হাওর বার্তা ডেস্কঃ দুই দিনের জন্য জার্মানির ফ্রাংকফুর্ট শহরে গিয়েছিলাম সেখানকার বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে। বঙ্গবন্ধুর ওপর আলোচনা, সংগীতানুষ্ঠান ছিল মুখ্য।
আমি সঙ্গে নিয়েছিলাম শেখ হাসিনার ওপর নির্মিত আমার প্রামাণ্যচিত্রটি। হলভর্তি মানুষ তা দেখেছে এবং তাদের প্রশংসা আমাকে অভিভূত করেছে। অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক। কোলন থেকে এসেছিলেন সেখানকার ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. জাকারিয়া। ইউরোপীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি অনিল দাশগুপ্তও এসেছিলেন। এসেছিলেন আরো অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি। এই অনুষ্ঠান সম্পর্কে বারান্তরে আরো বিশদভাবে লেখার ইচ্ছা আছে।
জার্মানির বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের অনুষ্ঠানের একটি বৈশিষ্ট্য প্রথমে লক্ষ করেছি। জার্মানিতে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের তরুণ প্রজন্মের উপস্থিতিই ছিল তাতে বেশি।
সেই সঙ্গে কিছু জার্মান নারী-পুরুষও। হল ছিল দর্শকভর্তি। তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নারী। বহু বছর পর জার্মানিতে গিয়ে আরো একটি বিষয় দেখতে পেলাম। সেখানকার বাংলাদেশি ছেলে-মেয়েরা, এমনকি যারা জার্মানিতে জন্মগ্রহণ করেছে তারাও জার্মান ভাষার সঙ্গে চমৎকার বাংলা বলে। মেলিসা নামের এক বাংলাদেশি মেয়ে, যার জন্ম জার্মানিতে, তার বাংলা শুনে বুঝতেই পারিনি সে বিদেশে জন্ম নিয়েছে এবং বিদেশেই বড় হয়েছে। তার ভাই আমার সঙ্গে ছবি তোলার জন্য ব্যস্ততা দেখিয়েছে। কারণ সে আমার ভাষা আন্দোলনের গানটির সঙ্গে পরিচিত।
অনুষ্ঠানে আগত বাংলাদেশিদের সঙ্গে আলাপ করে মনে হয়েছে, জার্মানিতে তাদের একটি মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে উঠেছে। জার্মানির ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের ইন্টিগ্রেশন চমৎকার; আবার বাংলাদেশের ভাষা-সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের সম্পর্কও মলিন হয়নি। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে নিয়ে তারা গর্ব করে। আবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়েও। এক বাংলাদেশি তরুণের ইতিহাস-জ্ঞান দেখে বিস্মিত হয়েছি। সে বলল, ভারতকে স্বাধীন করার জন্য সুভাষ বসু দেশ ছেড়ে জার্মানিতে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে যখন হত্যা করা হয়, তখন শেখ হাসিনা এই জার্মানিতেই চলে আসেন। স্বামীর সঙ্গে তখন তিনি বিদেশে ছিলেন।
ফ্রাংকফুর্টে বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের এই অনুষ্ঠানটি ছিল বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে। তাতে দর্শকদের মধ্যে তরুণ-তরুণীর সংখ্যাই দেখেছি বেশি। তাদের মধ্যে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির (এরশাদ) সমর্থক ও সদস্য ছিল। তাদের একজনকে জিজ্ঞেস করতেই বলল, ‘বঙ্গবন্ধুকে আমরা এখন আর শুধু আওয়ামী লীগের নেতা মনে করি না। তিনি বাঙালি জাতির নেতা। স্বাধীন দেশটির স্থপতি। তাঁকে কোনো দলের নেতার পরিচয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা অপরাধ। ’
তার কথা শুনে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের কথা মনে পড়ল। গেটিসবার্গে তাঁর বিশাল স্ট্যাচুর নিচে লেখা আছে, তাঁর অমর বাণী—ফর দ্য পিপল, অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল। তাঁর সম্পর্কে বলা হয়, তাঁকে হত্যা করা হলেও তাঁর মৃত্যু হয়নি। তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী। এই আব্রাহাম লিংকন কোন দলের নেতা ছিলেন, তা আমেরিকায় জিজ্ঞেস করাও অপরাধ। তিনি আমেরিকার জাতীয় ঐক্যের স্থপতি, এটাই তাঁর বড় পরিচয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কেও এ কথা সত্য। তিনি কোন দলের নেতা ছিলেন—এটা জিজ্ঞেস করা এখন বাহুল্য। তিনি একটি স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্রের স্থপতি এবং পিতা—এটাই তাঁর একমাত্র পরিচয়। অন্য সব পরিচয় এখন বাহুল্যে পরিণত হয়েছে।
এই সত্যটা বাংলাদেশের ক্ষুদ্র একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর অস্বীকৃতির চেষ্টাই দেশের সব সমস্যার মূলে কাজ করেছে। বাঙালির যেমন আত্মপরিচয়ের সমস্যা (crisis of identity) আছে, তেমনি আছে পিতৃপরিচয়ের সমস্যাও। আমরা মুসলমান, না বাঙালি—এই কূটতর্কটি যেমন অসাধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে জিইয়ে রাখা হয়েছে, তেমনি বাংলাদেশের স্থপতি ও জাতির পিতা হিসেবে তাঁর পরিচয়টি মুছে ফেলার জন্যও দেশপ্রেম ও সততাবর্জিত একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী দীর্ঘকাল নানা চক্রান্ত চালিয়েছে।
তারা যে জয়ী হতে পারেনি, বরং চিরকালের পরাজিত শক্তি, যার প্রমাণ পেলাম জার্মানির ফ্রাংকফুর্ট শহরে এসেও। অভিবাসী বাঙালিদের মধ্যেও বঙ্গবন্ধু এখন ব্যক্তি বা দলনেতা নন। একটি প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তির মৃত্যু হয়, কিন্তু প্রতিষ্ঠানের মৃত্যু হয় না। তাই ব্রিটেনের রাজার মৃত্যু হলে গাওয়া হয় ‘কিং ইজ ডেড, লং লিভ দ্য কিং। ’ বাংলাদেশেও ব্যক্তি শেখ মুজিবের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু চিরঞ্জীব, তাঁর মৃত্যু হয়নি।
বাংলাদেশে দীর্ঘকাল স্বৈরাচারী শাসকরা বঙ্গবন্ধুর নামটি মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে। এই স্বৈরাচারের পতন হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর পতন হয়নি। তিনি নতুন করে বাংলার মানুষের বুকে জেগে উঠেছেন। জেগে উঠেছেন চিরস্থায়ীভাবে। বাংলার মানুষের জীবনধারার সঙ্গে তাঁর নামটি এখন ওতপ্রোতভাবে মিশে গেছে। দেশে ভবিষ্যতে সরকার পরিবর্তন হলেও বঙ্গবন্ধুকে তাঁর মর্যাদার আসন থেকে আর টলানো সম্ভব হবে না। আমেরিকা বলতেই এখন যেমন জর্জ ওয়াশিংটন, আব্রাহাম লিংকন, তেমনি বাংলাদেশ বলতেও এখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এটি এখন একটি নাম নয়, একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের ধ্বংস নেই।
শুধু নিজ দেশে নয়, বিশ্বের সব দেশেই বঙ্গবন্ধু নামটি এখন পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত। বহু দেশে বঙ্গবন্ধুর নামে রাস্তা ও নানা প্রতিষ্ঠান হয়েছে। জার্মানিতে এসে জানলাম, বিশ্বের প্রাচীনতম হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ তাদের ইউনিভার্সিটিতে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চেয়ার’ প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। জার্মানির বাংলাদেশিরাও এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে চায়। এই চেয়ার প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারকে অবহিত করার জন্য ড. জাকারিয়া শিগগিরই জার্মানি থেকে বাংলাদেশে যাচ্ছেন। লন্ডনের ইস্টএন্ডে বঙ্গবন্ধুর একটি আবক্ষ মূর্তি স্থাপিত হয়েছে। সেন্ট্রাল লন্ডনে একটি বড় স্ট্যাচু প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের কথা শোনা যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ একটি রাজনৈতিক দল। তার উত্থান-পতন আছে। পরাজয় ও জয় দুটিই আছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এখন একটি ইনস্টিটিউশন বা প্রতিষ্ঠান। তিনি দলমতের ঊর্ধ্বে একটি পিতৃচরিত্র। তিনি এখন কামাল আতাতুর্ক, লিংকন, নাসের, টিটোর মতো বিশ্বনেতাদের কাতারে শামিল। বিশ্ববাসীর মনে তাঁর অধিষ্ঠান। তিনি সব বিতর্কের ঊর্ধ্বের মহানায়ক। গত ৬ অক্টোবর জার্মানির ফ্রাংকফুর্ট শহরে বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে গিয়ে এই সত্যটি আরো বেশি উপলব্ধি করেছি। জার্মানির মানুষও তাঁকে জানে এবং শ্রদ্ধা করে। তাদের কাছে ‘হের মুজিব’ ও ‘বঙ্গবন্ধু’—দুটি নামই পরিচিত।
হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক কয়েক দফা বাংলাদেশে গেছেন শুধু বঙ্গবন্ধু এই নামটির ডাকে। ফ্রাংকফুর্টের অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর জীবনকে একজন বিদেশির চোখে মূল্যায়ন করেছেন এবং গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। আরেক জার্মান পণ্ডিতের মুখে শুনেছি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের নতুন মূল্যায়ন। তিনি বলেছেন, বর্তমানে ভারত মহাসাগরীয় দেশগুলোতে মুজিবের মতো নেতার অভাবেই সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতা ফ্যাসিবাদের মতো আবার আত্মপ্রকাশের সুযোগ পাচ্ছে। মুজিব সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা ও সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে একটি সেক্যুলার ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দ্বারা সারা উপমহাদেশের রাজনীতির ধারা বদলে দিয়েছিলেন। এই ধারা অব্যাহত থাকলে এই এলাকায় জিহাদিস্ট, হিন্দুত্ববাদী ইত্যাদি অশুভ শক্তির উত্থান সম্ভব হতো না। বিশ্বশান্তি হুমকির সম্মুখীন হতো না। এই হুমকি প্রতিরোধ ও পরাজিত করতে হলে মুজিব-নেতৃত্ব, তাঁর লক্ষ্য ও আদর্শের নতুন করে মূল্যায়ন প্রয়োজন।
আমি একজন জার্মান পণ্ডিতের মুখে এ কথা শুনে বিস্মিত হইনি। তাঁরা নিজেদের ইতিহাস থেকেই উপমহাদেশের ইতিহাস বিশ্লেষণ করতে শিখেছেন। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দরকার তাঁর জীবন ও ইতিহাসের প্রকৃত মূল্যায়ন। আওয়ামী লীগেরও উচিত জাতীয় জীবনে শুধু বঙ্গবন্ধুর নামের প্রতিষ্ঠাতেই সন্তুষ্ট না থেকে তাঁর আদর্শের নবমূল্যায়ন এবং এই মূল্যায়ন দ্বারা দেশের তরুণ প্রজন্মকে উজ্জীবিত করা। সব সন্ত্রাস ও অপরাজনীতিকে বঙ্গবন্ধুর নামে উজ্জীবিত এই তারুণ্যের শক্তিই প্রতিহত করতে পারে। ফ্রাংকফুর্টের আলোচনাসভা আমাকে এই বিশ্বাসেই আবার আস্থাবান করেছে।