হাওর বার্তা ডেস্কঃ ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় এক ঝাঁক সূর্য বিজয়ী, মেধাবী ও প্রগতিশীল ভাবাদর্শের ছাত্র নেতাদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত সভার মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম ছাত্র সংগঠন ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’।
জন্মলগ্ন থেকেই ভাষার অধিকার, শিক্ষার অধিকার, বাঙালির স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান, সর্বোপরি স্বাধীনতা ও স্বাধিকার আন্দোলনের ছয় দশকের মধ্যে সবচেয়ে সফল সাহসী ছাত্র সংগঠনের নাম ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’। সংগঠনটি সৃষ্টির পর বাঙালির জাতীয়তা বিকাশে নেতৃত্ব দান করে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা করে।
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ পরিশ্রমে যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ১৯৫৮ সালের আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে ছাত্রলীগের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা নিয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া, ৬ দফাকে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা, ১৬৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে পাক শাসককে পদত্যাগে বাধ্য করা এবং বন্দীদশা থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করা,
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে ছাত্রলীগের অভূতপূর্ব ভূমিকা পালনে আওয়ামী লীগের বিজয়, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখসমরে ছাত্রলীগের অংশগ্রহণ এবং ছাত্রলীগের সতের হাজার নেতা-কর্মীর আত্মত্যাগ, ১৯৮৯ সালে সামরিক শাসক হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ বিরোধী আন্দোলন যা শেষ হয় ১৯৯০ সালে। সেখানে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। তখন ছাত্রলীগের গড়ে তোলা দুর্বার আন্দেলনের কারণে স্বৈরাচার এরশাদের পতন তরাণ্বিত হয়।
দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে ছাত্রলীগ সবসময় ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে আসছে। সবশেষে তথাকথিত ১/১১-এর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে দূর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে বাংলাদেশে ছাত্রলীগ। ওই সময় সামরিক চাদরে ঢাকা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাইনাস-টু ফর্মুলা বাস্তবায়নে প্রতিবদ্ধকতা সৃষ্টি করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
আর্তমানবতার সেবায় ছাত্রলীগ: আর্তমানবতার সেবায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সবসময় কাজ করে গেছে। অতিতের ন্যায় বর্তমানেও সেই লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছে। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরাসহ যেকোনো প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগে কাজ করে গেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বাংলাদেশ যখনই কোনো সংকটে পড়েছে তখনই বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ত্রাণকর্তা হয়ে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। আর্তমানবতার সেবায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সবসময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। সেই লক্ষ্যে প্রতি বছর বাংলাদেশ ছাত্রলীগ প্রায় ৩০ হাজার ব্যাগ রক্ত বিভিন্ন হাসপাতালে মুমূর্ষু রোগীদের দান করে থাকে।
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ছাত্রলীগ: ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর (বৃহস্পতিবার) রাতে বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, বরগুনা ও ভোলাসহ দেশের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যায় সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় গোর্কি। গোর্কির আঘাতে যখন বিরাণ ভূমিতে পরিণত হয়েছিল বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল, তখনও উদ্ধার ও ত্রাণ নিয়ে হাজির হয়েছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
১৯৮৮-সালের বন্যা ছিলো বাংলাদেশে সংঘটিত প্রলংকারী বন্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস জুড়ে সংঘটিত এই বন্যায় দেশের প্রায় ৬০% এলাকা পানিতে ডুবে যায় এবং স্থানভেদে এই বন্যাটি ১৫ থেকে ২০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী ছিলো। এই বন্যা ছিল এ দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক ও ক্ষতিময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সেই সময় ছাত্রলীগের অসংখ্য নেতাকর্মী উদ্ধার ও ত্রাণকার্য করেছে।
১৯৯৮ সালের বন্যা যখন বাংলাদেশকে দুই মাসের অধিক সময় পানির নিচে ডুবিয়ে রেখেছিল, বিবীষীকাময় সেই দিনগুলোতেও ত্রাণ বিতরণ ও উদ্ধারকাজে অগ্রণী ভুমিকা পালন করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ২০০০ ভারতের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের ৫টি দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা বন্যায় বিধ্বস্ত। প্রায় ৩০ লক্ষ লোক গৃহহীন হয়। তখনও সেই গৃহহীন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
এছাড়া ২০০৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বরের টর্ণেডো, ২০০৭ সালে সিডর, ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা, ২০১৩ সালের ১৬ মে (বৃহস্পতিবার) বঙ্গোপসাগরের ঘুর্ণিঝড় মহাসেনসহ উপরিক্ত সকল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে।
২০১৩ সাভারে রানা প্লাজা যখন ধ্বসে যখন ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছিল, তখন শত শত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী স্বেচ্ছায় উদ্ধারকার্যে অংশগ্রহণ করে এবং আহত মুমর্ষ রোগীদের জন্য রক্তদান কর্মসূচী পালন করে। সম্প্রতি দেশের উত্তর ও উত্তর পূর্বাঞ্চল বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে সবার আগে পৌঁছে গিয়েছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। কেন্দ্রীয় কমিটির মনিটরিং সেলের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে ত্রাণকার্য পরিচালনা করা হয়।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সেবায় ছাত্রলীগ: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারের স্থানীয় নাগরিক ও দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘এখন যারা যুবক তারা হয়তো মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি। কিন্তু আমরা দেখেছি। তাই রোহিঙ্গাদের যেন কোনো কষ্ট না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তার ডাকে সাড়া দিয়ে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে রোহিঙ্গাদের পাশে থেকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অসংখ্য নেতা-কর্মী।
মিয়ানমার থেকে নির্যাতনের কারণে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা সেবায় এক’শ ছয় দিন পার করলো বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। এই শত দিনে ৩৪ হাজার ৭৮৫ জন রোহিঙ্গাকে চিকিৎসা সেবা ও ঔষুধ সরবরাহ করেছে ছাত্রলীগের মনিটরিং সেল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা সেবায় এই মনিটরিং সেল ও ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প চালু করে।
কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের তত্ত্বাবধানে উখিয়ার বালুখালীস্থ টিভি টাওয়ার এলাকায় উক্ত মেডিকেল ক্যাম্প থেকে প্রতিদিন চিকিৎসা সেবা, ঔষুধ ও বিশুদ্ধ পানি বিতরণ করা হচ্ছে। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত এ কার্যক্রম চলে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ইশতিয়াক আহমদ জয়।
কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ইশতিয়াক আহমদ জয় জানান, ‘বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা মানবতার নেত্রী। মানবিক কারণেই তিনি রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে সব ধরণের সহযোগিতা করে যাচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে ছাত্রলীগের এই কার্যক্রম চালু করা হয়। এই মেডিক্যাল ক্যাম্পে -এ পর্যন্ত ৬ হাজার ৩৫৬ জন পুরুষ, ১০ হাজার ৭৮৯ জন মহিলা ও ১৭ হাজার ৬৪০ জন শিশু রোগিকে সেবা দেয়া হয়েছে।’
বর্তমানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ শিক্ষার অধিকার ও একটি সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা, মাদকমুক্ত ছাত্র সমাজ গঠনে ঐকবদ্ধভাবে কাজ করে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ অনুযায়ী মাদকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন। তিনি বলেন,‘তরুণ সমাজ যাতে মাদকের বিষাক্ত ছোবলে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।’
সাধারণ মানুষের যেন কোনো দুর্ভোগ সৃষ্টি না হয় সে লক্ষ্যে যানজটের কথা বিবেচনা করে ছাত্রলীগ এখন থেকে শুক্র ও শনিবার ছাড়া আর কোনোদিন কর্মসূচি দেয় না। বিদ্যার সঙ্গে বিনয়, শিক্ষার সঙ্গে দীক্ষা, কর্মের সঙ্গে নিষ্ঠা, জীবনের সঙ্গে দেশপ্রেম এবং মানবীয় গুণাবলির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ অতিক্রম করেছে পথচলার ৭০ বছর। আমি বিশ্বাস করি- ছাত্রলীগ আমার অস্তিত্বে, আমার অহংকার।
এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম এই ছাত্র সংগঠনের ৭০তম জন্মদিন উপলক্ষে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সর্বস্তরের সাহসী, নির্ভীক, অকুতোভয় সৈনিকদের জানাই মুজিবীয় শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।