হাওর বার্তা ডেস্কঃ জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকা ১৬৪ বা কিশোরগঞ্জ-৩ (করিমগঞ্জ ও তাড়াইল) আসনে আওয়ামী লীগের শক্ত অবস্থান থাকলেও জোট ও মিত্র জাতীয় পার্টিকে গত দুই নির্বাচনে সেটি ছেড়ে দিতে হয়েছে তাদের। সে হিসাবে আওয়ামী লীগে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। আর বিএনপির ভরসা ছিল যে নেতার ওপর তিনি বিদেশে অবস্থান করায় হতাশায় আছে দলটি।
এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মোঃ মুজিবুল হক চুন্নু। তিনি এ আসন থেকে দুবার জাপার প্রার্থী হয়ে, আর শেষের দুবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক ও মিত্র দলের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন। তাঁকে নিয়ে আওয়ামী লীগে ‘অস্বস্তি’ ও ‘অসন্তোষ’ থাকলেও উন্নয়ন নিয়েও স্থানীয়দের মধ্যে এক ধরনের সন্তুষ্টি রয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে এলাকায় তাঁর একটা গ্রহণযোগ্য ভাবমূর্তি ও ভোটব্যাংক রয়েছে। এবারও তিনি এ আসন থেকে নির্বাচন করবেন।
অন্যদিকে বিএনপির ভরসা ছিলেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. এম ওসমান ফারুক। ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি এ আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রী হন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ খতিয়ে দেখছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। এ কারণে তিনি দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন। বিএনপির এ প্রভাবশালী নেতা যদি দেশে ফিরতে না পারেন, বিকল্প প্রার্থীর সন্ধান করবে দলটি। তবে তাঁকে ঘিরেই এ আসনটি পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন দেখছে বিএনপি।
স্থানীয় রাজনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগপ্রার্থী এম এ কুদ্দুস। ১৯৭৯ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ড. এম ওসমান গনি জয়ী হন। তিনি বিএনপির সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. এম ওসমান ফারুকের বাবা। এরপর মুজিবুল হক চুন্নু ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হয়ে বিজয়ী হন। পরের দুটি নির্বাচনে—১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের ড. মিজানুল হক। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে কয়েক দিনের জন্য সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বিএনপিপ্রার্থী মুক্তিযোদ্ধা কবির উদ্দিন আহমেদ। ২০০১ সালে জয়ী হন বিএনপির ড. এম ওসমান ফারুক। এরপর ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে জোট ও মিত্র দলের প্রার্থী হিসেবে জাপা নেতা মুজিবুল হক চুন্নু জয়ী হন।
রাজনীতিসচেতন লোকজন মনে করছে, এবারও হয়তো আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের হতাশ করে জোট বা মিত্র দলের প্রার্থী হবেন বর্তমান সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু।
তবে এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সমর্থকরা বলছে, এবার তারা আর লাঙ্গলে ভোট দেবে না, কাজও করবে না। তাদের অভিযোগ, প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু আওয়ামী লীগের ক্ষতি করছেন, বিভক্তি তৈরিতে তাঁর হাত রয়েছে।
তবে আওয়ামী লীগের আরেকটি পক্ষ মনে করছে, জোট বা মিত্রের হিসাব-নিকাশ হয় সামগ্রিক রাজনীতির স্বার্থে। চুন্নু যেহেতু জাতীয় পার্টির প্রভাবশালী নেতা, সেহেতু জোটের বা মিত্র দলের স্বার্থে এ আসনটি যদি তাদের ছেড়ে দিতে হয়ও, দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া ছাড়া নেতাকর্মীদের উপায় থাকে না।
এদিকে পর পর দুবার জাপাকে এ আসন ছেড়ে হওয়ায় আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের লম্বা তালিকা তৈরি হয়েছে। সেই কারণে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা এবার জাপাকে কোনো ছাড় না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। গত ১০ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতা এক সমাবেশে ঘোষণা দেন, তাঁরা এবার লাঙ্গল নয়, নৌকায় ভোট দিতে চান। এ জন্য দল থেকে মনোনয়ন দিতে হবে।
অন্যদিকে জাতীয় পার্টিও এককভাবে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু সভা-সমাবেশে এ কথাটিই বলছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এ আসনের সংসদ সদস্য শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মোঃ মুজিবুল হক চুন্নু সাংবাদিককে বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচন করবে এবং ৩০০ আসনে আমরা প্রার্থী দেব। এ আসনটিও বাদ যাবে না, এখানে আমি নিজেই প্রার্থী। তবে কোনো কারণে কোনো দলের সঙ্গে যদি জোট হয়, সে ক্ষেত্রেও এ আসনটি আমরা চাইব। কারণ এখানে আমার বিপুল ভোটার রয়েছে।
আওয়ামী লীগের ক্ষতি করার অভিযোগ প্রসঙ্গে চুন্নু বলেন, ‘আমি দুই দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে বিগত দিনগুলোতে কাজ করেছি। এলাকার ব্যাপক উন্নয়নকাজ করেছি। ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার ক্ষেত্রে কারো কারো মনে ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকতে পারে। কিন্তু উন্নয়নের স্বার্থে সবাইকে আমি সমান চোখে দেখেছি।
আওয়ামী লীগ : এদিকে নেতৃত্বের কোন্দলে আওয়ামী লীগ দ্বিধাবিভক্ত। ১৬ বছর আগের করা আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে চলছে দলটি। ৪৫ সদস্যের কমিটির ১২ জন এরই মধ্যে মারা গেছেন। উপজেলা ও পৌরসভা নির্বাচনে হেরেছেন দলীয় প্রার্থী। এমনকি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও দলের সাফল্য নেই।
তবে বিভক্তি থাকলেও আগামী নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পেতে এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন বেশ কয়েকজন নেতা। তাঁদের মধ্যে দুইবারের সংসদ সদস্য ড. মিজানুল হক, উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক নাসিরুল ইসলাম খান আওলাদ, জেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহসভাপতি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোঃ এরশাদ উদ্দিন, তথ্য ও প্রযুক্তি খাতের সফল ব্যবসায়ী মুক্তিযোদ্ধা শেখ কবীর আহমেদ, কলেজ শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আসাদুল হক, জেলা বিএমএ নেতা ও জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহবুব ইকবাল, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এমরান আলী ভূঁইয়া ও ইংল্যান্ড প্রবাসী ড. আনিছুর রহমান আনিছের নাম শোনা যাচ্ছে। তাঁদের মধ্যে চার-পাঁচজন রীতিমতো নির্বাচনী আমেজ ছড়িয়ে মাঠে-ময়দানে কাজ করে যাচ্ছেন।
সাবেক সংসদ সদস্য ড. মিজানুল হক আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে ঘোষণা করে বলেন, ‘এটা আওয়ামী লীগের আসন। নানা কারণে সাংগঠনিক দুরবস্থা থাকলেও নেতাকর্মীরা কিন্তু নৌকায় ভোট দিতে মুখিয়ে রয়েছে।
ড. মিজানুল হক আরো বলেন, ‘দুটো নির্বাচনে আমি দলীয় প্রার্থী হিসেবে জিতেছি। কাজেই এবার মনোনয়ন পেলে আমি অবশ্যই জিতব। এ আসনে আমরা আর ভাড়াটিয়া কাউকে দেখতে চাই না।
আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতির সভাপতি আসাদুল হকও এলাকায় জনসংযোগ করছেন। তিনি বলেন, করিমগঞ্জ-তাড়াইল উপজেলার নেতাকর্মীরা এবার যেকোনো মূল্যে নৌকার প্রার্থীকে দেখতে চায়। বর্তমান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থাকে শোচনীয় উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘এখানে গত ৯ বছরে দলের নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন হয়নি। সামনের নির্বাচনে দলের প্রার্থী মনোনয়ন না পেলে দল শেষ হয়ে যাবে। আশা করছি এবার দল আমাকে মনোনয়ন দেবে।
করিমগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক নাসিরুল ইসলাম খান আওলাদ ২০০৮ ও ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। পরে জোট ও মিত্রের কারণে তাঁকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে হয়। তাঁর সমর্থকরা মনে করে, তিনি দলের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। কিন্তু স্থানীয় এমপির পরোক্ষ বিরোধিতার কারণে তিনি গুছিয়ে উঠতে পারছেন না। কাজেই তাঁকেই মনোনয়ন দেওয়া উচিত।
তবে দলে আওলাদের বিরোধীপক্ষ বলছে, দীর্ঘদিনেও সম্মেলন করতে না পারা ও গত উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলের ভরাডুবির জন্য তিনিই দায়ী।
এ বিষয়ে নাসিরুল ইসলাম খান আওলাদ বলেন, ‘মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী এবং সেই লক্ষ্যে আমার কাজকর্মও চলছে।
জেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহসভাপতি ও বাংলাদেশ স্টিল মিল স্কেল রি-প্রসেস অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এরশাদ উদ্দিন। তাঁর বাড়ি করিমগঞ্জে। তিনিও এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচন করতে চান। দলীয় কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি তাঁর নিজের একটি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় সমাজসেবামূলক কাজ করছেন।
মনোনয়নপ্রত্যাশা প্রসঙ্গে এরশাদ উদ্দিন বলেন, ‘আমি এত দিন ধরে যা করেছি এলাকার মানুষের জন্য করেছি। দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে রাজনীতিও করছি। এলাকার উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে চাই বলেই আগামী নির্বাচনে দলের মনোনয়ন চাইব। দল মনোনয়ন দিলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে নির্বাচন করব।
আইটি ব্যবসায়ী শেখ কবীর আহমেদ রাজনীতির পাশাপাশি এলাকায় সমাজসেবা করছেন। আগে বেশ কয়েকবার মনোনয়ন চেয়েও পাননি। এবার তিনি মনোনয়ন চাইবেন বলে জানিয়েছেন। তাঁর মতে, ‘আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নৌকা প্রতীক ভুলে যাচ্ছে। তাই দলের স্বার্থে হলেও এবার দল থেকে মনোনয়ন দেওয়া উচিত।’
বিএনপি : বিএনপির নেতাকর্মীরা সবাই মনে করে আইনি কোনো ঝামেলায় না পড়লে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. ওসমান ফারুক হবেন দলের প্রার্থী। আপাতত তাঁর বিকল্প কিছু ভাবা হচ্ছে না। তবে কোনো কারণে এ নেতার নির্বাচনে অংশ নেওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়লে বিকল্প চিন্তা করবে দল।
বিকল্প ভাবনা থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে যাঁদের নাম শোনা যাচ্ছে তাঁরা হলেন ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম মোল্লা, জেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম সুমন ও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি জালাল মোহাম্মদ গাউস।
এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত ড. এম ওসমান ফারুকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাংবাদিককে বলেন, ‘নির্বাচন অনেক দূরে। মনোনয়ন দেওয়ার মালিক হচ্ছে দল। দেশের পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় দল যাঁকে মনোনয়ন দেবে তিনিই হবেন দলের প্রার্থী। আপাতত এর বেশি আমার কিছু বলার নেই।
তবে নেতাকর্মীরা মনে করে, যেসব নেতা গত উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রকাশ্যে দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করেছেন, তাঁদের যদি মনোনয়ন দেওয়া হয় নেতাকর্মীরা তা মানবে না।
জেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম সুমন বলেন, ‘আমি দলীয় মনোনয়ন নিয়ে উপজেলা নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলাম। এখন দল মনোনয়ন দিলে সামনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনও করতে চাই। তবে আমরা যাঁরা এখন মাঠে কাজ করছি, সবাই ড. ওসমান ফারুকের হয়েই জনসংযোগ করছি। আমাদের প্রত্যাশা, উনি দেশে ফিরে আসবেন এবং নির্বাচনও করবেন। যদি তিনি আইনি ঝামেলায় পড়ে যান, সে ক্ষেত্রে বিকল্পপ্রার্থী হিসেবে আমি মনোনয়ন চাইব।’
এদিকে এ বলয়ের বাইরে জেলা বিএনপির সহসভাপতি জাহাঙ্গীর আলম মোল্লাও এলাকায় জনসংযোগ করছেন। তিনি বলেন, ‘দল মনোনয়ন দিলে নির্বাচন করব এবং জয়ী হওয়ার আশা রাখি।
সূত্রঃ কালের কণ্ঠ