হাওর বার্তা ডেস্কঃ কয়েকদিন আগেও সোনালি ধানের গোছা দোল খাচ্ছিল বাতাসে, সেই সঙ্গে আনন্দে দুলে উঠেছিল কৃষকের মন। গতবারের তুলনায় এবার দেশে বোরোর ফলন হয়েছে ভালো। কিন্তু গত কয়েক দিনের লাগাতার কালবৈশাখী ঝড়, শিলাবৃষ্টি ও কোথাও কোথাও ভারী বৃষ্টিতে নষ্ট হয়েছে অনেক এলাকার পাকা ধান। কৃষি শ্রমিক না পাওয়ায় আগাম সতর্কতার পরও সময়মতো তারা ধান ঘরে তুলতে পারেননি। ফলে ম্লান হয়েছে অনেক কৃষকের মুখ। আর যারা ঝড়বৃষ্টির আগে ঘরে ধান তুলতে পেরেছেন তাদের এখন ভাবনা উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য তারা পাবেন কি?
কৃষকরা বলছেন, শুরু থেকে আবহাওয়া অনুকূলেই ছিল। আশানুরূপ শীষ বেরিয়েছিল গাছ থেকে। তারপরই একের পর এক সমস্যায় দিশেহারা হয়ে ওঠেন তারা। প্রথম দিকে ধানের শীষ বেরুনোর পর ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ, তারপর কয়েক দফার কালবৈশাখী ঝড়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে কৃষকের। পরবর্তী সময়ে সেই অবস্থা কিছুটা কাটিয়ে ওঠার পরও সংকট থেমে থাকেনি। শ্রমিক সংকটে ধানকাটার খরচ দ্বিগুণ হওয়ার পরও হাতে ন্যায্য দাম আসছে না। এভাবে একের পর এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন কৃষকরা।
ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ
এবার দেশের বিভিন্ন স্থানে উঠতি বোরো ধানে ক্ষতিকারক ব্লাস্ট রোগের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। এ রোগে আক্রান্ত ক্ষেতের ধানের শীষ শুকিয়ে চিটে হয়ে গেছে। ব্রি-২৮ ধানেই ব্লাস্টের আক্রমণ হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এ রোগ সংক্রমণের ফলে প্রথমে ধান গাছের শীষ ভেঙে ২-৩ দিনের মধ্যেই ধান সম্পূর্ণ শুকিয়ে চিটা হয়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গে শুকিয়ে যায় ধান গাছের পাতা।
বিশেষ করে ময়মনসিংহ, ঝিনাইদহ জেলার কৃষকদের মাথায় হাত। এ দুই জেলা থেকে ব্লাস্ট সংক্রমণের খবর এসেছে সবচেয়ে বেশি।ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়ীয়া উপজেলার ভালুকজান গ্রামের কৃষক সিদ্দিক খলিফা জানান, তাদের ব্রি-২৮ ধানে ব্লাস্ট রোগের আক্রমণের ফলে শত শত একর জমির ধান মরে গেছে। একই গ্রামের বর্গাচাষি মকবুল হোসেন জানান, ঋণ করে ৯ কাঠা জমিতে ব্রি-২৮ ধান আবাদ করেছিলাম। ব্লাস্ট রোগের আক্রমণের ফলে সম্পূর্ণ ক্ষেত মরে গেছে। এখন এই মরা ধান কেটে গো-খাদ্যরূপে ব্যবহার করছি।
চলতি মৌসুমে ঝিনাইদহ জেলায় বোরো ধানের আবাদ হয়েছে ৯৩ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে। বেলপাড়া গ্রামের নিখিল কুমার জানান, তার ১৫ কাঠা ব্রি-৬৩ জাতের ধান শীষ বের হওয়ার পর ব্লাস্ট রোগের আক্রমণে প্রায় ৭৫% নষ্ট হয়ে গেছে। মল্লিকপুর গ্রামের প্রান্তিক চাষি মুক্তার হোসেন ১৬ কাঠা জমির ব্রি-২৮ জাতের ধানের শীষ বের হওয়ার পর শীষগুলো পচে শুকিয়ে চিটে হয়ে গেছে। বলরামপুর গ্রামের কৃষক জাহিদ হোসেন ৬ বিঘা জমিতে নতুন জাতের ব্রি ৬৩ ধান চাষ করেছিলেন। তার অভিযোগ, কৃষি কর্মকর্তারা সময়মতো ছত্রাকনাশক ব্যবহারের পরামর্শ দিলে কৃষকদের এমন ক্ষতি হতো না।
কালবৈশাখী ও শিলাবৃষ্টির কবলে ধান
দেশের বিভিন্ন স্থানে কালবৈশাখী ঝড়ে ব্যাপক ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে পেকে যাওয়া ধান। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার মির্জাপুর গ্রামের কৃষক ইছাহাক সর্দার এ বছর ১০ বিঘা জমিতে বোরো চাষ করেছিলেন। ধানের শীষে সোনালি রঙ ধরেছিল। এমন সময় কালবৈশাখীর তোড়ে শুয়ে পড়েছে সব ধানগাছ। সঙ্গে ভারী বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় ধানক্ষেত। একই এলাকার সাহাবুদ্দিন, আফিল উদ্দীন, ইসমাইল সর্দার, সোহরাব হোসেন, দাউদ আলী, মোছেল উদ্দীন, আনসার ঢালীসহ অধিকাংশ কৃষকের ধান ক্ষেতের একটিও আর দাঁড়িয়ে নেই।
