ঢাকা ১০:০৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে আজও দুই গাড়ির সংঘর্ষ, নিহত ১ সাদপন্থীদের নিষিদ্ধ ও বিচারের দাবিতে মদনে আবারও বিক্ষোভ মিছিল পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বর্ডারে দুর্নীতির কারণে ঠেকানো যাচ্ছে না ‘রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ আব্রাম না থাকলে তাকে আমার যোগ্য বলেও মনে করতাম না ওমরাহ শেষে গ্রামে ফিরে খেজুর-জমজমের পানি বিতরণ করল শিশু রিফাত বিদেশে প্রশিক্ষণে ঘুরে-ফিরে একই ব্যক্তি নয়, জুনিয়রদের অগ্রাধিকার কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়ে সড়ক ছাড়লেন চিকিৎসকরা রেমিট্যান্সে জোয়ার, ২১ দিনে এলো ২ বিলিয়ন ডলার গণমাধ্যমের পাঠক-দর্শক-শ্রোতার মতামত জরিপ জানুয়ারিতে বুয়েট শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় গ্রেপ্তার ৩ আসামি রিমান্ডে

বিএনপিও বঙ্গবন্ধুর ভাষণ উদ্‌যাপন করুক

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৪:১০:০৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ নভেম্বর ২০১৭
  • ৪০৮ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ যেমন সমগ্র জাতির সম্পদ, তেমনি সাতই মার্চের রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণও। এ নিয়ে কোনো বিতর্ক হওয়া উচিত নয়। সাতই মার্চের ভাষণ মুক্তিযুদ্ধের সময় গোটা জাতিকে অনুপ্রাণিত ও আন্দোলিত করেছে।
বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ ইউনেসকোর স্বীকৃতি পেয়েছে বলে এর গুরুত্ব বাড়েনি। ভাষণটি গুরুত্বপূর্ণ বলেই ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করেছে। ইউনেসকো এ ঘোষণা না দিলেও বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এতটুকু ম্লান হতো না, গুরুত্ব হারাত না। ইউনেসকোর স্বীকৃতির বহু আগে কবি নির্মলেন্দু গ‌ুণ যেমন লিখেছেন: একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে ‘কখন আসবে কবি?’ ‘কখন আসবে কবি? একটি কবিতা পড়া হবে তার জন্য সে কী ব্যাকুল প্রতীক্ষা মানুষের।

‘কখন আসবে কবি?’ ‘কখন আসবে কবি?’ শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন। তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল, হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা; কে রোধে তাঁহার বজ্র কণ্ঠ বাণী? গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর
অমর কবিতাখানি: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
সেই থেকে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি আমাদের।

তাই সাতই মার্চের ভাষণ উদ্‌যাপনের বিষয়টি যেন শুধু আড়ম্বর বা আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত না হয়, এই ভাষণের কথাগুলো যেন আমরা হৃদয়ে ধারণ করি। প্রাত্যহিক জীবনে অনুসরণ করি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কীভাবে জবাব দিতে হয়, কীভাবে প্রতিপক্ষের যুক্তি খণ্ডন করতে হয়, তারও অনন্য উদাহরণ হয়ে আছে এই ভাষণ।
ভাষণটি নতুন প্রজন্মের জানা উচিত। পড়া উচিত। বারবার শোনা উচিত। তাহলে তারা বুঝতে পারবে, আমাদের দেশে এ রকম একজন নেতা জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যিনি শত্রুর কামান-বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়েও বলতে পারতেন, ‘তোমরা আর দাবায়ে রাখতে পারবা না। রক্ত যখন দিতে শিখেছি রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ।’

মনীষী লেখক আহমদ ছফা লিখেছিলেন, বাঙালির শ্রেষ্ঠ সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ নয়; শ্রেষ্ঠ সংগীত হলো ‘তোমরা আর দাবায়ে রাখতে পারবা না’। এই পাঁচটি শব্দে প্রতিধ্বনিত হয়েছে একটি জাতির বিদ্রোহ এবং শির উন্নত রাখার দৃপ্ত অঙ্গীকার। সাতই মার্চের ভাষণে ইতিহাসের বিশ্লেষণ আছে, চলমান ঘটনার ব্যাখ্যা আছে, আছে ভবিষ্যতের করণীয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা। তিনি বলেছেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার না পারি, তোমাদের যার যা আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করো।’ তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে বাঙালির সেই হাজার বছরের প্রত্যয়: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

