হাওর বার্তা ডেস্কঃ মাদকের তালিকায় এবার যুক্ত হচ্ছে সিসা। নতুন আইনে সিসাকে মাদক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এই আইন পুরোপুরি কার্যকর শুরু হলে দেশে বৈধভাবে সিসার বার থাকার কোনো সুযোগ থাকবে না। খোদ রাজধানীতেই অর্ধশতাধিক সিসাবার রয়েছে। যেখানে সাধারণত উচ্চবিত্তদের ছেলেমেয়েরা যাওয়া-আসা করে। আগে এটি মাদক হিসেবে গণ্য না হওয়ায় বারগুলোতে অভিযান চালাতে গেলেই বিপাকে পড়তে হয়েছিল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। এদিকে, বিশ্বের অনেক দেশে সিসা মাদক হিসেবে গণ্য নয়, ফলে আমাদের দেশে তা মাদকের তালিকাভুক্ত হওয়ায় কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছে।
এমন প্রেক্ষাপটে আজ মঙ্গলবার বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে মাদকবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস। গত এক বছর দেশের মাদক সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দেশে ইয়াবার ব্যবহার ও জব্দ হওয়ার ঘটনা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তৈরি করা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালের তুলনায় গত বছর দেশে ইয়াবার ব্যবহার বেড়েছে ৩৬.০৯ শতাংশ। সারাদেশে জব্দ মোট ইয়াবার ২২.৭২ শতাংশ ঢাকায়, ৪৫.৪৫ শতাংশ চট্টগ্রামে, ৩.৭৭ শতাংশ রাজশাহীতে, ১.৮১ শতাংশ খুলনায়, ০.৮৬ শতাংশ বরিশালে ও ২৫.১৭ শতাংশ সিলেটে। সেখানে বলা হয়, চট্টগ্রাম অঞ্চলের মধ্যে সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজার ইয়াবার প্রধান রুট। আর মিয়ানমার থেকে কক্সবাজার হয়ে ইয়াবা দেশে ঢুকছে। এখনও অর্ধশত রুট ব্যবহার করে দেশে ঢুকছে মাদকদ্রব্য। মোট জব্দ ইয়াবার ৪৫ শতাংশের বেশি পাওয়া গেছে চট্টগ্রাম অঞ্চলে। ২০১৭ সালে সব বাহিনী মিলে দেশে ইয়াবা উদ্ধার করেছে চার কোটি ৭৯ হাজার ৪৪৩টি। ২০১৬ সালে এ সংখ্যা ছিল দুই কোটি ৯৪ লাখ ৫০ হাজার ১৫৮টি।
এ ব্যাপারে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দীন আহমেদ সাংবাদিককে বলেন, সিসার প্রধান উপাদান পেট্রা হাইড্রো ক্যানাবিনল। এটা মূলত গাঁজার নির্যাস থেকে তৈরি হয়। তাই নতুন আইনে সিসাকে তফসিলভুক্ত মাদক হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এ আইন পাস হলে দেশে কোনো সিসাবার থাকবে না।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ২০১৭ সালের প্রতিবেদনে উঠে আসে- দেশে জব্দ মোট ফেনসিডিলের ৩৯ শতাংশ রাজশাহী থেকে উদ্ধার করা হয়। ১৮ শতাংশ চট্টগ্রাম, ২৩ শতাংশ খুলনা, ৫ শতাংশ সিলেট ও ১ শতাংশ বরিশাল থেকে জব্দ করা হয়েছে। এ ছাড়া কৌতূহলবশত মাদকের সঙ্গে জড়াচ্ছেন ২৪.১৫ শতাংশ মাদকসেবী ও বন্ধুদের মাধ্যমে হাতেখড়ি ৭৪. ৯২ শতাংশ।
সিসাবারের সঙ্গে যুক্ত একাধিক ব্যবসায়ী জানান, আপেল, আঙুর, আনারস, কলা, পেঁপে থেকে শুরু করে নানা ফলের নির্যাস দিয়ে তৈরি করা হয় সিসার উপাদান। এসব উপাদান শুকনো আকারে থাকে। তবে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোনো কোম্পানি সিসার উপাদান তৈরি করেনি। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সিসার উপাদান বিদেশ থেকে আমদানি করে আসছে। সিসার উপাদান হিসেবে বিভিন্ন ফলের শুকনো নির্যাস বিশেষ কলকে ভরা হয়। স্টিলের তৈরি কারুকার্জিত এসব কলকে দেখতে অনেকটা হুক্কার মতো। তবে এর সাইজ অনেক বড় ও একাধিক ছিদ্রযুক্ত। হুক্কার একটি ছিদ্র থাকলেও সিসার কলকেতে কমপক্ষে দুটি ছিদ্র থাকে। এসব ছিদ্রে লম্বা পাইপ থাকে। যে পাইপ মুখে পুরে গ্রহণ করা হয় সিসার ধোঁয়া। কলকের নিচের অংশে (হুক্কার যেখানে পানি থাকে) বিশেষ তরল থাকে আর উপরিভাগে থাকে কলকে। এ কলকেতেই সিসার উপাদান দেওয়া হয়। মোঘল আমল থেকেই সিসার প্রচলন চলে আসছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে দুবাইয়ে এর প্রচলন সবচেয়ে বেশি। গুলশান ও বনানীর মতো অভিজাত এলাকায় সিসাবারে গেলে দেখা যায় তরুণ-তরুণীর ভিড়। অভিযোগ আছে, সিসার আড়ালে চলছে মাদকের ব্যবসাও।
৪৬ রুট ধরে এখনও আসছে মাদক : সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর অন্তত ৪৬টি রুট ধরে দেশের ভেতরে আসছে ইয়াবা-ফেনসিডিলসহ অন্যান্য মাদকের চালান। এরপর বেশিরভাগ চালান ঢাকা হয়ে বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। দেশব্যাপী চলমান বিশেষ অভিযানের মধ্যেও এসব রুট ধরে আসছে মাদক। দেশে মাদকের বিস্তার ঠেকাতে এসব রুট ধরে মাদক পাচার বন্ধ করা জরুরি বলে মনে করেন সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা।
মাদকের যত রুট : চট্টগ্রামের মিরসরাই ও ফটিকছড়ি উপজেলার ভূজপুর থানার সঙ্গে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ১১ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। উঁচু পাহাড় ও বন-জঙ্গলঘেরা এই সীমান্ত দিয়ে দেশে আসে ফেনসিডিলসহ অন্যান্য মাদকের চালান। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, ফেনী, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি দিয়েও মাদক আসে।
এ ছাড়া পঞ্চগড়, নওগাঁ, সাতক্ষীরা, যশোর, বেনাপোল বন্দর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহের সীমান্ত এলাকা দিয়ে আসে মাদকের চালান। সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জের সীমান্ত দিয়ে মাদক প্রবেশ করছে।
কর্মসূচি : মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস পালনে প্রতি বছরের মতো আজ নানা কর্মসূচি নিয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে-‘আগে শুনুন : শিশু ও যুবাদের প্রতি মনোযোগ দেওয়াই তাদের নিরাপদে বেড়ে ওঠার প্রথম পদক্ষেপ।’ এর মধ্যে রয়েছে আজ সকাল ৯টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মাদকবিরোধী মানববন্ধন এবং সকাল সাড়ে ১০টায় ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণ। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। এ ছাড়া সারাদেশেও কর্মসূচি পালন করা হবে।