বগুড়ার সারিয়াকান্দিতেও ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাহাদুজ্জামান জানান, শিলাবৃষ্টিতে উপজেলায় ৩০১ হেক্টর জমির বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে ৮ হাজার ৬১৫ জন কৃষকের ৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া নওগাঁয় জেলা সদর, মান্দা, বদলগাছি, পত্নীতলা, ধামইরহাট উপজেলার ওপর দিয়ে গত কয়েক দিনের কয়েক দফা কালবৈশাখী ঝড়ে এসব এলাকার বেশিরভাগ জমির আধাপাকা ধান মাটিতে শুয়ে পড়েছে। অসময়ের বৃষ্টির পানি জমা হয়ে কোথাও কোথাও ধানের শীষ পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে গেছে। একদিকে শিলাবৃষ্টির ফলে উঠতি ধানের বেশিরভাগই ঝরে পড়েছে, তার ওপর পানিতে তলিয়েও ধান নষ্ট হয়েছে। রাণীনগর উপজেলার রক্তদহ বিলের প্রায় ৫০ হেক্টর জমির ধান পানিতে তলিয়ে গেছে।
শ্রমিক সংকট
কৃষি শ্রমিকের সংকট এখন দেশের প্রায় সর্বত্রই আলোচনার বিষয়। অনেক অঞ্চলে কৃষি শ্রমিকের সংকটের কারণে পাকা ধান কাটা যাচ্ছে না। কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন উপজেলার আব্দুল্লাহপুর বাজুকা গ্রামের কৃষক মো. রবিন মিয়া জানান, বালিচাপড়া হাওরে তিনি ৮ একর জমি করেছিলেন। মাত্র এক একর জমি তিনি কেটেছেন। বাকি জমির ধান পাকলেও শ্রমিকের অভাবে কাটতে পারছেন না। অবিরাম বর্ষণে জমিতে পানি জমে থাকায় ২ মণ ধানের দামে মিলছে একজন শ্রমিক।
ইটনা উপজেলার ধনপুর গ্রামের কৃষক অমর আলী জানান, ইটনা হাওরে তিনি ১২ একর জমি করেছেন। জমির ধানও পেকে গেছে। কিন্তু শ্রমিক না পাওয়া কোনো রকমে পাঁচ একর জমির ধান কাটতে পেরেছেন। বাকি জমি যে কীভাবে কাটবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই! একই এলাকার কৃষক তোঁতার বাপ জানান, ইটনা ধনপুর হাওরে তিনি তিন একর জমিতে ধান চাষ করেছিলেন। পুরো জমির ধানই পেকে রয়েছে। কিন্তু ধানকাটা শ্রমিকের অভাবে এখন পর্যন্ত তিনি এক মুঠো ধানও কাটতে পারেননি।
কৃষকরা জানিয়েছেন, ধানকাটা শ্রমিকের সংকট হাওরে প্রকট আকার ধারণ করেছে। ফলে ধানকাটা শ্রমিকের চাহিদাও বেড়ে গেছে। দুই মণ ধানের দামেও একজন শ্রমিক মিলছে না। একরপ্রতি চার-পাঁচ হাজার টাকার বিপরীতে অনেককে ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকায়ও শ্রমিক সংগ্রহ করে ফসল কাটতে দেখা যাচ্ছে। তারপরও শ্রমিক মিলছে না। অনেক কৃষক শ্রমিক না পেয়ে হাওরের পাড়ে বসে নিজের জমির দিকে তাকিয়ে বিলাপ করতেও দেখা গেছে। ধানকাটা শ্রমিক সংকটে কাবু এখন হাওরের কৃষক। শুধু হাওরেই নয়, সারা দেশেই কমবেশি কৃষি শ্রমিকের এ সংকটের কথা শোনা যাচ্ছে।
উৎপাদনের খরচ উঠছে না
বিবিধ সংকটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শেষে যখন ধান ঘরে তুলছেন একজন কৃষক তখন সেই ধান বিক্রি করে তার খরচের টাকাও উঠছে না। বর্তমানে ১ একর জমিতে ধানের বীজ ক্রয়, বপন, রোপণ, সার-কীটনাশক, আগাছা পরিষ্কার ও কর্তন ঝাড়াই পর্যন্ত একজন কৃষকের মোট খরচ দাঁড়ায় প্রায় ৩০-৩৫ হাজার টাকা। বিক্রির সময় লাভ তো দূরের কথা উৎপাদন খরচও উঠাতে হিমশিম খাচ্ছেন চাষিরা। খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার মেছাঘোনা গ্রামের কৃষক রমজান আলী মোল্যা। তিনি বলেন, এ বছর ধানকাটা শ্রমিকের দাম অত্যন্ত চড়া। এক মণ ধান বিক্রি করে একজন শ্রমিকের দাম দিতে হচ্ছে। তাতে যে ধান হয়েছে তা বিক্রি করে খরচ বাঁচবে বলে মনে হচ্ছে না।
কৃষকদের এই দুরবস্থার মধ্যেও একটি গোষ্ঠী ঠিকই লাভবান হচ্ছে কৌশলের আশ্রয় নিয়ে। বিক্রি করার সময় কৃষক দাম পাচ্ছেন না অথচ ক্রেতাকে বাজার থেকে চাল কিনতে হচ্ছে চড়া দামে। কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে ধান মজুদকরণ, মোটা চাল মিনিকেট বানিয়ে বিক্রিসহ বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিয়ে লাভবান হচ্ছে একটি গোষ্ঠী।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কৃষক পর্যায় থেকে ন্যায্যমূল্যের চেয়ে কম দামে ধান কিনে মজুদ করা হয়। তারপর মজুদকৃত ধানের দাম বাড়িয়ে চালের বাজার থেকে অতি মুনাফা করছেন মূলত মিল মালিকরা। এ ছাড়া এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে স্থানীয় দালাল ও ফড়িয়ারাও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ের অভাবেই এমনটা হচ্ছে।