আওয়ামী লীগের দুর্গ এ আসনে বিএনপি তাদের মাঠ সাজাতে হিমশিম খাচ্ছে

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সিরাজগঞ্জের উত্তর জনপদের যমুনা নদী বেষ্টিত গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় আসন কাজীপুর উপজেলা। এই উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন, ১টি পৌরসভা এবং সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার ৪টি ইউনিয়ন নিয়ে সিরাজগঞ্জ-১ সংসদীয় আসন গঠিত। এ আসনে রয়েছে আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র আধিপত্য। স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি এ আসনে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দল নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারেনি। তবে ব্যাপক ভোটের ব্যবধানে প্রতিবারের বিজয়ী আওয়ামী লীগকে এবারের নির্বাচনে ভোটযুদ্ধ করেই বিজয় নিশ্চিত করতে হবে বলে বিএনপির ধারণা। অন্যদিকে মহাজোটের শরিক দল জাসদও এ আসনে এবার প্রার্থী দিতে প্রস্তুত।

আওয়ামী লীগ: জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত সহচর শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর জন্মস্থান সিরাজগঞ্জ-১ (কাজীপুর) আসনে। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার যেমন অসামান্য অবদান রয়েছে তার তেমনি যতদিন তিনি বেঁচেছিলেন ততদিন কাজীপুর মানুষের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের হয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তিনি বিজয়ী হয়ে প্রাদেশিক পরিষদের মন্ত্রী হন। এ সময় তার জন্মস্থান রতনকান্দি ইউনিয়ন কাজীপুর আসনের অন্তর্ভুক্ত থাকায় তিনি এ অঞ্চলের রাজনীতির সঙ্গে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন।’

৭০-এর নির্বাচনে তিনি প্রাদেশিক পরিষদের প্রতিনিধি হিসেবে মনোনয়ন পান। মহান মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হওয়ায় তিনি কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন তার গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কারণে তিনি কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি বিপ্লবী সরকারের অর্থমন্ত্রী এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের যোগাযোগমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের উন্নয়নের পাশাপাশি তিনি নিজ এলাকার উন্নয়নে তার ব্যক্তিগত ভূমিকার কারণে এখনো এলাকাবাসীর কাছে স্মরণীয়। সে সময় তিনি এই অঞ্চলবাসীর জন্য চাকরি, দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসন, নদীভাঙন রোধে ব্যবস্থা নেয়ায় কাজীপুরবাসীর অন্তরে ঠাঁই করে নেন। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র মোহাম্মদ নাসিমকে এ অঞ্চলের মানুষ তার পিতার স্থানে বসিয়েছেন।

এ অঞ্চলে মনসুর পরিবারই আওয়ামী লীগের হয়ে এ আসন থেকে নির্বাচন করে আসছেন। ১৯৯৬ সালে এ আসন থেকে মোহাম্মদ নাসিমের বড় ভাই উপনির্বাচন করে বিজয়ী হন। এরপর ২০০১ ও ২০১৪ সালে মোহাম্মদ নাসিম এ আসন থেকে নির্বাচন করে বিজয়ী হন। ২০০৮ সালে মোহাম্মদ নাসিমের মামলা জটিলতার কারণে তার পুত্র প্রকৌশলী তানভীর শাকিল জয় নির্বাচিত হন। এ অঞ্চলের রাজনীতিতে মোহাম্মদ নাসিমের শক্ত অবস্থান রয়েছে। এ আসনের ইউনিয়ন থেকে মহল্লা পর্যন্ত আওয়ামী রাজনীতিতে তার একক আধিপত্য রয়েছে। এক কথায় কাজীপুরের আওয়ামী রাজনীতির শেষ শব্দ মোহাম্মদ নাসিম।

তবে উপজেলায় রাজনীতিতে নেতৃত্ব নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে কোন্দল রয়েছে। কোন্দলের জেরে এক পক্ষের দ্বারা অপর পক্ষকে লাঞ্ছিত করার ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু মোহাম্মদ নাসিম ও তার পুত্র জয় শক্ত হাতেই তা মোকাবিলা করেছেন। মোহাম্মদ নাসিম ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এ আসনে নির্বাচিত হয়ে বর্তমান সরকারে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে আছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হয়ে কাজীপুরকে নতুনভাবে সজ্জিত করছেন তিনি। স্বাস্থ্য বিভাগ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পাশাপাশি এ এলাকার মানুষের দুঃখ লাঘবে নদী ভাঙনরোধে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন ও তা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। যমুনা নদীর প্রত্যন্ত ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে এখন লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। পাকা সড়ক, বৈদ্যুতিক লাইন, সৌরবিদ্যুৎ, স্কুল-কলেজের স্থায়ী ভবনসহ চরাঞ্চলবাসীর ব্যবহারিক জীবনে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। প্রতি সপ্তাহে তিনি এলাকায় আসেন এবং নেতাকর্মীদের নিয়ে রাজনৈতিক ও সরকারি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছেন। এরই মধ্যে সরকারের উন্নয়নের প্রচারণা চালিয়ে ও নির্বাচনীয় এলাকায় মানুষের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে আগামী নির্বাচনের নিজের প্রার্থিতার প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। নেতৃত্বকে আরো শক্তিশালী করতে তার পুত্র তানভীর শাকিল জয় এ অঞ্চলের রাজনীতিতে সক্রিয় থেকে তার বাবার পাশে থেকে কাজ করে আসছেন।

বিএনপি: সিরাজগঞ্জ ১ আসনে আওয়ামী লীগের দুর্গ ভাঙতে এ আসনে বিএনপি তাদের মাঠ সাজাতে এবারো হিমশিম খাচ্ছে। এ আসনে বিএনপির রাজনীতি আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। জাতীয় ও অঞ্চলিক আন্দোলন ও সংগ্রামে এ অঞ্চলে বিএনপি নজির রাখতে পারেনি। উপজেলা বিএনপির প্রথম সারির নেতাদের অনুপস্থিতি দলের নেতাকর্মীদের হামলা ও মামলায় জর্জরিত থাকায় এখানে বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো খুবই দুর্বল। তবে জেলা বিএনপির কমিটি ঘোষণার পর এ অঞ্চলে বিএনপির নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হয়েছেন। স্থানীয় উপজেলার নেতাকর্মীদের দাবি ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক আগ্রাসন মনোভাবের কারণে কোনো প্রকার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত করতে পারছেন না।

সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি নাজমুল হাসান তালুকদার রানা জানান, আগামী নির্বাচনকে ঘিরে দলে নতুন কর্মী সংগ্রহ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে স্থানীয়ভাবে দলীয় কার্যক্রম চলছে এখানে। ছাত্র রাজনীতিতে জেলা ছাত্রদলের নেতৃত্বসহ টানা ৩ বার জেলা সদরের পৌর বিএনপির সভাপতির দায়িত্ব পালনকারী নাজমুল হাসান সব আন্দোলন ও সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকাসহ বারবার কারা নির্যাতিত হওয়ায় জেলা বিএনপিতে রয়েছে বাড়তি ইমেজ। জেলা বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার পাশাপাশি তার গ্রামের বাড়ি কাজীপুর হওয়ায় এ অঞ্চলের রাজনীতিতে তার সম্পৃক্ততা রয়েছে। ওয়ান-ইলেভেনের পর এ আসনের বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা পূর্বের থেকে আরো নাজুক হয়ে পড়ে। দীর্ঘ সময় এ আসনে বিএনপির রাজনৈতিক চর্চা বন্ধ থাকলেও নবগঠিত জেলা বিএনপির কমিটি ঘোষণার পর এখন দলের প্রবীণ ও নবীনরা সংগঠিত হচ্ছেন। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ দলীয় কার্যালয়ে রাজনৈতিক কার্যক্রমে বাধার থাকার কারণে চায়ের দোকান, বাজার ও সামাজিক আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আগামী নির্বাচনে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।

নাজমুল ইসলাম রানা তালুকদার জানান, বিগত সময়ে একবার এই আসনের জন্য মনোনয়ন চাইলেও সেবার দল তাকে মনোনয়ন দেয়নি। কিন্তু এবার তিনি দলের আস্থা তৈরির জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বিশ্বাস করেন দল তাকে মনোনয়ন দিলে এবার ভোটাররা তার প্রতি আকৃষ্ট হবে এবং সে লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছেন। এই আসনটিতে আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র অধিপত্য এবং আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থী থাকার কারণে বিএনপির অনেক নেতাকর্মীর ধারণা আসনটিকে দখল পেতে প্রার্থী নির্বাচনে আনতে হবে বৈচিত্র্যতা। যা সাধারণ ভোটারদের মনোযোগ করবে। এরই ধারাবাহিকতায় গুঞ্জন রয়েছে প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী কনক চাঁপাকে এই আসনে বিএনটির প্রার্থী হিসেবে দেখা যেতে পারে। কনক চাঁপার জš§স্থান এই উপজেলায় হওয়ায় এ গুঞ্জন এখন ডালপালা মেলছে। যদিও ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে এই আসনে জনপ্রিয় শিল্পী কনক চাঁপার নাম শোনা গেলেও তাকে কখনোই এলাকায় রাজনৈতিক কোনো কর্মকাণ্ডে দেখা যায়নি। এছাড়া এক সময়ের উদ্যমী ছাত্রনেতা সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও বর্তমান জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি অধ্যাপক মো. রহমতুল্লাহ আইয়ুব এই আসনে দল থেকে মনোনয়ন চাইবেন।

তিনি জানান, তার জন্মস্থান কাজীপুর হওয়ায় এলাকায় রয়েছে তার ব্যাপক পরিচিতি। এ ছাড়া তার বিগত সময়ের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণেও দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে রয়েছে তার রাড়তি গ্রহণযোগ্যতা যা ভোটযুদ্ধে সহায়ক হবে। এ ছাড়া জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি মকবুল হোসেন চৌধুরীর নামও সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায় রয়েছে। তার বাড়ি সদর উপজেলার হলেও সদর উপজেলার যে ৪টি ইউনিয়ন কাজীপুর আসনে অন্তর্ভুক্ত সেই অঞ্চলেই তার বাড়ি। তার মতে ভোটার আধিক্য এই ৪টি ইউনিয়নে তার রয়েছে ব্যাপক পরিচিতি। এ ছাড়া কাজীপুরেও তার জনপ্রিয়তা রয়েছে।

অপরদিকে উপজেলা বিএনপির অনেক পুরনো কমিটির সভাপতি হিসেবে রয়েছেন সেলিম রেজা। দীর্ঘদিন সাংগঠনিক কাজে তিনি সক্রিয় না থাকলেও, আগামী সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকায় রয়েছেন। বিগত সময়ে নেতাকর্মীদের দুঃসময়ে তিনি পুরোটা সময় ঢাকায় অবস্থান করা ও দলীয় কাজে অংশগ্রহণ না করায় দলের নেতাকর্মীদের ক্ষোভ রয়েছে। তবে অনেকেই মনে করেন সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের আচরণ ও হামলা মামলার ভয়ের কারণে বিগত সময়ে তিনি এলাকায় আসতে পারেননি।

বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকায় আরো রয়েছেন জেলা বিএনপির সদস্য, শহর বিএনপির সহ-সভাপতি টিএম তহজিবুল এনাম তুষার ওরফে তুষার তালুকদার।

জাসদ: সিরাজগঞ্জ জেলা জাসদের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই তালুকদারের বাড়ি এ আসনের বাগবাটী ইউনিয়নে। মহাজোটের শরিক দল জাসদের একগুচ্ছ সমর্থক রয়েছে এ আসনে। আগামী নির্বাচনে মহাজোটের হয়ে এ আসনে জাসদ তাদের প্রার্থী চাইবেন। এরই মধ্যে এ অঞ্চলে যাতায়াত থেকে শুরু করে সামাজিক অনুষ্ঠান ও নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়ও করে আসছেন তিনি।

জাতীয় পর্টি: মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি থেকে আব্দুল মোমিন সমাজবাদী নিজ দল থেকে মনোনয়ন চাইবেন। ১৯৮৭ সাল থেকে জাতীয় পার্টির কাজীপুর উপজেলা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। পাশাপাশি তিনি কাজীপুরের গান্ধাইল আইডিয়াল কলেজে শিক্ষকতা করেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে তিনি মনোনয়নপত্র জমা দিলেও পরে প্রত্যাহার করে নেন। তিনি দলীয় মনোনয়ন পাবেন বলে তার বিশ্বাস।

মানবকণ্ঠ

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর