কোন্দল দুশ্চিন্তা আ’লীগে জামায়াতই ভরসা বিএনপির

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলা উপজেলা নিয়ে বাগেরহাট-৪ আসন। একটি পৌরসভা ও ২০টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এ আসনে নির্বাচনী আমেজ বইতে শুরু করেছে। নিবন্ধন খুইয়ে জামায়াতে ইসলামী নিজেদের মতো করে কৌশলে মাঠে রয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে এ আসনে বেশিরভাগ সময় আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা জয়লাভ করেন।

তবে এবার অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে আওয়ামী লীগে। এককভাবে বিএনপির অবস্থান দুর্বল হলেও জামায়াতের বড় ভোটব্যাংকই বিএনপির ভরসা।

আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম শেখ আবদুল আজিজ ১৯৭৩ সালে এ আসন থেকে বিজয়ী হয়ে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় স্থান পান। ১৯৭৯ সালে তার উত্তরসূরি হিসেবে ভোটে জয়লাভ করেন আওয়ামী লীগের আবদুল লতিফ খান।

১৯৯৬ সালে ডা. মোজাম্মেল হোসেন এমপি হয়ে সমাজ কল্যাণ, মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তী সময়ে ২০০৮ এবং সর্বশেষ ২০১৪ সালেও তিনি এমপি হন। এখন তিনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৯১ ও ২০০১ সালে এ আসন থেকে জামায়াত নির্বাচিত হয়।

কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদ্যবিদায়ী সভাপতি এইচএম বদিউজ্জামান সোহাগ এবং প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ও কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য অ্যাডভোকেট আমিরুল আলম মিলনও নির্বাচনী মাঠে সক্রিয়। এরা সবাই মনোনয়ন যুদ্ধে মাঠে রয়েছেন।

অপর মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহসম্পাদক মো. জামিল হোসাইন, মোরেলগঞ্জ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট প্রবীর রঞ্জন হালদার, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহসম্পাদক মিজানুর রহমান জনি প্রমুখ।

২০০৮ সালের নির্বাচনে দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধিতার মুখেও ডা. মোজাম্মেল হোসেন বিজয়ী হন। এমপি হওয়ার পর দুই উপজেলার শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ডা. মোজাম্মেলের দূরত্ব আরও বেড়ে যায়।

মোরেলগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আমিরুল আলম মিলনের অনুসারীদের সঙ্গে এমপি গ্রুপের কোন্দল মাঝে মধ্যেই প্রকাশ্যে চলে আসে।

এর প্রভাব উপজেলা ও পৌর নির্বাচনেও পড়েছে। বিভক্তির কারণে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যক্রম আলাদা পালিত হচ্ছে। বিরোধ এখনও বিদ্যমান। নির্বাচনের আগে বিরোধ কতখানি প্রশমিত হবে সেটিই ভাববার বিষয়।

স্থানীয় আওয়ামী লীগে বিরোধের কথা স্বীকার করে ডা. মোজাম্মেল হোসেন বলেন, ‘আগের এমপিরা এলাকার উন্নয়নে একটি রাস্তাও করেননি। মোরেলগঞ্জ শরণখোলায় আঞ্চলিক মহাসড়কসহ এলাকার যে উন্নয়ন হয়েছে আমার নেত্রী শেখ হাসিনার মাধ্যমে আমি করতে সক্ষম হয়েছি।

সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা প্রতিবন্ধী ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা নেত্রীর প্রচেষ্টায় চালু করেছিলাম যার সুফল সবাই পাচ্ছে। পানগুছি নদীর ওপর সৌদি সরকারের অর্থায়নে সেতু, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সিডর বিধ্বস্ত শরণখোলায় চলমান টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ, বেকার ভাতাসহ সুন্দরবন সংলগ্ন বগী এলাকায় ৯০ একর জমি নিয়ে পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

অন্তত আরেকবার এমপি হয়ে এই অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে চাই।’

কথা হয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও বাগেরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য এইচএম বদিউজ্জামান সোহাগের সঙ্গে। নির্বাচনী প্রস্তুতি নিয়ে তিনি হাওর বার্তাকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে দল ও মানুষের জন্য কাজ করছি। তরুণ প্রজন্মের জন্য নিজস্ব চিন্তাভাবনা রয়েছে, মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হলে তা বাস্তবায়ন করতে পারব।’

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী অ্যাডভোকেট আমিরুল আলম মিলন বলেন, ‘১৫ বছর মোরেলগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক ও ১২ বছর সভাপতি হিসেবে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছি। দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যকরী সদস্য মনোনীত করায় কৃতজ্ঞ। এলাকার গণমানুষের জন্য কাজ করতে চাই।’

আওয়ামী লীগের আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী জামিল হোসাইন বলেন, ‘এলাকার উন্নয়নে করণীয় তুলে ধরে জনগণের সামনে ৭ দফা প্রকাশ করেছি। এর মধ্যে এলাকার উন্নয়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার পাশাপাশি সাবেক মন্ত্রী শেখ আবদুল আজিজ, আবদুল লতিফ খান ও ডা. মোজাম্মেল হোসেনের সব অসমাপ্ত কাজ পর্যায়ক্রমে সম্পন্ন করা।’

ঘরোয়া পরিবেশে কেন্দ্রীয় কর্মসূচি পালন করা ছাড়া মাঠে বিএনপি নেতাকর্মীদের দেখা যায় না বললেই চলে। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা বেশ সক্রিয়। এ ছাড়া এলাকায় তাদের পোস্টার ও ব্যানার ছেয়ে গেছে।

এ আসনে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন বাগেরহাট জেলা বিএনপির সহসভাপতি কাজী খায়রুজ্জামান শিপন, জেলা বিএনপির উপদেষ্টা কাজী মনিরুজ্জামান মনির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলাম এবং মোরেলগঞ্জ চালতাবুনিয়া গ্রামের সন্তান বাগেরহাট জেলা বিএনপির উপদেষ্টা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র মো. মনিরুল হক।

কথা হয় ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি হাওর বার্তাকে বলেন, ‘১৯৯১ সাল থেকে এ অঞ্চলে বিএনপির কেউ এমপি হতে পারেনি। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আমাকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করায় আমার কাছে এলাকাবাসীর অনেক প্রত্যাশা। দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হলে কচা নদীর ওপর সেতু, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন, বেকার সমস্যাসহ অবহেলিত জনপদের মানুষের কল্যাণে কাজ করব।’

বিএনপির অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী বাগেরহাট জেলা বিএনপির উপদেষ্টা কাজী মনিরুজ্জামান মনির বলেন, ‘সিডর-পরবর্তী সময়ে মাতৃভাষা কলেজে সাইক্লোন শেল্টার, মসজিদ, বিদ্যালয়সহ অসংখ্য স্কুল-কলেজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছি। ১৯৯১ সাল থেকে মাঠপর্যায়ে দলের কর্মী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে আমার নামে ১৪টি মামলা হয়।

নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও দলের নেতাকর্মীদের সহযোগিতা করছি।’

বিএনপির আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী খায়রুজ্জামান বলেন, ‘ছাত্রদল থেকে ধাপে ধাপে আজ জেলা বিএনপির সহসভাপতি হয়েছি।

ওয়ান-ইলেভেনের পর মোরেলগঞ্জ-শরণখোলায় মাঠপর্যায়ে একমাত্র নেতা হিসেবে বিএনপির আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে আসছি। আগামী নির্বাচনে এ আসনে বিএনপির দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে আমি শতভাগ আশাবাদী।’

অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী মনিরুল হক বলেন, ‘রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির সক্রিয় কর্মী হিসেবে কাজ করছি। দলের নেতাদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে মামলা ও জেল খেটেছি। মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলার অবহেলিত জনপদের সাধারণ মানুষের কল্যাণে কাজ করতে চাই।

আমার সততা ও দলের প্রতি ত্যাগ হিসেবে এ আসনে আমি মনোনয়ন প্রত্যাশা করি।’

এদিকে নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াতে ইসলামীর মাঠপর্যায়ে কোনো তৎপরতা না থাকলেও নির্বাচনী প্রস্তুতি রয়েছে দলের নেতাদের। মাঠপর্যায়ে নিজস্ব কৌশলে তারা কেন্দ্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে থাকে। আগামী নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থী তালিকায় এ আসনে অধ্যাপক শহিদুল ইসলামকে রেখেছে তাদের সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায়।

২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক হওয়ায় জামায়াতে ইসলামী এ আসনে জোটের মনোনয়ন দাবিদার। জোটগত নির্বাচন হলে তারাই মনোনয়ন পাবে বলে জানিয়েছেন জামায়াতের দায়িত্বশীল লোকজন। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা সোমনাথ দে আওয়ামী লীগের এমপি ডা. মোজাম্মেল হোসেনের সঙ্গে একজোট হয়ে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগদানসহ গণসংযোগ ও আলাদাভাবে কর্মসূচি পালন করছেন।

জামায়াতের সাংগঠনিক কার্যক্রম বেশকিছু দিন ধরে এলাকায় দৃশ্যমান না হলেও আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দলটি তৎপর রয়েছে। এ ছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে বিএনপি কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারবে তা ভাববার বিষয়।

১৯৯১ এবং ২০০১ সালে জামায়াত নেতা মাওলানা মুফতি আবদুস সাত্তার আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা শেখ আবদুল আজিজ ও ডা. মোজাম্মেল হোসেনকে পরাজিত করে দু’বার এমপি নির্বাচিত হন। বিতর্কিত ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপির আরশাদুজ্জামান বিজয়ী হন। এর আগে-পরে বিএনপির আর কোনো নেতা এ আসনে বিজয়ী হতে পারেননি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর