দীর্ঘমেয়াদি প্ল্যানে বিএনপি * এখন আর আন্দোলন হরতাল-অবরোধ নয় * বছরজুড়েই মনোযোগ থাকবে সংগঠনে * ফখরুলসহ নেতাদের মুক্তির অপেক্ষা খালেদার

এবার দীর্ঘমেয়াদি প্ল্যান নিয়ে এগোচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সর্বশেষ তিন মাসের ফলাফলশূন্য আন্দোলনে ‘দুর্বল’ দলকে নিয়ে স্বল্পমেয়াদি কোনো চিন্তা নেই তার। নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি না হলে চলতি বছর হরতাল-অবরোধের কোনো সম্ভাবনাও নেই। বছরজুড়েই সংগঠনে মনোযোগী হবেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। তবে এ মুহূর্তে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দীর্ঘদিন ধরে কারারুদ্ধ নেতা-কর্মীদের মুক্তির অপেক্ষায় খালেদা জিয়া। নেতা-কর্মীরা বেরুলেই পুরোদমে শুরু হবে দল গোছানোর কাজ। আগামী বছরের মাঝামাঝিতে ফের রাজপথে নামার চিন্তা বিএনপির পরিকল্পনায়। দলীয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্রমতে, সদ্য সমাপ্ত তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ‘ভোট ডাকাতির’ অভিযোগ আনলেও সাংগঠনিক বিপর্যয়ে থাকা দল বিএনপি কোনো কর্মসূচিতে যায়নি। এমনকি বিক্ষোভ কর্মসূচি দেওয়ার চিন্তাও করেনি দলটি। বেগম জিয়া সংশ্লিষ্টদের বলেছেন, ফলপ্রসূহীন কোনো কর্মসূচি দেওয়া যাবে না। ভবিষ্যতে কর্মসূচি দেওয়ার আগে অনেক কিছু ভেবেচিন্তে দেওয়া হবে। তবে কঠোর কোনো কর্মসূচি দেওয়ার আগে এ নিয়ে আগেভাগেই কোনো ‘হাঁকডাক’ দেওয়া হবে না বলেও জানা গেছে।এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দলকে সুসংগঠিত করাই আমাদের প্রধান কাজ। বিএনপির নেতা-কর্মীরা কারাগার থেকে বেরুলেই এ প্রক্রিয়া শুরু হবে।’আগামী দিনের পরিকল্পনা সম্পর্কে বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব মো. শাহজাহান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ মুহূর্তে দলের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হচ্ছে কারারুদ্ধ নেতা-কর্মীদের বের করে আনা। এরপর দলকে নতুনভাবে গোছানো হবে। সবার কাছে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি আদায়ের আন্দোলনে আমরা এখনো আছি। কারণ সময়ের প্রেক্ষাপটে আন্দোলনের গতি-প্রকৃতিও পরিবর্তন হয়। এ মুহূর্তে নেতা-কর্মীদের বের করে আনাও আন্দোলনের একটি অংশ বলেই আমরা মনে করি।’

জানা যায়, মির্জা ফখরুলসহ সিনিয়র নেতারা কারাগার থেকে বেরুলেই পুরোদমে দল পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হবে। এ নিয়ে দলের স্থায়ী কমিটিসহ সিনিয়র নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করবেন বেগম জিয়া। পর্যায়ক্রমে ঢাকা মহানগরসহ জেলা-উপজেলা নেতাদের সঙ্গেও মতবিনিময় করবেন তিনি। ঢাকা দিয়েই দল পুনর্গঠন শুরু করা হবে। তবে দলের সব কমিটিতেই অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতৃত্বকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। আসন্ন রমজান মাসকে ‘সাংগঠনিক মাস’ হিসেবে ঘোষণা দিতে পারে দলটি। ইফতারকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দল, কূটনৈতিক মহলসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গেও নতুন করে সেতুবন্ধ রচনার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।  জানা যায়, সাংগঠনিক পরিকল্পনার পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতার দিকেও নজর রাখবে বিএনপি। বিশেষ করে  ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আসন্ন বাংলাদেশ সফরকেও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবে বিএনপি। পাশাপাশি সিটি নির্বাচনের অনিয়মের পর প্রভাবশালী রাষ্ট্র ও সংস্থাগুলোর মন্তব্যকেও কাজে লাগাতে চায় বিএনপি। এ নিয়ে নতুন করে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদারের চেষ্টা চলছে।সূত্রমতে, সংগঠনকে পুরোদমে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নিয়েছেন বেগম জিয়া। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সব কমিটিই নতুন করে গড়তে চান তিনি। সেই সঙ্গে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে গতি বাড়াতে ‘এক নেতার এক পদ’ রাখারও চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। সর্বশেষ দলের জাতীয় কাউন্সিলে এ উদ্যোগ নিয়েও শেষ পর্যন্ত কিছু প্রভাবশালী নেতার আপত্তির কারণে হাইকমান্ড এ সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। তবে এবার বেগম জিয়া ‘এক নেতার এক পদের’ ব্যাপারে অনড় অবস্থানে বলে জানা গেছে।

সূত্রমতে, তিন সিটি নির্বাচনের পর বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতার পাশাপাশি পেশাজীবী সমাজের সঙ্গেও বৈঠক করেন বেগম জিয়া। সেখানে দলীয় নেতারা ছাড়াও পেশাজীবী প্রতিনিধিরা দল পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিতে বিএনপিপ্রধানকে অনুরোধ করেন। বিগত আন্দোলনে মাঠে সক্রিয়, ত্যাগী ও যোগ্যদের হাতে নেতৃত্ব তুলে দেওয়ার কথাও বলেন তারা। বিএনপি চেয়ারপারসনও তাদের বক্তব্যে একমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, শিগগিরই দল পুনর্গঠন করবেন। ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের কারামুক্তির অপেক্ষা করা হচ্ছে। তবে এবার ঢাকা মহানগর থেকেই এ পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হবে। পর্যায়ক্রমে দলের নির্বাহী কমিটির সভা ও জাতীয় কাউন্সিল করার কথাও জানান তিনি। এবার কাউন্সিলে মির্জা ফখরুলকে পূর্ণাঙ্গ মহাসচিব করা হবে বলেও দলীয় নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে জানা গেছে। দল পুনর্গঠনের কথা জানিয়ে সম্প্রতি এক মতবিনিময় সভায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন ‘আমাদেরকে দলের পুনর্গঠনে যেতে হবে। ইতিমধ্যে আমরা সেই প্রক্রিয়াও শুরু করেছি। যারা ত্যাগী-পরীক্ষিত, দলের বিপদের সময়ে কাজ করেছেন, তাদের কমিটিতে আনা হবে। তাদের মূল্যায়ন করা হবে।’ দল পুনর্গঠনের সময়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে কাজ করার সুযোগ দেওয়ার কথাও বলেন তিনি। জানা যায়, কেন্দ্র থেকেই এবার শুরু হবে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া। এর আগে কয়েক দফায় তৃণমূল থেকে শুদ্ধি অভিযান চালানো হয়। এ নিয়ে আপত্তিও আসে মাঠপর্যায় থেকে। তৃণমূল নেতা-কর্মীদের দাবি, ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে সরকারবিরোধী আন্দোলনে জেলা-উপজেলার নেতা-কর্মীরাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তারপরও শাস্তির খগড় এসেছে তৃণমূলে। কেন্দ্রেই শুদ্ধি অভিযান শুরু করতে বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রতি অনুরোধ জানান তারা। জানা যায়, বিষয়টি আমলে নিয়ে বেগম জিয়া সেই উদ্যোগই নিতে যাচ্ছেন। বিশেষ করে ঢাকা মহানগর বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনগুলোতে প্রথমেই শুদ্ধি অভিযান চালাবেন তিনি। এ জন্য কাজও শুরু হয়েছে।

সূত্র জানায়, সদ্য সমাপ্ত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দল সমর্থিত মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের পক্ষে পোলিং এজেন্টদের তালিকা চেয়েছেন খালেদা জিয়া। এ জন্য দলের মধ্যম সারির কয়েকজন নেতাকে দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে। এর বাইরেও আন্দোলনে থাকা মাঠের নেতাদেরও পৃথক তালিকা চাওয়া হয়েছে। ঢাকা সিটি উত্তর ও দক্ষিণে মেয়র প্রার্থীর প্রধান নির্বাচনী এজেন্টের পাশাপাশি এ নিয়ে কাজ করছেন বিএনপি ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের বেশ কয়েক নেতা। এ ছাড়া যেসব জেলা ও উপজেলায় সাংগঠনিক কার্যক্রমে স্থবিরতা রয়েছে, সেখানেও কেন্দ্রীয় সংশ্লিষ্ট নেতাদের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। জানা গেছে, ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর দলের পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলেই এক নেতার এক পদ রাখার চিন্তা ছিল বিএনপিপ্রধানের। দলের একটি অংশের বিরোধিতার কারণেই শেষ পর্যন্ত নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন তিনি। তবে কাউন্সিলের পর থেকেই খালেদা জিয়া এ ব্যাপারে নেতাদের নিরুৎসাহিত করে আসছেন। দলের গঠনতন্ত্রেও এক নেতার একাধিক পদে থাকাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। ওইসব নেতার বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে তৃণমূল থেকে অনেক অভিযোগও জমা পড়েছে।  এবারের আন্দোলন চালাতে গিয়ে বেগম জিয়ার কাছে যেসব ভুলত্রুটি ধরা পড়েছে তার মধ্যে রয়েছে- এক নেতা কয়েকটি পদ দখল করে রাখায় মাঠের অনেক ত্যাগী নেতা পদবঞ্চিত হন। আন্দোলনে তাদের মাঠে নামানোর অনুরোধও করা যায়নি। তারপরও তারাই বিগত তিন মাসের আন্দোলনে মাঠে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। বিভিন্ন মাধ্যমে বেগম জিয়ার কাছে এমনই রিপোর্ট এসেছে। তাই এবার ওইসব ত্যাগী ও দলের প্রতি আনুগত্যশীল নেতাদেরও দলের বিভিন্ন পর্যায়ে সম্পৃক্ত করার চিন্তাভাবনা করছেন বেগম জিয়া। বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, ‘একজনের একাধিক পদে থাকা উচিত নয়। প্রয়োজনে এ জন্য গঠনতন্ত্র সংশোধন করা উচিত। কারণ যারা একাধিক পদ দখল করে আছেন, তারা পদ ছাড়তে চান না। এতে দল নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। আন্দোলনেও এর প্রভাব পড়ে। যোগ্যরাও দল থেকে ছিটকে পড়েন। এ কারণেই বিএনপিসহ ছাত্রদল, যুবদল,  স্বেচ্ছাসেবক দল, মহিলা দলসহ অন্য অঙ্গ সংগঠনগুলোতে এখন নেতৃত্বের জট সৃষ্টি হয়েছে।’

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর