হাওর বার্তা ডেস্কঃ মৌলভীবাজার ও সিলেটের বিশাল হাকালুকি হাওর। এ হাওরে রয়েছে হিজল, তমাল ও করচসহ ৫২৬ প্রজাতির গাছ। এ হাওর ঘিরে জমেছে প্রকৃতির মেলা। আছে প্রাণবৈচিত্র্য। তবে ইটভাটার ধোঁয়ায় মরে সাফ হচ্ছে এখানকার জীববৈচিত্র্য। বিষটোপ দিয়ে মারা হচ্ছে পাখি আর মাছ। দেদারসে কেটে নেওয়া হচ্ছে হাওর বনের বড় বড় গাছ। এসব কারণে ধ্বংস হচ্ছে এ জলাভূমির প্রাকৃতিক ভারসাম্য।
১৯৯৯ সালে মিঠাপানির এ হাওরের মৌলভীবাজার ও সিলেটের পাঁচটি উপজেলায় ১১ ইউনিয়নের ৪০ হাজার হেক্টর জমি প্রতিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে (ইসিএ) ঘোষণা করে সরকার। এ কারণে ইসিএ এলাকায় পরিবেশদূষণ করে এমন কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা নিষিদ্ধ। এ ঘোষণার পরও হাকালুকি হাওরের চতুর্পাশে গড়ে উঠেছে এক ডজনেরও বেশি ইটভাটা। কেটে নেওয়া হচ্ছে হাওরাঞ্চলের বনের গাছপালা। আর এসব অবৈধ ইটভাটা অবাধে পুড়ছে কাঠ। এতে হুমকির মুখে রয়েছে হাকালুকি হাওরের জলজ জীববৈচিত্র্য ও বনাঞ্চল।
স্থানীয়রা বলেছেন, বিভিন্নভাবে হাকালুকি হাওর ধ্বংস করা হচ্ছে। হাওরের বনের বড় গাছগুলো কেটে নিয়ে জ্বালানিসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু বনবিভাগের কোনো লোক এগুলো দেখাশোনা করেন না। বনের গাছপালা বর্ষায় হাওরের ঢেউ ঠেকায়। যার ফলে তীরবর্তী বাড়িঘর-রাস্তাঘাট রক্ষা পায়।
স্থানীয়রা জানান, হাকালুকি হাওর ইসিএ ঘোষণার আগেই এসব ইটভাটা গড়ে উঠেছে। ২০০২ সাল থেকে হাকালুকি হাওর উন্নয়নে পরিবেশ অধিদফতর কাজ শুরু করে। আর ইটভাটা শুরু করার আগে প্রথমে স্থানীয় পর্যায়ে কৃষি অফিস এবং পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র নিতে হয়। তাহলে ইটভাটাগুলো কীভাবে গড়ে উঠল। ইটভাটাগুলোর ছাড়পত্র প্রদানের ক্ষেত্রে কৃষি অফিস ও পরিবেশ অধিদফতরের অনৈতিকতার অভিযোগ তুলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কুলাউড়া, জুড়ী, বড়লেখা
ও ফেঞ্চুগঞ্জের বিভিন্ন অবৈধ ইটভাটায় বন ও পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করে ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। এতে উজাড় হচ্ছে বনাঞ্চল। সনাতন পদ্ধতির ইটভাটাকে জিগজাগ পদ্ধতিতে রূপান্তর করতে সরকার প্রায় ৫ বছর আগে আইন ও নির্দেশনা প্রদান করলেও এর তোয়াক্কা করছেন না অধিকাংশ ইটভাটার মালিক। বিশেষ করে ইসিএ এলাকাভুক্ত ইটভাটাগুলো প্রায় সাত বছর আগে পরিবেশ অধিদফতর বন্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু তা ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে।
সরেজমিন জানা যায়, হাকালুকির ইসিএ এলাকায় কুলাউড়া উপজেলায় শাপলা ব্রিকস নামের একটি ইটভাটা রয়েছে। জুড়ী উপজেলায় ‘এমকো নামে দুটি এবং মেসার্স বাবু ব্রিকস নামে ইটভাটা রয়েছে। এমকো নামের ইটভাটা দুটির মালিক স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান। বড়লেখা উপজেলায় দক্ষিণ ভাগের রাঙাউটি এলাকায় ভাই ভাই ব্রিকস, সুজানগরের ভোলারকান্দি গ্রামে এনবি, গাঙকুল ব্রিকস, সুজানগরে তেরাকুড়ি এলাকার নিম্নাঞ্চলে এবিএস নামের ইটভাটা রয়েছে। হাকালুকির পশ্চিম তীর ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় রয়েছে দুটি ইটভাটা। এর একটির মালিক উপজেলা যুবলীগের সহসভাপতি আবদুল মছব্বির। অন্য ভাটাটির মালিক মছব্বিরের বন্ধু হুমায়ূন কবীর।
