ঢাকা ১১:৩৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নগরের রিকশা চালকদের অমানবিক জীবন

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৪:২৭:০৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ এপ্রিল ২০১৮
  • ৩৬৭ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ পায়ের জোরে প্যাডেল ঠেলে মানুষ টানার হাড় ভাঙা খাটুনির পর ঢাকার রিকশাচালকরা রাতে যে পরিবেশে ঘুমান সেটা নিতান্তই অমানবিক। একাধিক গ্যারেজে গিয়ে দেখা গেছে, বিছানা ছাড়াই পাটাতনের ওপর কাঁথা, চাদর এমনটি গামছা পেতে গাদাগাদি করে শুয়ে থাকেন তারা। ঢাকার রিকশাচালকদের একটি বড় অংশই মৌসুমি।

এলাকায় চাষাবাদ বা অন্য কাজ না থাকলে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য তারা ঢাকায় আসেন। টাকা বাঁচাতে যা যা প্রয়োজন, তার সবই করতে হয় তাদের। আর এ কারণে রাতে থাকার জন্য ঘর ভাড়ার বদলে রিকশা মালিকদের গ্যারাজেই আশ্রয় নিতে হয় তাদের।

এসব গ্যারাজের প্রতিদিন ভাড়া নিয়ে চালান চালকরা। আর সেখানেই টাকার বিনিময়ে দুই বেলা খাওয়া আর বিনামূল্যে থাকার ব্যবস্থা আছে। আর সেখানে থাকার জন্য কেবল মাথার ওপর টিনের চালা আর চার পাশে আচ্ছাদনের বাইরে বলতে গেলে কোনো সুযোগ সুবিধাই থাকে না।

১৯৮৬ সালে রিক্সা-ভ্যান নিবন্ধন বন্ধ করে দেয়া হয়। বর্তমানে রাজধানীতে ৮৮ হাজার নিবন্ধিত রিকশা থাকলেও ধারণা করা হয়, এই সংখ্যাটি কয়েক লাখ। আর অন্তত সাড়ে ১৬ হাজার গ্যারাজ আছে মালিকদের হিসাব অনুযায়ী। এর প্রতিটিতেই অমানবিক পরিবেশে থাকতে বাধ্য হচ্ছে চালকরা।

পুরান ঢাকা, মাণ্ডা, মুগদা, মিরপুর, উত্তরখান-দক্ষিণখান, খিলক্ষেত, বাড্ডা, মোহাম্মদপুর, হাজারীবাগ, রামপুরা, মিরপুর, উত্তরাসহ সব এলাকাতেই এলাকাতেই রিকশার গ্যারেজ দেখা যায়। রাজধানীর গাবতলী, দ্বীপনগর, সুনিবিড় হাউজিং, ঢাকা উদ্যান, নবীনগর, সাত মসজিদ হাউজিং ও চাঁদ উদ্যান এলাকাতেই দেখা যায় শতাধিক গ্যারাজ। রয়েছে প্রায় ছয় হাজার রিক্সাচালক।

মচন্দ্রপুর পয়ঃনিষ্কাশনের খালের কোল ঘেঁষে দেখা মেলে অনেকগুলো গ্যারাজের। এখানে থাকা রিকশা চালকদের বেশিরভাগই দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে আসা।

সারা দিনের হাড় ভাঙা পরিশ্রমের পর যেখানে ফেরেন, সেখানে আদৌ শান্তি আছে কি না, সেটা দেখতে একাধিক গ্যারাজে দিয়ে দেখা যায় করুণ চিত্র।

একটি গ্যারাজে গিয়ে দেখা যায়, বাঁশের মাচার উপর ঘুমাচ্ছে চালকরা। সেখানে যে খাবার দেয়া হয়, সেটার মান একেবারেই নিম্ন। সেখানে গোসল বা পয়ঃনিষ্কাষণ ব্যবস্থাও অস্বাস্থ্যকর।

একটি গ্যারাজে গিয়ে দেখা যায়, তার উপর বাঁশের খুঁটি দিয়ে তোলা দোতলা ঘর। টিনের দেয়াল আর কাঠের পাটাতন। আর সে পাটাতনের উপর ঘুমাচ্ছেন রিকশাচালকরা। নেই কোনো বিছানা। কাঁথা, গামছা, চাদর বিছিয়ে যে যার মত ঘুমাচ্ছেন। সকাল না হতেই ভেঙে যায় সে ঘুম।

বাড়িতে টাকা পাঠাতে হবে। তাই টাকা বাঁচাতে ভালো মন্দ না খেয়ে পান্তা ভাতে কাচা মরিচ, পেয়াজ বা আলু ভর্তা মেখে সকালের নাস্তা করেন চালকরা। তারপর আবার ছুটে চলা।