এই ভাষণের পঙ্‌ক্তিতে পঙ্‌ক্তিতে আছে ন্যায় ও সত্যের দাবি। গণতন্ত্রের মন্ত্র। আছে জনগণের সার্বভৌমত্বের কথা। তাদের ভোটের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার কথা।

মাত্র ১৯ মিনিটের এই ভাষণের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আজ অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি।’ এর পরের বাক্যটি লক্ষ্য করুন—‘আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন।’ এর মাধ্যমে তিনি রমনা রেসকোর্সে উপস্থিত ১০ লাখ শ্রোতার সঙ্গে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকেও যুক্ত করলেন। তাঁর ইতিহাস বর্ণনায় জনগণের দুঃখ-বেদনার কথা আছে, আন্দোলন-সংগ্রামের কথা আছে। আছে আত্মদানের কথা। তিনি শাসকগোষ্ঠীকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, ট্যাংক-কামান-বন্দুকের চেয়ে জনগণের শক্তি বড়।

সাতই মার্চের ভাষণকে ইউনেসকোর স্বীকৃতি আমাদের আনন্দ দেয়। আবার আমাদের জাতিগত দ্বিচারিতা দেখে লজ্জিতও হই। আমি নতুন প্রজন্মের কথা বলছি না। এমনকি যাঁদের বয়স ৪০ বছরের নিচে, তাঁদেরও দ্বিচারিতার দায় থেকে রেহাই দেওয়া যায়। কিন্তু স্বাধীনতার প্রজন্মের মানুষের কাছে যে প্রশ্নটি করতে হয়, তা হলো এত দিন কোথায় ছিলেন? কী করেছেন? বঙ্গবন্ধু ভাষণটি দিয়েছিলেন ১৯৭১ সালে, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে। আর আমাদের লেখক-শিল্পী-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী-আইনজীবী, সরকারি কর্মকর্তাদের বড় অংশ হঠাৎ ভাষণের মাহাত্ম্য আবিষ্কার করলেন।

ক্ষমতায় গিয়ে যাঁরা এই ভাষণ নিষিদ্ধ করেছিলেন, রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রে প্রচার করতে দেননি, প্রধানমন্ত্রী যথার্থই তাঁদের সমালোচনা করেছেন। ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু আজ যাঁরা সরকারি আয়োজনের সুবাদে জয়ধ্বনি দিচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই সেদিন নিশ্চুপ ছিলেন। প্রতিবাদ করেননি। এমনকি ১৯৯৬ সালের আগে এ নিয়ে লেখালেখি করেছেন, এ রকম মানুষও বেশি ছিলেন না। এখন অনেকেই পঁচাত্তর-পরবর্তী পনেরো বা একুশ বছরকে কৃষ্ণপ্রহর বলে দাবি করেন। কিন্তু সেই কৃষ্ণপ্রহরে কার কী ভূমিকা ছিল, সেটাও জনগণের সামনে তুলে ধরা দরকার। সরকারের যাঁরা চাকরি করেন, তাঁরা সরকারের নীতি বাস্তবায়ন করবেন, সেটাই হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু যাঁরা লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবী ছিলেন, তাঁরা কী করেছেন?