এ ছাড়া গোলাপগঞ্জ উপজেলায়ও দুটি ইটভাটা রয়েছে। ইসিএ আওতাভুক্ত এলাকায় সনাতন পদ্ধতির এসব ব্রিকস ফিল্ড প্রায় সাত বছর আগে পরিবেশ অধিদফতর বন্ধ ঘোষণা করে। প্রশাসনের নাকের ডগায় অবৈধ ব্রিকস ফিল্ডে অবাধে কাঠ পুড়িয়ে ইট তৈরি করা হচ্ছে।
স্থানীয় আশরাফ, সাইফুল, ইমদাদসহ অনেকের অভিযোগ, কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে রাতের আঁধারে কাঠ এনে স্তূপ করে রাখা হয়। পরে প্রকাশ্যে দিনের আলোয় এসব কাঠ পোড়ানো হয়। এমনকি স্থানীয় প্রশাসন ও বনবিভাগকে ম্যানেজ করেই অবৈধ এ ইটভাটাগুলোয় কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। অনেক ইটভাটার মালিক ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি। তাই কেউ এ বিষয়ে মুখ খুলতে চান না।
মেসার্স শাপলা ব্রিকসের ম্যানেজার বকুল ধর ইট তৈরিতে কাঠ পোড়ানোর অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, শ্রমিকের রান্নার জন্য কিছু কাঠ রয়েছে। আগামী বছর ইটভাটাটি জিগজাগ পদ্ধতিতে রূপান্তরিত করা হবে। জুড়ী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা অসীম চন্দ্র বণিক বলেন, ‘এখনো কোনো ইটভাটায় আমরা অভিযান করিনি।’
মৌলভীবাজার পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি সৈয়দ মহসীন পারভেজ বলেন, ‘হাকালুকি হাওর এখন হুমকির মুখে। আমরা উচ্চপর্যায়ে এ হাওরের জন্য কাজ করেও কোনো সুফল পাচ্ছি না। আমরা চাই সরকার এদিকে সুনজর দিয়ে হাওরটিকে রক্ষা করবে।’ সাধারণ সম্পাদক নুরুল মোহাইমিন মিল্টন জানান, ইট তৈরির জন্য কাঠের ব্যাপক ব্যবহারের কারণে এলাকার পরিবেশ হুমকির মুখে। মৌলভীবাজার পরিবেশ আন্দোলনের সভাপতি ডা. এ কে জিল্লুল হক বলেন, ‘ইটভাটাগুলো আধুনিকায়নের জন্য আমরা ওপর মহলে অনেক আবেদন করেছি। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে উদাসীন।’ হাকালুকি যুব পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হোসাইন আহমদ বলেন, ‘ইসিএ এলাকায় এসব ইটভাটা সম্পন্ন নিষিদ্ধ। আমরা চাই সরকার ইটভাটাগুলো বন্ধ করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করবে।’
এ ছাড়াও হাকালুকি হাওরে প্রতিদিন বিষটোপ দিয়ে দেশীয় ও অতিথি পাখি, মাছ নিধন করছে দুষ্টচক্র। এ ব্যাপারে কড়া ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে হাকালুকি হাওরের জীববৈচিত্র্যের অস্তিত্ব বিলীন হতে পারে বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা।
সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু মুছা শামসুল মোহিত চৌধুরী বলেন, ‘হাকালুকি হাওর এলাকায় ইটভাটায় কাঠ পোড়ানোর বিষয়ে আমি খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেব। দুজন বনরক্ষী দিয়ে এই বিশাল হাওরের গাছ কর্তনও বন্ধ করা যাচ্ছে না। এই হাওরের প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করতে হলে এলাকার সবার আন্তরিক চেষ্টা দরকার।’