যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সাথে শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিদবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনুসের আদান-প্রদানকৃত প্রায় সাত হাজার ই-মেইল প্রকাশ করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর। এরমধ্যে তিনশোরও বেশি ই-মেইলে আসে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ। ওই ই-মেইলগুলোর বরাতে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলো তুলে এনেছে ড. ইউনূসের সঙ্গে সরকারের টানাপোড়েন প্রসঙ্গ। অনলাইন সংবাদমাধ্যম বিডিনিউজ টুয়েন্টি ফোর জানায়, ইউনূসের ই-মেইলগুলোর প্রেক্ষিতে হিলারি কী জবাব দিয়েছেন তা গোপন রাখা হয়েছে বলে জানায় সংবাদমাধ্যমটি।
এদিকে জাতীয় দৈনিক সমকালের প্রতিবেদনে বলা হয়, ড. ইউনূস মেইলগুলো নিজে লিখেছিলেন। তবে কিছু মেইল পাঠিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের তৎকালিন কর্মকর্তা মেলানি ভারবিসের কাছে। পরে সেগুলো হিলারির অ্যাকাউন্টে পাঠানো (ফরোয়ার্ড) হয়। এসবের জবাব দিয়েছেন হিলারি। কিছু ক্ষেত্রে যে আইডি থেকে মেইল পাঠানো হয়েছে, সেগুলো মুছে দেওয়া হয়েছে। তবে বিভিন্ন মেইলে উল্লেখ আছে, ড. ইউনূসের পক্ষ থেকে পাঠানো হয়েছে এবং তা গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কিত। আবার প্রকাশিত মেইলের অনেকগুলোতে হিলারির জবাব মুছে দেওয়া হয়েছে। শ্রেণীভুক্ত নথি হিসেবে বিবেচিত বলে ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে এসব বক্তব্য প্রকাশ করা হবে না বলে জানায় মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর।
বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী হিলারির মেইলে বাংলাদেশের কোন কোন প্রসঙ্গ উঠে এসেছে তা এমটি নিউজের পাঠকের জন্য তুলে ধরা হল-
১। সরকারের সঙ্গে টানাপোড়েন নিরসনের প্রসঙ্গ:
ওই মেইলগুলোর বরাতে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলো জানায়, গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সরকারের সঙ্গে টানাপোড়েন নিরসনে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সহায়তা চেয়েছিলেন ব্যাংকটির পদচ্যুত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গ্রামীণ ব্যাংক প্রশ্নে বাংলাদেশ সরকারকে প্রভাবিত করতে হিলারির কাছে বারংবার তদবির করেছেন তিনি ।
বিডি নিউজ টোয়েন্টি ফোরের তথ্য অনুযায়ী ২০০৯ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর পাঠানো একটি মেইলে ইউনূস লিখেছেন, ‘ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের পরামর্শে আমি আমাদের সমস্যা সম্পর্কে জানাতে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাত্ চেয়েছি। কিন্তু ছয় সপ্তাহ ধরে কোনো সাড়া নেই। আমি প্রেসিডেন্টের স্বাধীনতা পদক (প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম) পাওয়ায় বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সবাই আমাকে শুভেচ্ছা জানালেও প্রধানমন্ত্রী এবং তার দলের পক্ষ থেকে টুঁ শব্দও করা হয়নি। সুতরাং দেখতেই পাচ্ছেন সমস্যা কতটা জটিল রূপ নিয়েছে। আমার মনে হয় আমি এ ব্যাপারে আপনাকে ধারণা দিতে এবং কী করতে হবে তা সম্পর্কে ধারণা দিতে পারব।’ সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ। এইচকে (হিলারি) শুভেচ্ছা দেবেন। শিগগিরই দেখা হবে।- ইউনূস।
২। গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে আলোচনার অনুরোধ
তত্কালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে এবং জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে শেখ হাসিনার অংশগ্রহণের ফাঁকে হিলারির সঙ্গে বৈঠক ছিলো। সেই দুই বৈঠকে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে আলোচনার অনুরোধ জানিয়ে ইউনূসের পক্ষ থেকে পাঠানো ওই মেইলে লেখা হয়েছে,
‘প্রিয় মেলানি, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভায় যোগ দিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ওয়াজেদের আমেরিকা সফর নিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি ১৬ সেপ্টেম্বর হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে সাক্ষাত্ করবেন। সে সময় বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে গ্রামীণ ব্যাংক ইস্যু নিয়ে আলোচনার অনুরোধ রইল।’
ই-মেইলে উদ্ধৃত হয়েছে ইউনূসকে নিয়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর
ওই বছরের ১৭ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্তব্য উদ্ধৃত করে প্রকাশিত খবরের প্রসঙ্গ টানা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে,
‘বাংলাদেশের একটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিকে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন বিষয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সব সংবাদপত্রই একই ধরনের সংবাদ ছেপেছে। এটি প্রধানমন্ত্রী হাসিনার জাতীয় সংসদে দেয়া বক্তব্যের ওপর। আমার নাম উল্লেখ করা না হলেও প্রতিবেদনের উল্লেখযোগ্য অংশ আমাকে নিয়েই।
৩। ‘প্রধানমন্ত্রী-ইউনূস বিরোধ’র ক্ষেত্রে হিলারিকে শান্তির দূত হওয়ার আহ্বান
বিডি নিউজ টোয়েন্টি ফোর জানায়, সরকারের সঙ্গে টানাপোড়েনের বিষয়টি উল্লেখ করে হিলারিকে শান্তির দূত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন ইউনূস। ই-মেইলে তিনি লিখেছেন- ‘সম্ভব হলে আমার সম্পর্কে তার ভয়ঙ্কর মনোভাব দূর করার উপায় বের করুন। আমি আপনাকে শান্তির দূত হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। তা না হলে এটা ভয়াবহ রূপ নেবে। প্রধানমন্ত্রী হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় যোগ দিতে নিউইয়র্কে আসবেন এবং তখন সম্ভবত সেক্রেটারি এইচ (হিলারি) এর সঙ্গে তার দেখা হবে।’ ‘ইউনূস ও হাসিনার চলমান বিরোধ’ শিরোনাম দিয়ে মেলানি হিলারিকে মেইলটি ফরোয়ার্ড করেন ।
৪। রাজনীতিতে তার আগ্রহ নেই বলে বোঝাতে চেয়েছেন ইউনূস
ইউনূসের মেইলের প্রেক্ষিতে হিলারিকে পাঠানো একটি মেইলে মেলানি জানিয়েছেন ড. ইউনূসের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর আলোচনায় অগ্রগতি খুবই খারাপ। তিনি লিখেছেন, ‘উনি (ড. ইউনূস)আশা করছেন, উনার যে রাজনীতিতে কোনো আগ্রহ নেই, সে ব্যাপারে তাকে (প্রধানমন্ত্রী) আশ্বস্ত করার পথ পাওয়া যাবে এবং প্রধানমন্ত্রী গ্রামীণের মতো তাকেও দেশগড়ার কাজে লাগাতে পারবেন। এখানে ব্যক্তিগত বিরোধিতার যে গভীরতা আছে তা উনি (ইউনূস) পরিমাপ করতে পারছেন না। অগ্রগতি খুবই খারাপ।’
আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট দলের হয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাশী হিলারি। তবে হিলারি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন বিধিবহির্ভাবে ব্যক্তিগত ই-মেইল সার্ভার ব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। এমন প্রেক্ষাপটে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত হিলারি ক্লিনটন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার সময় ব্যক্তিগত কম্পিউটার সার্ভিসকে তিনি কী কী কাজে ব্যবহার করেছেন সে বিষয়ে তদন্তের অংশ হিসেবেই ই-মেইলগুলো প্রকাশ করা হয়।-বিডি নিউজ ও সমকাল।