আমাদের যত দূর মনে পড়ে, বঙ্গবন্ধু হত্যা নিয়ে প্রথম লিখেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় (যদিও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের দোহাই দিয়ে ভারত সরকার তখন সেই লেখা ছাপতে দেয়নি)। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রথম গল্প লিখেছিলেন আবুল ফজল। গল্পের নাম ‘মৃতের আত্মহত্যা’। তিনি তখন বিচারপতি সায়েম ওরফে জিয়াউর রহমান সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। এরপর কবি নির্মলেন্দু গ‌ুণ বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একুশের কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে পড়লেন সেই কবিতা: ‘আমি কারও রক্ত চাইতে আসিনি। আমি শুধু কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলতে এসেছি।’

সেই যে প্রাণের ধ্বনি উচ্চারিত হলো, ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। কবি নির্মলেন্দু গ‌ুণ জানাচ্ছেন, টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর জানাজা পড়েছিলেন যে ইমাম, তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার পরই একটি কবিতা লিখেছিলেন উর্দুতে। পরে গুণ সেটি বাংলায় অনুবাদও করেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম সংকলন বের হয়েছিল: ‘এ লাশ আমরা রাখব কোথায়’। এতে শামসুর রাহমানসহ অনেকে লিখেছিলেন, আবার আজকের বঙ্গবন্ধু ভক্তদের অনেকে লিখতে সাহস পাননি। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে যে কটি সংবাদপত্র বঙ্গবন্ধুকে সামনে নিয়ে এসেছে, তার মধ্যে অগ্রণী ছিল ‘সংবাদ’। এ ছাড়া ‘সাপ্তাহিক মুক্তির বাণী’, ‘সাপ্তাহিক খবর’ ইত্যাদি পত্রিকাও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখালেখি করেছে। তখন বঙ্গবন্ধুভক্তদের কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুবিরোধী বলে পরিচিত এবং সামরিক সরকারের সমর্থক পত্রিকায় কাজ করাকে শ্রেয় মনে করেছেন।

আমাদের একজন জনপ্রিয় লেখক ও চিত্রনির্মাতা তাঁর একটি ছবিতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ব্যবহার করেছিলেন। সে জন্য তিনি ধন্যবাদ পেতে পারেন। কিন্তু তিনি যখন সেই ছবিটির প্রিমিয়ার শো করলেন, তখন বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অংশটি বাদ দিয়েছিলেন। আমাদের দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক ও চিত্রনির্মাতাও যদি এই কাজ করেন, তার চেয়ে লজ্জার কী হতে পারে? এ কথাগুলো এ কারণে বললাম যে আবার প্রতিকূল পরিবেশ এলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি নিয়ে কথা বলার লোক পাওয়া যাবে না।

আজ কেউ আওয়ামী লীগ করতে পারেন। কেউ বিএনপি করতে পারেন। কেউ অন্য দলও করতে পারেন। কিন্তু একাত্তর, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ইত্যাদি নিয়ে কোনো বিতর্ক হওয়া উচিত নয়। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একটি গুরুতর অভিযোগ করেছেন, সাতই মার্চের ভাষণ উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশে-মিছিলে জোর করে, হুমকি দিয়ে সরকারি কর্মচারীদের, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমরা মনে করি, মার্চের ভাষণের যে ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য, তাতে এই ভাষণ শোনানোর জন্য কারও ওপর জবরদস্তির প্রয়োজন নেই। মানুষ ঘরে-বাইরে নিজের আগ্রহে এই ভাষণ শুনবে। অন্যকে শোনাবে। এই ভাষণের মাধ্যমে একাত্তরকে বোঝার চেষ্টা করবে।

বিএনপি মহাসচিব প্রশ্ন করেছেন, সেই ভাষণ শোনানোর জন্য, ভাষণ উপলক্ষে কোনো আয়োজনে মানুষকে জোর করে নিতে হবে কেন? কিন্তু এ প্রসঙ্গে তাঁকে পাল্টা প্রশ্নটি করতে পারি, ভাষণটি যদি ঐতিহাসিক ও ইউনেসকোর স্বীকৃতি পাওয়া আনন্দের হয়, তাহলে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি কেন সেই উদ্‌যাপনে যোগ দেবে না? কেন তাদের কর্মীদের এই ভাষণের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করবে না? বিএনপিতে অনেক নেতা আছেন, যাঁরা একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন। তাঁদের নিশ্চয়ই মনে আছে, দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ‘একটি জাতির জন্ম’ নিবন্ধে লিখেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ তাঁদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সবুজসংকেত বা গ্রিন সিগন্যাল মনে হয়েছিল।

