হজ-পরবর্তী জীবন কেন পাপমুক্ত হয় না

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আমাদের সমাজে একটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে যে, হাজী মানেই সাচ্চা-পাক্কা ঈমানদার খাঁটি একজন মানুষ। হাজী মানেই নিষ্কলুষ, নির্ভেজাল, নিষ্পাপ একজন কামেল ইনসান। এ ধারণা আর সুপ্রত্যাশার কারণেই হাজী কোনো অসংগত কাজকর্মে জড়িয়ে পড়লে মানুষ তাকে একহাত নেয়, নেহাত বাজে রকমের ভর্ৎসনা করে, এমনকি অন্যতম ভিত্তিমূল হজকেই দোষারোপ করতে শুরু করে কেউ কেউ।

এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে বড় কথা হলো, হাজীকে যে মানুষ নিষ্পাপ ভাবে, এই ভাবনাটা এমনি এমনি আসেনি মানুষের ভেতর; বরং এটি হাদিস থেকে আহরিত ও প্রাপ্ত ধারণা। এরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি হজ করল আর যৌনতা বা নিষিদ্ধ (হজ মৌসুমে) কোনো গোনাহের কাজে জড়িত হলো না, সে হজ থেকে নবজাতক শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে বাড়ি ফেরে।’ (বোখারি : ১৫২১)। এছাড়া সূরা বাকারার ১৯৭নং আয়াতেও একই কথা বলা হয়েছে, রাব্বুল আলামিন ঘোষণা করেছেন, ‘যে ব্যক্তি হজের মৌসুমে হজ করার নিয়ত করে অর্থাৎ ইহরাম বেঁধে ফেলে, তার জন্য যৌনকার্য, অশোভন কাজ ও ঝগড়াবিবাদ জায়েজ নেই।’
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, হাজীর হজ পরিপূর্ণ ত্রুটিমুক্ত হলেই তিনি পাপমুক্ত হবেন। সুতরাং যেমন সব হাজীর হজ ত্রুটিমুক্ত নয়, তেমনি সব হাজীর হজ-পরবর্তী জীবনও ত্রুটিমুক্ত হয় না।
দ্বিতীয়ত, প্রত্যক মানুষ তার আমলের ইহকালীন ও পরকালীন ফায়দা তখনই পাবে, যখন সংশ্লিষ্ট আমলের জন্য তার নিয়ত বিশুদ্ধ হবে। সুতরাং শুধু আল্লাহর হুকুম পালন ও তাঁকে সন্তুষ্ট করার নিয়ত ছাড়া যে হজ হবে, সে হজÑ নিয়তে গলদ থাকার কারণে হাজীকে ধারাবাহিক পুণ্যবান হতে সাহায্য করবে না। এরশাদ হয়েছে, ‘প্রত্যেক আমলই নিয়তের ওপর নির্ভরশীল।’ (বোখারি, খ–১, পৃ. ১)। শুধু হজই নয়, সব আমলকে আল্লাহ তায়ালা বিশুদ্ধ নিয়তে সম্পাদন করার নির্দেশ দিয়েছেন। এরশাদ হয়েছে, ‘মানুষকে শুধু খালেস আল্লাহর জন্যই বিশুদ্ধ নিয়তে ইবাদত করার হুকুম দেয়া হয়েছে।’ (সূরা বাইয়িনাহ : ৫)।
তৃতীয়ত, অনেকেই হাজীদের দোষারোপ করতে গিয়ে পুরো হজের বিধানটাকেই খাটো করা শুরু করে দেন, এটা নিছক অজ্ঞতা থেকেই মানুষ করে। কারণ কোনো একজন মানুষের ব্যক্তিগত কাজকর্ম বা নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষের কর্মকা-ের কারণে একটা খোদায়ি বিধানকে খাটো করা অযৌক্তিক।
চতুর্থত, নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাত সব ইবাদতই ফরজ। আর সব ফরজ ইবাদত পালন করার দাবি হলো গোনাহমুক্ত হয়ে যাওয়া। শুধু হজের পরে গোনাহমুক্ত হতে হবে বিষয়টা এমন নয়। নামাজের ব্যাপারে তো সরাসরি কোরআনে ঘোষিত হয়েছে, ‘নামাজ যাবতীয় মন্দ ও গর্হিত কাজ থেকে নামাজিকে বাঁচিয়ে রাখে।’ (সূরা আনকাবুত : ৪৪)। তারপরও তো আমরা অনেক পাক্কা নামাজিকে পাপকর্মে লিপ্ত দেখি। এখানেও ওই একই কারণ, নামাজিকে তার নামাজ তখনই যাবতীয় নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত রাখবে, যখন তার নামাজ ইসলামী শরিয়ত কর্তৃক আরোপিত সব শর্ত ঠিক রেখে, খালেস নিয়তে পড়া হবে। কেউ অসম্পূর্ণ নামাজ পড়ে যদি অবৈধ কাজকর্ম থেকে বিরত থাকতে না পারে, আর নামাজকে দোষ দেয়, তাহলে সে অযৌক্তিক ও অবাস্তব বিষয়ের চর্চা করে। তেমনি কেউ হারাম মাল দ্বারা বা পাপযুক্ত অথবা লোক-দেখানোর নিয়তে হজ করলে সে ধারাবাহিক পুণ্যবান হবে না এটাই স্বাভাবিক।
সবশেষ কথা হলো, আল্লাহর হুকুম মানার সম্পর্ক হলো ঈমানের সঙ্গে। যেমন আমি হজ করেছি, এজন্যই আমাকে ভালো থাকতে হবে, আর অন্যরা যা খুশি তাই করে বেড়াবে বিষয়টি এমন নয়। আমি মুসলমান, আমি ঈমানদার এ মুসলিম হওয়া আর ঈমানদার হওয়ার দাবিই হলো পাপমুক্ত জীবনযাপন করা। হজ করার তৌফিক হলেও আমাকে গোনাহ থেকে বেঁচে থাকতে হবে, আর হজ করার তৌফিক না হলেও আমাকে আল্লাহর হুকুম মেনে চলতে হবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর