হাওর বার্তা ডেস্কঃ পুলিশের গাড়িচালক কনস্টেবল বদরুল হাসান তালুকদার ওরফে বাচ্চু। মাসে তাঁর বেতন ১৫ হাজার টাকার মতো।
অথচ ঢাকা, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় নামে-বেনামে কয়েক কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে তাঁর। বদরুলের দুর্নীতির তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
কনস্টেবল বদরুলের বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার মাইজহাটি গ্রামে। চাকরি দেওয়ার নামে তিনি এলাকার অনেক লোকের কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তা ছাড়া তাঁর লোকজনের হামলা-মামলার শিকার হয়েছে বহু লোকজন। এলাকার এসব অভিযোগের ব্যাপারে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে স্থানীয় পুলিশ।
কনস্টেবল বদরুল দীর্ঘদিন পুলিশ সদর দপ্তরে চাকরি করেছেন। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি (রেঞ্জ আবেদন নম্বর ২২৮, স্মারক-৯৬৭/১(২)) বদরুল শেরপুর থেকে নারায়ণগঞ্জে বদলি হন। তবে এখনো তিনি নতুন কর্মস্থলে যোগ দেননি বলে জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের মোটরযান বিভাগের ইনচার্জ (এমটি) ইন্সপেক্টর মো. আজিজুল হক।
চিকিৎসা ছুটি নিয়ে কনস্টেবল বদরুল চাকরির বেশির ভাগ সময় ঢাকায় অবস্থান করেন বলে জানা গেছে।
দুদকের তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, দুই স্ত্রী এবং পাঁচ ছেলে-মেয়ে নিয়ে ঢাকায়ই থাকেন কনস্টেবল বদরুল। তাঁর এক ছেলে ঢাকার ব্যয়বহুল একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং এক মেয়ে আরেকটি ব্যয়বহুল বেসরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ছে। এই দুই ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা বাবদই খরচ হয় প্রতি মাসে প্রায় এক লাখ টাকা।
এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বদরুলের বাবা মৃত তাজ উদ্দিন ছিলেন বোকাইনগর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক সদস্য। অষ্টম শ্রেণির যোগ্যতায় ১৯৮৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর পুলিশের চাকরিতে যোগ দেন বদরুল। এর পর থেকে তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
বদরুলের যত সম্পদ : রাজধানীর শাহীনবাগের নাভানা টাওয়ারে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে বদরুলের। ৭৫ লাখ টাকার এইচ ইউনিটের ফ্ল্যাটটি তাঁর প্রথম স্ত্রীর নামে। এক ছেলে ও তিন মেয়ে নিয়ে প্রথম স্ত্রী সেখানে থাকেন।
তবে রাজধানীর কল্যাণপুরে ৫৪/এ নম্বর হোল্ডিংয়ের এ/২ ফ্ল্যাটটি নিজের নামেই কিনেছেন বদরুল। এর দাম আনুমানিক ৫৫ লাখ টাকা। এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে বদরুলের দ্বিতীয় স্ত্রী থাকেন এখানে।
তা ছাড়া আনন্দ পুলিশ পরিবার কল্যাণ সমবায় সমিতির অংশীদার হিসেবে ঢাকার ডেমরায় পরশমণি পশ্চিম টেংরায় বদরুলের ছয় কাঠার একটি আবাসিক প্লট রয়েছে। উত্তরার আজমপুরে ৭৫ লাখ টাকায় একটি দোকানের পজেশন কেনা রয়েছে তাঁর।
গাজীপুরের টঙ্গীতে ১০ কাঠা জমি কেনার পাশাপাশি প্রথম স্ত্রীর গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরে বাড়ি ও জমি কিনেছেন বদরুল।
বদরুলের দুই স্ত্রী ও সন্তানদের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে স্থায়ী আমানতসহ (এফডিআর) বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা রয়েছে বলেও জানা গেছে। তা ছাড়া মালেক স্পিনিং, আইএফআইসি ব্যাংক, বিকন গ্রুপসহ কয়েক কম্পানির শেয়ারও রয়েছে তাঁর।
এদিকে নিজ এলাকা গৌরীপুরের মাইজহাটির বিভিন্ন মৌজায় ১ হাজার ৫৫০ শতক জমি কিনেছেন বদরুল; যার আনুমানিক দাম প্রায় পাঁচ কোটি টাকা।
যেসব মৌজায় জমি কিনেছেন বদরুল—ভাট্টার ছিদ্দিকের কাছ থেকে ১৩৮ শতাংশ, সোহরাবের কাছ থেকে ৭০, সোলায়মানের কাছ থেকে ৩০, আব্দুল আজিজ-হাবিবুর রহমানের কাছ থেকে ১৪০ এবং আব্দুর রশিদের কাছ থেকে ৪০ শতাংশ।
মাইজহাটি মৌজার আজিজুর রহমান-হাবিবুর রহমানের কাছ থেকে ১০০ শতাংশ, আরজুত খাঁর কাছ থেকে ৪০, মনোয়ার হোসেনের কাছ থেকে ৫০, আবাল হোসেনের কাছ থেকে ৬০, এম ওবায়দুল্লার কাছ থেকে দশমিক ৫০, আলাল উদ্দিনের কাছ থেকে ৬০, মো. বাবর আলীর কাছ থেকে ৪০, নুরুল ইসলামের কাছ থেকে ৪০, রুস্তম খাঁর কাছ থেকে ৩০, হরিপদ মজুমদারের কাছ থেকে ৮০ শতাংশ জমি।
কুল্লা মৌজার আব্দুল লতিফের কাছ থেকে ৫০ শতাংশ, নায়েবের কাছ থেকে ২০, হাবিবুর রহমানের কাছ থেকে ৪০, ইছব আলীর কাছ থেকে ৫০, মোস্তাকিম মেম্বারের কাছ থেকে ৭০, জালাল উদ্দিনের কাছ থেকে ৩০ এবং সাবালির কাছ থেকে ৫০ শতাংশ জমি।
তা ছাড়া মাইজহাটি বাজারে তালুকদার এন্টারপ্রাইজ নামে একটি মত্স্য ও পশুখাদ্যের প্রতিষ্ঠান রয়েছে বদরুলের। বাড়ির পাশে রয়েছে বিমাল মত্স্য খামার; যা আনুমানিক প্রায় ৩০ লাখ টাকার সম্পদ।
এলাকায় চারতলা ফাউন্ডেশন দিয়ে বিশাল বাড়ি করছেন বদরুল। প্রায় অর্ধকোটি টাকা ব্যয়ে এরই মধ্যে একতলার কাজ শেষ হয়েছে। অতিথিদের জন্য পাঁচ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি আধাপাকা ঘরও নির্মাণ শেষ করেছেন। দুটি ঘরের জন্য প্রায় ৫০ লাখ টাকার আসবাব কিনেছেন তিনি।
বদরুলের চাকরি : বদরুল দীর্ঘদিন পুলিশ সদর দপ্তরে চাকরি করেন। সেখানে চাকরিকালে তদবির বাণিজ্যের মাধ্যমে বিশাল অর্থসম্পদের মালিক হন তিনি। এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হওয়া ছাড়াও বিভিন্ন সময় অভিযোগ ওঠায় ২০১১ সালে বরিশালে বদলি করা হয় তাঁকে। কিছু দিন যেতে না যেতেই ফের পুলিশ সদর দপ্তরে চলে আসেন। পরে তাঁকে বদলি করা হয় শেরপুর জেলায়। সেখানে যোগদান না করে দীর্ঘদিন চিকিৎসা ছুটি নিয়ে এলাকায় ও ঢাকায় সময় ব্যয় করেন। তবে বর্তমানে অফিশিয়াল কাগজপত্র অনুযায়ী তাঁর কর্মস্থল নারায়ণগঞ্জ জেলায় হলেও সেখানে তিনি কর্মরত নেই।
অভিযোগের তদন্ত : বিভিন্ন অভিযোগ ঘেঁটে, তথ্যানুসন্ধান ও এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, বদরুলের অবৈধ সম্পদ ও অর্থের উৎসসহ বিভিন্ন অপকর্ম নিয়ে গত ১৪ জুন একটি লিখিত অভিযোগ জমা পড়ে দুদকে। কমিশনের সহকারী পরিচালক ফজলুল বারী তদন্তের দায়িত্ব পান। নথি নম্বর-দুদক অনু ও তদন্ত-১/ময়মনসিংহ/২০১৬।
ওই অভিযোগের তদন্তকালেই গত ২২ সেপ্টেম্বর আরেকটি লিখিত অভিযোগ জমা পড়ে বদরুলের বিরুদ্ধে। দুটি অভিযোগেরই তদন্ত চলছে এখন।
আনুষ্ঠানিক অভিযোগ : বিভিন্ন দপ্তরে ৯টি লিখিত অভিযোগ, দুটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) এবং দুটি মামলার তদন্ত চলছে বদরুলের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে ২০১৬ সালের ২ অক্টোবর স্বরাষ্ট্রসচিব, ১৬ অক্টোবর পুলিশের মহাপরিদর্শক বরাবর এবং ২০১৬ সালের ৮ আগস্ট, ৪ অক্টোবর ও ২০১৭ সালের ১১ জানুয়ারি, ১৯ মার্চ ও সর্বশেষ ১১ অক্টোবর মোট পাঁচবার ময়মনসিংহ ডিআইজি বরাবর লিখিত অভিযোগ হয়েছে বদরুলের বিরুদ্ধে।
ময়মনসিংহের পুলিশ সুপারের কাছে ২০১৬ সালের ৪ অক্টোবর ও ২০১৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়া হয়। জেলা প্রশাসক বরাবর দেওয়া হয়েছে ২০১৬ সালের ১২ ডিসেম্বর। ঢাকায় মানবাধিকার কমিশন বরাবর দেওয়া হয়েছে ২০১৭ সালের ১৮ এপ্রিল। দুদককে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে ২০১৬ সালের ১৪ জুন ও ২২ সেপ্টম্বর এবং চলতি বছরের ২১ আগস্ট। এ ছাড়া কর কমিশন দপ্তরে ৩১ অক্টোবর ও ভূমিসচিব বরাবর ২৫ সেপ্টেম্বর অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।
প্রভাব খাটিয়ে অপকর্ম : ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মীগঞ্জ কাঁঠাল এলাকার যুবলীগ নেতা মো. শফিকুল ইসলাম রতনের ছেলে কনককে কনস্টেবলে চাকরি দেওয়ার কথা বলে সাত লাখ টাকা নিলেও চাকরি দিতে পারেননি বদরুল। টাকাও দেননি।
বদরুলের নিজ এলাকায় বসবাসকারী রাজকুমারের জমি জোরপূর্বক গত বছরের ২৬ আগস্ট দখল করে নেন বদরুল। প্রতিবাদ করলে বদরুলের লোকজন রাজকুমারের প্রাণনাশের হুমকি দেয়।
অভিযুক্ত বদরুলের বক্তব্য : অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে বদরুল মোবাইল ফোনে হাওর বার্তাকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ মোট ৪৩টি মিথ্যা বানোয়াট অভিযোগ করেছে। সব প্রতিহিংসার শিকার হয়ে করেছে। ’
তিনি বলেন, ‘অবৈধ উপায়ে আমি কোনো সম্পদের মালিক হইনি, জ্ঞাত আয়বহির্ভূত কোনো অর্থ আমার নেই। এলাকায় আমার নামে ২০-২৫ কাঠা সম্পত্তি রয়েছে। এত বছর চাকরি করেও কি এলাকায় এই পরিমাণের সম্পত্তি কেনা যাবে না?’
তিনি দাবি করেন, ‘আমার স্ত্রীর নামে মাছের খামার রয়েছে এলাকায়। সব মিলিয়ে বাড়িতে ধান চাষের জমি ও পুকুর ছাড়া দেশের কোথাও কোনো সহায়-সম্পদ নেই। ’
বর্তমান কর্মস্থল কোথায় জানতে চাইলে বদরুল বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ। তবে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হওয়ায় বর্তমানে পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি আছি। সেখানেই আমার চিকিৎসা চলছে। ’
এত দিনেও কর্মস্থলে যোগ দেননি কেন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘এটা ডিপার্টমেন্টের ব্যাপার। তারাই বুঝবে। তা ছাড়া আমি চিকিৎসা নিচ্ছি পুলিশ হাসপাতালে, সেটা তো আমাদেরই। বাহিরে তো চিকিৎসা নিচ্ছি না। ’
হিন্দু পরিবারের জমি দখল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই জমি আমি ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক হরপদ মজুমদার ওরফে গোপাল মাস্টারের কাছ থেকে কিনেছি। ’
গত সোমবার দুপুর ১২টার দিকে যখন বদরুলের সঙ্গে কথা হচ্ছিল তখন কোথায় আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঢাকায়, প্রেস ক্লাবে বসে আছি। ’ ওই সময় তিনি বেশ কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিক ও সাংবাদিক নেতাদের নাম উল্লেখ করে এ প্রতিনিধি কথা বলবেন কি না জানতে চান। তিনি এ-ও বলেন, ‘অনেক সিনিয়র সাংবাদিক আমার বন্ধু। ’ একপর্যায়ে বলেন, ‘অনেকেই তো আমাকে নিয়ে লিখেছেন, এখন না লিখলে হয় না। এলাকায় আসলে আপনার সঙ্গে দেখা হবে। ’
তদন্তকারী কর্মকর্তাদের বক্তব্য : বদরুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করে দুদকের সহকারী পরিচালক ফজলুল বারী হাওর বার্তাকে বলেন, ‘তদন্ত কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে আছে। যেকোনো সময় প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। ’
আরেকটি মামলা তদন্ত করছে ময়মনসিংহ পিবিআইয়ের উপপরিদর্শক মো. নজরুল ইসলাম। তিনিও তদন্ত কার্যক্রম চালাচ্ছেন বলে জানান।
কালের কণ্ঠ