বিএনপি সাতই মার্চ উদ্‌যাপন করুক। আর আওয়ামী লীগও স্বীকার করে নিক জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাঁর এই ঘোষণার স্বীকৃতি কিন্তু ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টেও আছে।

বর্তমান রাজনৈতিক বিভাজন থেকে একাত্তরকে মুক্ত রাখতে পারলে, ইতিহাসে যাঁর যেটুকু ভূমিকা আছে স্বীকার করলে অনেক বিতর্কেরই অবসান হতে পারে।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে আজও দুই গাড়ির সংঘর্ষ, নিহত ১

বিএনপিও বঙ্গবন্ধুর ভাষণ উদ্‌যাপন করুক

আপডেট টাইম : ০৪:১০:০৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ নভেম্বর ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ যেমন সমগ্র জাতির সম্পদ, তেমনি সাতই মার্চের রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণও। এ নিয়ে কোনো বিতর্ক হওয়া উচিত নয়। সাতই মার্চের ভাষণ মুক্তিযুদ্ধের সময় গোটা জাতিকে অনুপ্রাণিত ও আন্দোলিত করেছে।
বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ ইউনেসকোর স্বীকৃতি পেয়েছে বলে এর গুরুত্ব বাড়েনি। ভাষণটি গুরুত্বপূর্ণ বলেই ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করেছে। ইউনেসকো এ ঘোষণা না দিলেও বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এতটুকু ম্লান হতো না, গুরুত্ব হারাত না। ইউনেসকোর স্বীকৃতির বহু আগে কবি নির্মলেন্দু গ‌ুণ যেমন লিখেছেন: একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে ‘কখন আসবে কবি?’ ‘কখন আসবে কবি? একটি কবিতা পড়া হবে তার জন্য সে কী ব্যাকুল প্রতীক্ষা মানুষের।

‘কখন আসবে কবি?’ ‘কখন আসবে কবি?’ শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন। তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল, হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা; কে রোধে তাঁহার বজ্র কণ্ঠ বাণী? গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর
অমর কবিতাখানি: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
সেই থেকে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি আমাদের।

তাই সাতই মার্চের ভাষণ উদ্‌যাপনের বিষয়টি যেন শুধু আড়ম্বর বা আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত না হয়, এই ভাষণের কথাগুলো যেন আমরা হৃদয়ে ধারণ করি। প্রাত্যহিক জীবনে অনুসরণ করি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কীভাবে জবাব দিতে হয়, কীভাবে প্রতিপক্ষের যুক্তি খণ্ডন করতে হয়, তারও অনন্য উদাহরণ হয়ে আছে এই ভাষণ।
ভাষণটি নতুন প্রজন্মের জানা উচিত। পড়া উচিত। বারবার শোনা উচিত। তাহলে তারা বুঝতে পারবে, আমাদের দেশে এ রকম একজন নেতা জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যিনি শত্রুর কামান-বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়েও বলতে পারতেন, ‘তোমরা আর দাবায়ে রাখতে পারবা না। রক্ত যখন দিতে শিখেছি রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ।’

মনীষী লেখক আহমদ ছফা লিখেছিলেন, বাঙালির শ্রেষ্ঠ সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ নয়; শ্রেষ্ঠ সংগীত হলো ‘তোমরা আর দাবায়ে রাখতে পারবা না’। এই পাঁচটি শব্দে প্রতিধ্বনিত হয়েছে একটি জাতির বিদ্রোহ এবং শির উন্নত রাখার দৃপ্ত অঙ্গীকার। সাতই মার্চের ভাষণে ইতিহাসের বিশ্লেষণ আছে, চলমান ঘটনার ব্যাখ্যা আছে, আছে ভবিষ্যতের করণীয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা। তিনি বলেছেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার না পারি, তোমাদের যার যা আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করো।’ তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে বাঙালির সেই হাজার বছরের প্রত্যয়: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

এই ভাষণের পঙ্‌ক্তিতে পঙ্‌ক্তিতে আছে ন্যায় ও সত্যের দাবি। গণতন্ত্রের মন্ত্র। আছে জনগণের সার্বভৌমত্বের কথা। তাদের ভোটের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার কথা।

মাত্র ১৯ মিনিটের এই ভাষণের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আজ অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি।’ এর পরের বাক্যটি লক্ষ্য করুন—‘আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন।’ এর মাধ্যমে তিনি রমনা রেসকোর্সে উপস্থিত ১০ লাখ শ্রোতার সঙ্গে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকেও যুক্ত করলেন। তাঁর ইতিহাস বর্ণনায় জনগণের দুঃখ-বেদনার কথা আছে, আন্দোলন-সংগ্রামের কথা আছে। আছে আত্মদানের কথা। তিনি শাসকগোষ্ঠীকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, ট্যাংক-কামান-বন্দুকের চেয়ে জনগণের শক্তি বড়।

সাতই মার্চের ভাষণকে ইউনেসকোর স্বীকৃতি আমাদের আনন্দ দেয়। আবার আমাদের জাতিগত দ্বিচারিতা দেখে লজ্জিতও হই। আমি নতুন প্রজন্মের কথা বলছি না। এমনকি যাঁদের বয়স ৪০ বছরের নিচে, তাঁদেরও দ্বিচারিতার দায় থেকে রেহাই দেওয়া যায়। কিন্তু স্বাধীনতার প্রজন্মের মানুষের কাছে যে প্রশ্নটি করতে হয়, তা হলো এত দিন কোথায় ছিলেন? কী করেছেন? বঙ্গবন্ধু ভাষণটি দিয়েছিলেন ১৯৭১ সালে, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে। আর আমাদের লেখক-শিল্পী-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী-আইনজীবী, সরকারি কর্মকর্তাদের বড় অংশ হঠাৎ ভাষণের মাহাত্ম্য আবিষ্কার করলেন।

ক্ষমতায় গিয়ে যাঁরা এই ভাষণ নিষিদ্ধ করেছিলেন, রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রে প্রচার করতে দেননি, প্রধানমন্ত্রী যথার্থই তাঁদের সমালোচনা করেছেন। ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু আজ যাঁরা সরকারি আয়োজনের সুবাদে জয়ধ্বনি দিচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই সেদিন নিশ্চুপ ছিলেন। প্রতিবাদ করেননি। এমনকি ১৯৯৬ সালের আগে এ নিয়ে লেখালেখি করেছেন, এ রকম মানুষও বেশি ছিলেন না। এখন অনেকেই পঁচাত্তর-পরবর্তী পনেরো বা একুশ বছরকে কৃষ্ণপ্রহর বলে দাবি করেন। কিন্তু সেই কৃষ্ণপ্রহরে কার কী ভূমিকা ছিল, সেটাও জনগণের সামনে তুলে ধরা দরকার। সরকারের যাঁরা চাকরি করেন, তাঁরা সরকারের নীতি বাস্তবায়ন করবেন, সেটাই হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু যাঁরা লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবী ছিলেন, তাঁরা কী করেছেন?

আমাদের যত দূর মনে পড়ে, বঙ্গবন্ধু হত্যা নিয়ে প্রথম লিখেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় (যদিও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের দোহাই দিয়ে ভারত সরকার তখন সেই লেখা ছাপতে দেয়নি)। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রথম গল্প লিখেছিলেন আবুল ফজল। গল্পের নাম ‘মৃতের আত্মহত্যা’। তিনি তখন বিচারপতি সায়েম ওরফে জিয়াউর রহমান সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। এরপর কবি নির্মলেন্দু গ‌ুণ বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একুশের কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে পড়লেন সেই কবিতা: ‘আমি কারও রক্ত চাইতে আসিনি। আমি শুধু কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলতে এসেছি।’

সেই যে প্রাণের ধ্বনি উচ্চারিত হলো, ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। কবি নির্মলেন্দু গ‌ুণ জানাচ্ছেন, টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর জানাজা পড়েছিলেন যে ইমাম, তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার পরই একটি কবিতা লিখেছিলেন উর্দুতে। পরে গুণ সেটি বাংলায় অনুবাদও করেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম সংকলন বের হয়েছিল: ‘এ লাশ আমরা রাখব কোথায়’। এতে শামসুর রাহমানসহ অনেকে লিখেছিলেন, আবার আজকের বঙ্গবন্ধু ভক্তদের অনেকে লিখতে সাহস পাননি। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে যে কটি সংবাদপত্র বঙ্গবন্ধুকে সামনে নিয়ে এসেছে, তার মধ্যে অগ্রণী ছিল ‘সংবাদ’। এ ছাড়া ‘সাপ্তাহিক মুক্তির বাণী’, ‘সাপ্তাহিক খবর’ ইত্যাদি পত্রিকাও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখালেখি করেছে। তখন বঙ্গবন্ধুভক্তদের কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুবিরোধী বলে পরিচিত এবং সামরিক সরকারের সমর্থক পত্রিকায় কাজ করাকে শ্রেয় মনে করেছেন।

আমাদের একজন জনপ্রিয় লেখক ও চিত্রনির্মাতা তাঁর একটি ছবিতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ব্যবহার করেছিলেন। সে জন্য তিনি ধন্যবাদ পেতে পারেন। কিন্তু তিনি যখন সেই ছবিটির প্রিমিয়ার শো করলেন, তখন বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অংশটি বাদ দিয়েছিলেন। আমাদের দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক ও চিত্রনির্মাতাও যদি এই কাজ করেন, তার চেয়ে লজ্জার কী হতে পারে? এ কথাগুলো এ কারণে বললাম যে আবার প্রতিকূল পরিবেশ এলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি নিয়ে কথা বলার লোক পাওয়া যাবে না।

আজ কেউ আওয়ামী লীগ করতে পারেন। কেউ বিএনপি করতে পারেন। কেউ অন্য দলও করতে পারেন। কিন্তু একাত্তর, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ইত্যাদি নিয়ে কোনো বিতর্ক হওয়া উচিত নয়। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একটি গুরুতর অভিযোগ করেছেন, সাতই মার্চের ভাষণ উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশে-মিছিলে জোর করে, হুমকি দিয়ে সরকারি কর্মচারীদের, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমরা মনে করি, মার্চের ভাষণের যে ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য, তাতে এই ভাষণ শোনানোর জন্য কারও ওপর জবরদস্তির প্রয়োজন নেই। মানুষ ঘরে-বাইরে নিজের আগ্রহে এই ভাষণ শুনবে। অন্যকে শোনাবে। এই ভাষণের মাধ্যমে একাত্তরকে বোঝার চেষ্টা করবে।

বিএনপি মহাসচিব প্রশ্ন করেছেন, সেই ভাষণ শোনানোর জন্য, ভাষণ উপলক্ষে কোনো আয়োজনে মানুষকে জোর করে নিতে হবে কেন? কিন্তু এ প্রসঙ্গে তাঁকে পাল্টা প্রশ্নটি করতে পারি, ভাষণটি যদি ঐতিহাসিক ও ইউনেসকোর স্বীকৃতি পাওয়া আনন্দের হয়, তাহলে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি কেন সেই উদ্‌যাপনে যোগ দেবে না? কেন তাদের কর্মীদের এই ভাষণের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করবে না? বিএনপিতে অনেক নেতা আছেন, যাঁরা একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন। তাঁদের নিশ্চয়ই মনে আছে, দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ‘একটি জাতির জন্ম’ নিবন্ধে লিখেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ তাঁদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সবুজসংকেত বা গ্রিন সিগন্যাল মনে হয়েছিল।

বিএনপি সাতই মার্চ উদ্‌যাপন করুক। আর আওয়ামী লীগও স্বীকার করে নিক জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাঁর এই ঘোষণার স্বীকৃতি কিন্তু ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টেও আছে।

বর্তমান রাজনৈতিক বিভাজন থেকে একাত্তরকে মুক্ত রাখতে পারলে, ইতিহাসে যাঁর যেটুকু ভূমিকা আছে স্বীকার করলে অনেক বিতর্কেরই অবসান হতে পারে।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক