হাওর বার্তা ডেস্কঃ সিলেট হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে বিউটি আক্তারকে ধর্ষণ ও হত্যা মামলার প্রধান আসামি বাবুল মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। র্যাব ৯ ও পুলিশের একটি যৌথ দল সিলেটের বিয়ানিবাজার থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে। হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার বিধান ত্রিপুরা এবং সিলেটে র্যাব ৯ এর পরিচালক মনিরুজ্জামান এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
আজ শনিবার (৩১ মাচ) দুপুরে সিলেটে র্যাবের সদর দফতরে এক প্রেস কনফারেন্সে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানানো হবে। র্যাবের মিডিয়া উইং এর পরিচালক মুফতি মাহমুদ খানও এই তথ্য নিশ্চিত করেন।
ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় মূল অভিযুক্ত বাবুল মিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ আরও অনেক। রাস্তাঘাটে নারীদের উত্ত্যক্ত করা, সখ্য গড়ে প্রতারণা ও অনৈতিক কাজের অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
স্থানীয়রা জানান, ভয়ে অনেক নারীই কোনো প্রতিবাদ করার সাহস পাননি। এই সুযোগে সে একের পর এক অপরাধ ঘটিয়ে গেছে। শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার ব্রাহ্মণডোরা গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
স্থানীয়রা জানান, শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার ব্রাহ্মণডোরা গ্রামে মৃত মলাই মিয়ার ছেলে বাবুল মিয়া (৩০) বিবাহিত এবং দুই সন্তানের জনক। ২০১০ সালে তার গ্রামের তৌহিদ মিয়ার মেয়ে, সিলেটের এক প্রবাসীর স্ত্রী তাসলিমা আক্তারকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। বিয়ের পরও সে একাধিক নারীর সঙ্গে গোপন সম্পর্ক স্থাপন করেছে এবং তাদের ব্ল্যাকমেইল করে অত্যাচার চালিয়েছে। রাস্তাঘাটে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের উত্ত্যক্ত ও হয়রানি করেছে।
গত ২১ জানুয়ারি ব্রাহ্মণডোরা গ্রামের দিনমজুর সায়েদ আলীর মেয়ে বিউটি আক্তারকে বাড়ি থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায় বাবুল মিয়া ও তার সহযোগীরা। এক মাস তাকে আটকে রেখে ধর্ষণ করে। এক মাস নির্যাতনের পর বিউটিকে কৌশলে তার বাড়িতে রেখে পালিয়ে যায় বাবুল। এ ঘটনায় গত ১ মার্চ বিউটির বাবা সায়েদ আলী বাদী হয়ে বাবুল ও তার মা কলমচানের বিরুদ্ধে হবিগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে অপহরণ ও ধর্ষণ মামলা দায়ের করেন।
পরে মেয়েকে সায়েদ আলী তার নানার বাড়িতে লুকিয়ে রাখেন। এরপর বাবুল ক্ষিপ্ত হয়ে ১৬ মার্চ বিউটি আক্তারকে উপজেলার গুনিপুর গ্রামের তার নানার বাড়ি থেকে রাতের আঁধারে জোর করে তুলে নিয়ে যায়। ফের ধর্ষণের পর তাকে খুন করে লাশ হাওরে ফেলে দেয়। বিষয়টি জানাজানি হলে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়।
এদিকে, বিউটিকে হত্যা ও ধর্ষণের অভিযোগে ১৭ মার্চ তার বাবা সায়েদ আলী বাদী হয়ে বাবুল মিয়াসহ দু’জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করে শায়েস্তাগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার পর ২১ মার্চ পুলিশ বাবুলের মা কলমচান ও সন্দেহভাজন হিসেবে একই গ্রামের ইসমাইলকে আটক করে।
বিউটির বাবা সায়েদ আলী বলেন, ‘বখাটে বাবুলের কারণে শুধু আমার মেয়েই নয়, এলাকার অনেক মেয়েই লাঞ্ছনা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। আমার কিশোরী কন্যাকে জোর করে তুলে নিয়ে ধর্ষণের পর হত্যা করেছে সে। আবার উল্টো আসামিদের আত্মীয় স্বজনরা সমানে হুমকি-ধামকি দিয়ে যাচ্ছে। আমার পুরো পরিবার এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। রাস্তাঘাটে প্রায় সময়ই আমাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। আমি একজন দিনমজুর, শ্রমিক মানুষ। কিন্তু আমি চাই আমার সন্তান বিউটিকে হত্যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।’
বিউটির মা হুসনে আরা বলেন, ‘বখাটে বাবুলের অত্যাচারে আমার মেয়েটাকে লেখাপড়া বন্ধ করে ঘরে বন্দি অবস্থায় রেখেছি। কিন্তু এরপরও বাবুল কৌশলে আমার মেয়েকে অত্যাচার করেছে।’ ‘বাবুল এলাকার উঠতি বয়সের তরুণী ও কিশোরীদের রাস্তাঘাটে পেলেই বাজে ভাষায় উত্ত্যক্ত করতো। কখনও কখনও গায়ে পর্যন্ত হাত দিয়ে যৌন হয়রানি করতো। তবে এলাকায় সে প্রভাবশালী হওয়ায় কারণে নিরীহ লোকজন কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি।’
ব্রাহ্মণডোরা গ্রামের বাসিন্দা তাউছ মিয়া বলেন, ‘বাবুলের অপকর্মের কারণে গ্রামের নিরীহ নারীরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। বাবুল অনেক সময় এলাকার বিভিন্ন স্থান থেকে তরুণীদের নিয়ে এসে আড্ডার নামে অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে।’
পরিবারের সমর্থন আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তাউছ মিয়া জানান, ‘বাবুল তার আত্মীয়-স্বজনদের কথা শোনে না। এমনকি এলাকার মুরুব্বিদেরও তোয়াক্কা করেনি কোনোদিন। খারাপ হিসেবে চিহ্নিত লোকজনের সঙ্গে তার বেশ চলাফেরা। এলাকায় প্রায় সময়ই অপরিচিত লোকজনকে নিয়ে ঘুরাফেরা করতে দেখা যায় তাকে। এলাকার চোর-ডাকাতদের নিয়ে বাবুল একটি দল তৈরি করেছে।’
ব্রাহ্মণডোরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হোসাইন মো. আদিল জজ মিয়া বলেন, ‘বাবুল যে বখাটে একথা সত্য। এলাকায় তার অপকর্ম সম্পর্কে মানুষ বলাবলি করে। তবে বিউটিকে ধর্ষণ ও হত্যার আগে তার অপরাধের কথা এভাবে সামনে আসেনি। আমরা তার শাস্তি চাই। প্রশাসনকে যতটুকু সাহায্য করা দরকার আমরা করবো। বিউটির পরিবারকে আমরা সর্বোচ্চ সহযোগিতা দেওয়ার চেষ্টা করবো।’
এ ব্যাপারে শায়েস্তাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনিছুর রহমান বলেন, ‘বিউটি হত্যাকাণ্ডের দুই আসামিকে আটক করেছে পুলিশ। মূল হোতা বাবুলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এদিক, বিউটি আক্তারকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় পুলিশের গাফিলতি খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২৯মার্চ) দুপুরে হবিগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আসম শামছুর রহমান ভূইয়াকে প্রধান করে এ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন-অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শৈলেন চাকমা ও সহকারী পুলিশ সুপার রবিউল ইসলাম।
বিউটি নিখোঁজ হওয়ার পর তার পরিবারের পক্ষ থেকে কোন সাধারণ ডায়েরি বা মামলা হয়েছিল কিনা তা খতিয়ে দেখবে তদন্ত কমিটি। তার পরিবারের পক্ষ থেকে বিষয়টি পুলিশকে জানানোর পর পুলিশ কী কী কার্যকর ভূমিকা নিয়েছিল সে বিষয়টিও তদন্ত করে দেখবে এ কমিটি। পুলিশ সুপার বিধান ত্রিপুরা জানান, বিষয়টি তদন্ত করে আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটি প্রধান হবিগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আ স ম শামছুর রহমান ভূইয়া জানান, আমরা ইতোমধ্যে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছি। এ ঘটনার প্রতিটি বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খ খতিয়ে দেখা হবে। পুলিশের কোন ধরনের গাফিলতি পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও সুপারিশ করা হবে।আশা করছি তিন দিনের মধ্যেই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে সক্ষম হবো।