়েকদিনে ভিটাহীন হয়ে পড়েছে অনেক পরিবার। এ বছর বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই ঘোড়াউত্রা পাড়ে নদীভাঙন শুরু হয়। আর নদীর পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে ক্রমেই বাড়ছে নদী ভাঙনের তীব্রতা। প্রতিনিয়ত বিলীন হচ্ছে ফসলী জমি, বসতভিটা। আর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিরবতায় এলাকাবাসী আতংঙ্কের মধ্যে রয়েছেন নিজেদের পৈত্রিক বসতঘর-বাড়ি, স্কুল, মসজিদ, সড়ক রক্ষা করার উপায় নির্ধারণে। ফলে সর্বত্র বিরাজ করছে অশান্তি-অস্বস্তি।
এছাড়াও নিকলীর সিংপুর ও গোড়াদিঘা, পাকুন্দিয়ার চরফরাদী ইউনিয়নে দক্ষিণ চরটেকী, ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামের অসংখ্য ঘর-বাড়ি ভাঙনের শিকার হয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় ভাঙনের ভয়ালরুপ। নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে আগের চেয়ে উত্তাল নদী। আতঙ্কে ঘরবাড়ি ছেড়ে খোলা আকাশের নিচে বসতি করছে প্রায় অনেক পরিবার। অনেকেই আবার নদী তীরবর্তী বসতিগুলো ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সরিয়ে নিচ্ছে অন্যত্র। ভাঙনরোধে অবিলম্বে ব্যবস্থা না নেয়া হলে নদী তীরবর্তী লোকালয়ের বিস্তীর্ণ এলাকা ও ফসলী জমি। নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার আশংকা করছেন স্থানীয়রা।
এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, গত ১০ বছরে হাওরে ভয়াবহ ভাঙনে মেঘনা, ঘোড়াউত্রা, কালনী, ধনুও হাটুরিয়া নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে ৫০টিরও বেশি গ্রাম। আর এতে আশ্রয়হীন হয়েছে অন্তত ৬০ হাজার মানুষ। ভাঙন রোধে সরকারের কার্যকর কোন পরিকল্পনা নেই। প্রতিবছর শুকনো মৌসুমে ভাঙন কবলিত এলাকায় স্বল্প পরিসরে বন্যা প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণ করা হলেও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে না হাওর জনপদ। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ভাঙনরোধে প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণ করে কিছু এলাকা রক্ষার চেষ্টা করছে। কিন্তু নদী শাসন, নদী খনন না করায় কোন অবস্থাতেই ভাঙন ঠেকানো যাচ্ছেনা।
ছাতিরচর গ্রামের বাসিন্দা মো. আবু কাশেম জানান, এক সময় ছাতিরচর গ্রামে ১৫-১৬ হাজার পরিবারের বসবাস ছিল। হাওরের ভাঙনে ঘর-বাড়ি হারিয়ে বর্তমানে হাজার হাজার মানুষ ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে। বর্তমানে সাড়ে ৪ হাজারের মতো পরিবার টিকে আছে।
তার অভিযোগ, প্রতিটি নির্বাচনের আগে প্রার্থীরা নদী ভাঙনে পদক্ষেপ নেয়ার আশ্বাস দিয়ে তাদের কাছ থেকে ভোট নেন। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পরে আর কেউ তাদের খবর নিতে আসেন না। সরকার যায় আসে, কিন্তু ছাতিরচরবাসীর ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয় না।
এ ব্যাপারে ছাতিরচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন বলেন, ১৯৬৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ছাতিরচরের ভয়াবহ নদী ভাঙনে কোন প্রতিকার হচ্ছে না। এরই মধ্যে গ্রামের তিন-চতুর্থাংশ বিলীন হয়ে গেছে ঘোড়াউত্রা নদীগর্ভে। অন্তত এক হাজার পরিবার এই নদী ভাঙনে হয়েছে সর্বসান্ত। গ্রামের সবচেয়ে প্রাচীন পূর্বপাড়া জামে মসজিদটি নদী ভাঙনের মধ্যে পড়েছে। ইতোমধ্যে গ্রামে পশ্চিমপাড়া জামে মসজিদটি নদী গর্ভে হারিয়ে গেছে। পশ্চিম পাড়া নামে বিশাল পাড়াটিও সম্পূর্ণ নদী গর্ভে চলে গেছে। ভাঙনের আতঙ্কে এখন নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন এলাকাবাসী। আমি প্রতিবার উপজেলা সমন্বয় পরিষদের মিটিংয়ে নদী ভাঙন নিয়ে কথা বললেও এখন পর্যন্ত বড় ধরনের কোন বাজেট আসেনি।
আবদুল আজিজ বলেন, জরুরি ভিত্তিতে ভাঙন প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে আমাদের পুরো এলাকাই নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। তাছাড়া নদীর ওই ভাঙন বড়ার সাথে সাথে ‘ঘোড়াউত্রা’র গতিপথও পাল্টে যেতে পারে।
বাজিতপুরের দিঘীরপাড় ইউনিয়নের আছানপুর গ্রামের সিদ্দিক মিয়াসহ ভুক্তভোগিরা জানান, প্রতিবছর আছানপুরসহ পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে নদীর উত্তাল স্রোতে ভাঙন কবলিত হয়ে কয়েক’শ মানুষ ভিটাহীন হয়। নদীর ভাঙন কেড়ে নিয়েছে আমাদের সব কিছু, মাটির টুকরো নদীতে পড়ার দৃশ্যটি দেখলে গা শিউরে উঠে। কর্তৃপক্ষ কোন পদক্ষেপ না নেয়ায় চলতি বছর ভাঙনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। জরুরী ভিত্তিতে ভাঙনরোধে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানান তারা।
জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ও উপ-সচিব তরফদার মো. আক্তার জামীল মুক্তিযোদ্ধার কণ্ঠ’কে জানান, এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেয়া হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা পেলে আবাসন ও খাদ্য সহায়তা দেয়া হবে।