বিরোধীদলকে কাবু করে আওয়ামী লীগ যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা ধীরে হলেও অনেকে উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবার পর জনগণ বা ভোটারদের প্রতি যে দায়বদ্ধতা কমেছে তা জালানি তেল, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি, বাস ভাড়া বৃদ্ধি থেকে শুরু করে বেশ কিছু সরকারি সিদ্ধান্তে স্পষ্ট হচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও রাজপথের কর্মসূচি আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে। ফলে শাসক দল আওয়ামী লীগ এককভাবেই রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। এতে সংসদকে কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। একই সঙ্গে বিরোধীদল সরকারি দলের অংশ হয়ে যে নতুন ধারার গঠনমূলক রাজনীতির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারও কোনো অবশিষ্ট আর নেই।
ঘুরে ফিরে রাজনীতিতে সংলাপের প্রয়োজনীয়তাই ঘুরপাক খাচ্ছে কেবল। বাম ধারার রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের তোষামদে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বা বিএনপির নেতৃত্বে জোটের দুর্বল অবস্থানের কারণে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। এরফলে বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিকভাবে জাতীয় স্বার্থ আদায়ে দরকষাকষি কার্যকরভাবে করা সম্ভব হচ্ছে না। যদি তা সম্ভব হত তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে বিশেষ সুবিধায় জালানি তেল এনে তা পরিশোধের মাধ্যমে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি না করলেও পারত। অতীতে এধরনের বিশেষ সুবিধা বাংলাদেশ নিয়েছে। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে ভারতের চাওয়া পাওয়ার মধ্যে পররাষ্ট্রনীতি অনেকটাই সীমাবদ্ধ। তিস্তা চুক্তি না হওয়া, মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রফতানি বৃদ্ধি না পাওয়া এমনকি জিএসপি সুবিধা বাতিলের পেছনে বিএনপির লবিস্ট ফার্মের কাছে ধর্ণা দেয়াকে দোষারোপ করার মধ্যে দিয়ে পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতা আড়াল করা সম্ভব হচ্ছে না। রাজনৈতিকভাবে যে কোনো দল বা প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করতে পারে এবং তা বৈধ বলেই এ সম্পর্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তীক্ষè নজর রাখা প্রয়োজন ছিল। যা পারেনি মন্ত্রণালয়টি।
এই অবস্থায় সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে বন্ধু রাষ্ট্রগুলো সবসময় বলে আসছে দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে আলোচনা করতে হবে বড় দু’দলকেই। আলোচনা করে নির্বাচন পদ্ধতির একটা সমাধান বের করেতে হবে। যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই, এ জন্য নির্বাচন পদ্ধতির যদি একটা সমাধান বের কার যায়। তাহলে রাজনৈতিক সমস্যা অনেকটাই কেটে যাবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বুধবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, শেখ হাসিনার অধীনে হবে আগামী নির্বাচন। ছবিসহ ভোটার আইডিকার্ড থাকার পরও নিবার্চনে ভোট কারচুপির অভিযোগ উঠেছে। শুধু স্বাস্থ্যমন্ত্রী নন, প্রায় সকল মন্ত্রীই বলেছেন আগামী নির্বাচন হবে শেখ হাসিনার অধীনে। নির্বাচন যখনই হোক, নির্বাচন যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয় এটাই জনগণের প্রত্যাশা।
যেমন ভারতের কোন নির্বাচন নিয়েই প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকে না। তেমনি ভারতের মতো আমাদেরও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গড়ে তোলা জরুরি বলে মনে করেন সুশিল সমাজ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতারও।
ক্ষমতায়নের জন্য নির্বাচনের বিকল্প নেই। নির্বাচন যদি স্বচ্ছ হয় তাহলে বিতর্কের অবসান ঘটবে। স্বাধীনতার পর আমাদের দেশের অনেক নির্বাচিত সরকারই পূর্ণমেয়াদ পূরণ করতে পারে নাই। বিরোধীদল বছরের পর বছর বয়কট করছে জাতীয় সংসদের অধিবেশন।
এক নজরে জাতীয় সংসদ বয়কটের দিকে তাকালে দেখা যায়, প্রথম সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ। ১৯৭৫এর ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করে সামরিক শাসনের মধ্য দিয়ে সংসদের যাত্রা থামানো হল। সামরিক শাসনের মধ্যে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন হল ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ আবারও সামরিক শাসন জারি করে দ্বিতীয় সংসদ বাতিল করা হল।
সামরিক শাসনের মধ্যে তৃতীয় সংসদ নির্বাচন হল ১৯৮৬ সালের ৭ মে। বিএনপি নির্বাচন বয়কট করল। বিরোধী দল, আওয়ামী লীগ সংসদ থেকে পদত্যাগ করায় ১৯৮৭ সালের ৬ ডিসেম্বর সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়। চতুর্থ সংসদ নির্বাচন হল ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ। বড় কোনো দলই তাতে অংশ নেয়নি। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে এই সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়।
পঞ্চম সংসদ নির্বাচন হল ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। ১৯৯৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সংসদ থেকে পদত্যাগ করল। ১৯৯৫এর ২৪ নভেম্বর মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সংসদ ভেঙে ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন হল ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। বিএনপি ছাড়া কোনো দলই তাতে অংশ নিল না। দেড় মাসের মাথায় ওই সংসদও ভেঙে দিতে হল।
তার মানে, ১৯৯৫ পর্যন্ত ছয়টি সংসদের কোনোটিই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। কিন্তু, এরপর সপ্তম, অষ্টম ও নবম সংসদ পূর্ণ মেয়াদে ছিল। বর্তমান দশম সংসদ বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোট বয়কট করেছে।
গত সংসদ নির্বাচন হয়ে গেল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। অনেকে বলছেন বিশ্বের ইতিহাসেও এই নির্বাচন হবে নজিরবিহীন। যে নির্বাচনে বিপুল সংখ্যক প্রার্থী তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে হয়েছেন ১৫৪ জন। সরকার গঠনের জন্য ন্যূনতম আসনেরও বেশি পেয়ে সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ।
আইন অনুযায়ী, এভাবে নির্বাচিত হতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এতোগুলো প্রার্থী জনপ্রতিনিধি হয়ে মহান জাতীয় সংসদে আসবেন অথচ তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত নন। জাতীয় সংসদ, যেখানে জনগণের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটবে সেখানে তাদের প্রতিনিধিরা ‘অনির্বাচিত’। অর্থাৎ নৈতিকভাবে এদের জনগণের প্রতিনিধি বলা যাচ্ছে না।
মাঠের বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা এ নির্বাচনকে ভোটাধিকার হরণের সাথেও তুলনা করছেন। হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৯ কোটি ভোটারের মধ্যে প্রায় ৬ কোটিই তাদের মতামত দিতে পারছেন না। তাহলে দুই তৃতীয়াংশ ভোটার যেখানে তাদের মতামত দেয়ার সুযোগ পেল না, পছন্দ-অপছন্দের কথা জানাতে পারলো না সেখানে আওয়ামী লীগ সরকার কী করে দাবি করবে তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনগণের সরকার!
এসব সমস্যা তৈরি হচ্ছে মূলত চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের কারণে। প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনে না আসার কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন পদ্ধতিরও যে ত্রুটি রয়েছে সে বিষয়টি এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে। এ নির্বাচন পদ্ধতি সত্যিকার জনপ্রতিনিধিত্বমূলক জাতীয় সংসদ উপহার দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। তাই এ ত্রুটি সংশোধন বা নতুন পদ্ধতি অনুসরণের পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
বুধবার একটি জাতীয় দৈনিকে সাক্ষাৎকারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলী খান বলেন, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই চলমান রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দরকার সর্বদলীয় নির্বাচন পদ্ধতি। নির্বাচন পদ্ধতি ঠিক করা গেলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এটা সংবিধানের মূল চেতনার বিরোধী। গণতন্ত্রে সাধারণত প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হয়। এত আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন সব ম্লান করে দিয়েছে। এ জন্য সবার অংশগ্রহণে যত তাড়াতাড়ি নির্বাচন হবে-দেশের জন্য ততই ভালো।’