সুনিবিড় হাউজিং এলাকার একটি রিক্সার গ্যারেজের মহাজন মোঃ লিটন। শারীরিক প্রতিবন্ধী তিনি। ২০১২ সালে কোমরের নিচের অংশ অকেজো হয়ে গেলে দিয়েছেন রিক্সার গ্যারেজে। রিকশাচালকদের বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘যারা আহে, তাগো সবাই কোনো না কোনা সমস্যায় আছে। কেউ বাড়িতে কিস্তি দিব, কেউ জমিজমা নিয়া মামলা খাইয়া, সম্পত্তি সব শেষ কইরা আইছে। আর তো কোনো কাজ কেউ দিব না। তাই রিকশা চালায়।’

দেয়ালে পিঠ না ঠেকলে কেউ রিকশা চালানোর মত কষ্টের কাজ করে না। মানুষ হয়ে অন্য একজন মানুষ টেনে নিয়ে যাওয়ার মত কাজ তখনই করতে হয় যখন জীবিকার আর কোনো পথ খোলা নেই- বললেন রংপুরে পীরগঞ্জ থেকে আসা আশিক। বলেন, ‘বাড়িত কিস্তি আছে। সপ্তায় ১২০০ টাকা। খাই না খাই দেওয়ন লাগে। তার উপর বউ, ছৈল-পৈলরে তো লাগেই।’

রিকশাচালকদের সঙ্গে নগরবাসীর বাগবিতণ্ডার অন্যতম কারণ ভাড়া। দিনাজপুর থেকে সাত বছর আগে ঢাকায় এসেছেন আউয়াল। তিন চাকাকে সঙ্গী করে ঢাকার রাস্তা ও মানুষের সাথে ভালই যোগাযোগ প্রায় ৫০ বছর বয়সী মানুষটির। সাংবাদিককে আউয়াল বলেন, ‘ভাড়া তো কম ছিল। তহন চাউল আসিল ২০ ট্যাকা। এখন খাওনের বিল বাড়ছে। আগে ৫০ টাকায় দুই বেলা খাইতাম। এখন ১০০ ট্যাকা লাগে। গাড়ির জমা ১০০ টাকা। আগে আছিল ৫০ টাকা/৬০ ট্যাকা। ভাড়া বাড়বো না ক্যা?’

‘ভাড়া বাড়াইয়া চাইলেই যাত্রী মারে। আমরা তো মারতে পারি না। হ্যাগো ক্ষমতা আছে হ্যারা মারে’-আক্ষেপের সঙ্গে বললেন আউয়াল।

সূত্রঃ ঢাকাটাইমস

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

নগরের রিকশা চালকদের অমানবিক জীবন

আপডেট টাইম : ০৪:২৭:০৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ এপ্রিল ২০১৮

হাওর বার্তা ডেস্কঃ পায়ের জোরে প্যাডেল ঠেলে মানুষ টানার হাড় ভাঙা খাটুনির পর ঢাকার রিকশাচালকরা রাতে যে পরিবেশে ঘুমান সেটা নিতান্তই অমানবিক। একাধিক গ্যারেজে গিয়ে দেখা গেছে, বিছানা ছাড়াই পাটাতনের ওপর কাঁথা, চাদর এমনটি গামছা পেতে গাদাগাদি করে শুয়ে থাকেন তারা। ঢাকার রিকশাচালকদের একটি বড় অংশই মৌসুমি।

এলাকায় চাষাবাদ বা অন্য কাজ না থাকলে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য তারা ঢাকায় আসেন। টাকা বাঁচাতে যা যা প্রয়োজন, তার সবই করতে হয় তাদের। আর এ কারণে রাতে থাকার জন্য ঘর ভাড়ার বদলে রিকশা মালিকদের গ্যারাজেই আশ্রয় নিতে হয় তাদের।

এসব গ্যারাজের প্রতিদিন ভাড়া নিয়ে চালান চালকরা। আর সেখানেই টাকার বিনিময়ে দুই বেলা খাওয়া আর বিনামূল্যে থাকার ব্যবস্থা আছে। আর সেখানে থাকার জন্য কেবল মাথার ওপর টিনের চালা আর চার পাশে আচ্ছাদনের বাইরে বলতে গেলে কোনো সুযোগ সুবিধাই থাকে না।

১৯৮৬ সালে রিক্সা-ভ্যান নিবন্ধন বন্ধ করে দেয়া হয়। বর্তমানে রাজধানীতে ৮৮ হাজার নিবন্ধিত রিকশা থাকলেও ধারণা করা হয়, এই সংখ্যাটি কয়েক লাখ। আর অন্তত সাড়ে ১৬ হাজার গ্যারাজ আছে মালিকদের হিসাব অনুযায়ী। এর প্রতিটিতেই অমানবিক পরিবেশে থাকতে বাধ্য হচ্ছে চালকরা।

পুরান ঢাকা, মাণ্ডা, মুগদা, মিরপুর, উত্তরখান-দক্ষিণখান, খিলক্ষেত, বাড্ডা, মোহাম্মদপুর, হাজারীবাগ, রামপুরা, মিরপুর, উত্তরাসহ সব এলাকাতেই এলাকাতেই রিকশার গ্যারেজ দেখা যায়। রাজধানীর গাবতলী, দ্বীপনগর, সুনিবিড় হাউজিং, ঢাকা উদ্যান, নবীনগর, সাত মসজিদ হাউজিং ও চাঁদ উদ্যান এলাকাতেই দেখা যায় শতাধিক গ্যারাজ। রয়েছে প্রায় ছয় হাজার রিক্সাচালক।

মচন্দ্রপুর পয়ঃনিষ্কাশনের খালের কোল ঘেঁষে দেখা মেলে অনেকগুলো গ্যারাজের। এখানে থাকা রিকশা চালকদের বেশিরভাগই দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে আসা।

সারা দিনের হাড় ভাঙা পরিশ্রমের পর যেখানে ফেরেন, সেখানে আদৌ শান্তি আছে কি না, সেটা দেখতে একাধিক গ্যারাজে দিয়ে দেখা যায় করুণ চিত্র।

একটি গ্যারাজে গিয়ে দেখা যায়, বাঁশের মাচার উপর ঘুমাচ্ছে চালকরা। সেখানে যে খাবার দেয়া হয়, সেটার মান একেবারেই নিম্ন। সেখানে গোসল বা পয়ঃনিষ্কাষণ ব্যবস্থাও অস্বাস্থ্যকর।

একটি গ্যারাজে গিয়ে দেখা যায়, তার উপর বাঁশের খুঁটি দিয়ে তোলা দোতলা ঘর। টিনের দেয়াল আর কাঠের পাটাতন। আর সে পাটাতনের উপর ঘুমাচ্ছেন রিকশাচালকরা। নেই কোনো বিছানা। কাঁথা, গামছা, চাদর বিছিয়ে যে যার মত ঘুমাচ্ছেন। সকাল না হতেই ভেঙে যায় সে ঘুম।

বাড়িতে টাকা পাঠাতে হবে। তাই টাকা বাঁচাতে ভালো মন্দ না খেয়ে পান্তা ভাতে কাচা মরিচ, পেয়াজ বা আলু ভর্তা মেখে সকালের নাস্তা করেন চালকরা। তারপর আবার ছুটে চলা।

সুনিবিড় হাউজিং এলাকার একটি রিক্সার গ্যারেজের মহাজন মোঃ লিটন। শারীরিক প্রতিবন্ধী তিনি। ২০১২ সালে কোমরের নিচের অংশ অকেজো হয়ে গেলে দিয়েছেন রিক্সার গ্যারেজে। রিকশাচালকদের বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘যারা আহে, তাগো সবাই কোনো না কোনা সমস্যায় আছে। কেউ বাড়িতে কিস্তি দিব, কেউ জমিজমা নিয়া মামলা খাইয়া, সম্পত্তি সব শেষ কইরা আইছে। আর তো কোনো কাজ কেউ দিব না। তাই রিকশা চালায়।’

দেয়ালে পিঠ না ঠেকলে কেউ রিকশা চালানোর মত কষ্টের কাজ করে না। মানুষ হয়ে অন্য একজন মানুষ টেনে নিয়ে যাওয়ার মত কাজ তখনই করতে হয় যখন জীবিকার আর কোনো পথ খোলা নেই- বললেন রংপুরে পীরগঞ্জ থেকে আসা আশিক। বলেন, ‘বাড়িত কিস্তি আছে। সপ্তায় ১২০০ টাকা। খাই না খাই দেওয়ন লাগে। তার উপর বউ, ছৈল-পৈলরে তো লাগেই।’

রিকশাচালকদের সঙ্গে নগরবাসীর বাগবিতণ্ডার অন্যতম কারণ ভাড়া। দিনাজপুর থেকে সাত বছর আগে ঢাকায় এসেছেন আউয়াল। তিন চাকাকে সঙ্গী করে ঢাকার রাস্তা ও মানুষের সাথে ভালই যোগাযোগ প্রায় ৫০ বছর বয়সী মানুষটির। সাংবাদিককে আউয়াল বলেন, ‘ভাড়া তো কম ছিল। তহন চাউল আসিল ২০ ট্যাকা। এখন খাওনের বিল বাড়ছে। আগে ৫০ টাকায় দুই বেলা খাইতাম। এখন ১০০ ট্যাকা লাগে। গাড়ির জমা ১০০ টাকা। আগে আছিল ৫০ টাকা/৬০ ট্যাকা। ভাড়া বাড়বো না ক্যা?’

‘ভাড়া বাড়াইয়া চাইলেই যাত্রী মারে। আমরা তো মারতে পারি না। হ্যাগো ক্ষমতা আছে হ্যারা মারে’-আক্ষেপের সঙ্গে বললেন আউয়াল।

সূত্রঃ ঢাকাটাইমস