হাওর বার্তা ডেস্কঃ জেলার শাসনগাছা বাস টার্মিনাল। এ টার্মিনালে দুই বছর আগে হেলপার হিসেবে কাজ করে ৭ বছরের শিশু হায়দার। প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা আবার কখনো ১১টা পর্যন্ত কাজ করতে হয় তাঁকে। বিনিময়ে মিলে ৫০ টাকা। আর এই ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহনের কাজে প্রতিদিনই কেউ না কেউ যুক্ত হয়।
অন্যদিকে কুমিল্লা নগরীর ধর্মপুর চৌহমুনীর হাবিব এন্টারপ্রাইজে ৭ বছর বয়স থেকেই ১০ টাকার বিনিময়ে কাজ শুরু আজাদের। গত ১০ বছরে তাঁর কাজের মাইনে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১৫০ টাকা। চৌহমুনি কয়েক দোকান পর মোসার্স জামান অটো রিপিয়ারিং ওয়ার্কশপ। এখানে সকাল ৯টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত কাজ করছে বাইজিদ (৯), নাঈম (১০) ও হৃদয় (৯)।
বাইজিদের স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে ৪র্থ, নাঈম ৩য় শ্রেণি ও হৃদয় পায়নি সুযোগ। এর পাশেই মানিয়া ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়াকর্সপ। এখানে কাজ করে তারেক (৭), রানা (৮) ও কালু (১২)। কয়েকটি ওয়াকর্সপের পর ডেপোডিল মটরস। এখানে ৪র্থ শ্রেণি পড়ুয়া সাইফুল (৮) কাজ করছে। একটু সামনে সেডু ইঞ্জিয়ারিং ওয়াকর্সপ। এখানে কাজ করছে মাহাফুজ (১২) ও হৃদয় (১০)।
মাহাফুজ ও হৃদয়ের মতো এমন হাজারো শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। ধর্মপুর চৌহমুনি থেকে রেল স্টেশন গেইট পর্যন্ত প্রায় সব কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ সম্পাদন হচ্ছে কোমলমতি শিশুদের দিয়ে। শুধু এখানেই শেষ নয় কুমিল্লা মহানগরীসহ জেলার সব উপজেলা মিলে প্রায় ৩০ হাজারেরও বেশি শিশু শারীরিক শ্রমে নিয়োজিত। এদের মধ্যে বেশির ভাগই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে।
সরকারিভাবে কুমিল্লা জেলায় মোট শিশু শ্রমিকের সংখ্যা না জানা গেলেও। বেসরকারিভাবে জানা যায়, এর সংখ্যা ৩০ হাজারের মতো। শ্রম আইন অনুযায়ী, শিশুদের দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ করানো সম্পূর্ণ নিষেধ। কিন্তু আইন অমান্য করেই ছোট বড় সব প্রতিষ্ঠানেই বাড়ছে শিুশু শ্রমিকের সংখ্যা।
সরকারের গেজেট সূত্রে জানা যায়, সরকার ৩৮ ধরনের কাজকে শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এগুলো হলো অ্যালুমিনিয়াম ও অ্যালুমিনিয়ামজাত, আটোমোবাইল, ব্যাটারি রিং চার্জিং, বিড়ি ও সিগারেট তৈরি, ইট বা পাথর ভাঙা, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, সাবান বা ডিটারজেন্ট তৈরি, স্টিল ফার্নিচার বা গাড়ি বা মেটাল ফার্নিচার তৈরি, চামড়াজাত দ্রব্যাদি তৈরি, ওয়েল্ডিং বা গ্যাস বার্নার, কাপড়ের রং ব্লীচ করা, চামড়ার জুতা তৈরি ভলকানাইজিং, মেটাল কারখানা, স্টিল ও মেটাল কারখানায়, সোনার দ্রব্যাদি বা ইমিটেশন বা চুড়ি, ট্রাক, টেম্পো ও বাস হেলপার, ববিন ফ্যাক্টরিতে, তাঁতের কাজ, ইলেকট্রিক মেশিনের কাজ, বিস্কুট বা বেকারি কারখানায়, নির্মাণ কাজ, কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি, কসাইয়ের কাজ ও কামারের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে কুমিল্লার কয়েক হাজার শিশু শ্রমিক নিয়োজিত।
কুমিল্লা জেলা শিশুদের সুরক্ষা বৃদ্ধি ও পুনর্বাসন করার লক্ষ্যে ‘দৃষ্টি’ কুমিল্লা তিন বছর মেয়াদী একটি প্রকল্প পরিচালনা করে। ‘ইম্প্রোভিং চাইল্ড প্রটেকশন থ্রো কমিউনিটি রেসপন্স’ নামে এ প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ৩১ মার্চ ২০১৭। প্রকল্পের গবেষণায় দেখা যায় ৩৮ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজের মধ্যে কুমিল্লার শিশুরা ২৪ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, কুমিল্লার ব্যস্ততম ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা অংশের চৌদ্দগ্রাম, মিয়ারবাজার, সুয়াগঞ্জ, পদুয়ারবাজার, লাকসাম বাইপাস, লালমাই, মুদাফুরগঞ্জ, ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট, চান্দিনা, মাধাইয়া, ইলিয়টগঞ্জ, গৌরীপুর ছাড়াও কংশনগর, দেবিদ্বার, কোম্পানীগঞ্জ, মুরাদনগর, হোমনাসহ জেলার বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত রয়েছে কয়েক হাজার শিশু। যাত্রীবাহী যানবাহনের সহকারী হিসেবে শিশুদের দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়।
অন্যদিকে জেলার প্রায় অধিকাংশ হোটেল ও চায়ের দোকান পরিচালনা হয় শিশুদের দিয়ে। একইভাবে বিভিন্ন মিল-কারখানায় সকাল-সন্ধ্যা কাজ করছে অনেকেই। এদের মধ্যে নগরীর বেশিরভাগ কারখানায় গভীর রাত কোথাও কোথাও সারা রাত বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত থাকে শিশু শ্রমিক।
শিশুশ্রমের কারণে একদিকে যেমন এসব শিশু খেলাধুলা, পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি তাদের স্বাভাবিক বিকাশও বিঘ্নিত হচ্ছে। স্কুল থেকে ঝরে পড়া এবং শ্রমে নিয়োজিত হওয়ার অন্যতম কারণ হলো, পরিবারের দারিদ্র্যতা, মা-বাবার কাছ থেকে সেবা বা যত্নের অভাব এবং শিশুর স্কুল পছন্দ না হওয়া প্রভৃতি। শিশুরা অভিভাবকহীন হয়ে পড়া, সংসারে অর্থের জোগান দিতে শ্রমে নিয়োজিত হয়ে পড়ে শিশুরা এমনটা মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বর্তমানে কুমিল্লা নগরীসহ জেলায় শিশুশ্রমের হার মারাত্মক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় শিশুদের দিয়ে কাজ করানোর মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। জেলা কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের ভাষ্য মতে, ১০ বছরের কম বয়সী শতকরা ১৬ শিশু বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত। বিভিন্ন শ্রমে নিয়োজিত নারীদের মধ্যে শতকরা ১২ জন মেয়ে শিশু এবং পুরুষদের মধ্যে শতকরা ২১ ছেলে শিশু। তাদের বয়স ১০ বছর পার না হওয়ার আগেই কাজে নিয়োজিত হয়েছে। হতদরিদ্র পরিবারের শিশুদের মধ্যে ১১ থেকে ১৪ বছর বয়সের শতকরা ৬৩ শিশু কাজ করছে। হতদরিদ্র পরিবারের মেয়েদের মধ্যে শতকরা ৬২ এবং ছেলেদের মধ্যে শতকরা ৬৩ শিশুশ্রমে নিয়োজিত।
দৃষ্টি কুমিল্লার ‘ইম্প্রোভিং চাইল্ড প্রটেকশন থ্রো কমিউনিটি রেসপন্স’ এ প্রকল্পটি তিন বছর মেয়াদকালে ১ হাজার ৬০৪ জন শিশু শ্রমিকের সুরক্ষায় কাজ করেছে। এদের মধ্যে ৭৪ জন ছেলে ও ৫৩ জন মেয়ে শিশু শ্রমিককে কর্মমুখী প্রশিক্ষণ প্রধান করা হয়েছে এমন তথ্য জানান প্রকল্পের সমন্বয়কারী মমতাজ বেগম। শিশুশ্রম বন্ধে এনজিওর ভূমিকা নিয়ে তিনি বলেন, এনজিও কাজের সীমাবদ্ধতা থাকে। আমরা প্রকল্প অনুযায়ী কাজ করে থাকি। তাছাড়া কাউন্সেলিং করে কতটুকু কাজ হয়। আমাদের এ প্রকল্পে লক্ষ অনুযায়ী কাজ করেছি।
বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ ও ধনী গরিবের বৈষম্যকে শিশু শ্রম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করেন জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক রাশেদা আক্তার। সামাজিক সচেতনতা ও বেসরকারি এনজিও সংস্থাগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণে শিশুশ্রম অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব। তবে অবশ্যই এনজিও সংস্থাগুলোকে কাজের পরিধি গুটি কয়েকজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে কাজের গতি বৃদ্ধি করতে হবে।
কুমিল্লা জেলা কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন পরিদর্শকের কার্যালয়ের শ্রম পরিদর্শক মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক নিয়োগ দিলে অবশ্যই নিয়োগপত্র এবং পরিচয়পত্র শ্রমিককে প্রদানের বিধান আছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ নিয়ম মানছে না ছোট বড় বহু প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান। ফলে আমরা শিশু শ্রমিকের সংখ্যা চিহ্নিত করতে পারি না। তিনি আরো বলেন, আগামী মাসে শিশু শ্রম কমিয়ে আনতে আলোচনা সভা হবে। তাছাড়া ২০২৫ সালের মধ্যে শিশু শ্রম কমিয়ে আনতে সরকার নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। শুরুতে শিশু শ্রম কমিয়ে আনতে চারটি সেক্টরে কাজ শুরু হবে।