হাওর বার্তা ডেস্কঃ জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে তারা রোহিঙ্গা মুসলমানদের সেদেশ থেকে স্থায়ীভাবে বিতাড়নের চেষ্টা করছে। জাতিসংঘের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্মম ও পরিকল্পিত হামলা চালানো হয়েছে। পাশাপাশি তাদের গ্রাম ও ফসলের জমি এমনভাবে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে যাতে পালিয়ে যাওয়া শরণার্থীরা আর কোনোদিন সেখানে ফিরতে না পারে। গতকাল বুধবার বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের ওপর সমন্বিত হামলা শুরু হয় ২৫ শে আগস্ট রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা পুলিশ ফাঁড়ির ওপর হামলা চালানোরও আগে, যে বক্তব্যের সঙ্গে মিয়ানমার সরকারের বক্তব্যের মিল নেই। রাখাইন থেকে সম্প্রতি বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ৬০ জনেরও বেশি রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলেছেন জাতিসংঘের কর্মীরা, এই প্রতিবেদনে তাদের দেওয়া তথ্যও সংকলিত হয়েছে।
মিয়ানমার সরকার শুরু থেকেই বলে আসছিল যে গত ২৫শে আগস্ট আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) যে হামলা, তার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবেই তারা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। কিন্তু এই রিপোর্টে পুরোপুরি তার উল্টো কথা বলা হয়েছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার দফতর যে কেবল মিয়ানমার সরকারের এই দাবিকে অসত্য বলছে শুধু তাই নয়, তারা বলেছে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যেভাবে এই পুরো অভিযানটি পরিচালিত হয়েছে, তাতে তাদের মনে হয়েছে, এটি ছিল একেবারে পূর্ব পরিকল্পিত। এর পক্ষে বেশ কিছু প্রমাণও তারা হাজির করেছে। আরসা মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলা চালানোর অনেক আগে থেকেই রাখাইনে সেনাবাহিনী পাঠানো হয়েছিল। এ নিয়ে মিয়ানমার বিষয়ক জাতিসংঘের মানবাধিকার কর্মকর্তা উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন। সেখানে ২৫শে আগস্টের আগে থেকেই ১৫ হতে ২৫ বছর বয়সী রোহিঙ্গা পুরুষদের গণহারে আটক করা হচ্ছিল।
রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয়ভাবে নেতৃস্থানীয় তাদের আটক করা হচ্ছিল। পুরো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নানাভাবে নির্যাতন, হয়রানি, ভয়ভীতি দেখানোর মাধ্যমে একটা চরম আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল। আর ২৫শে আগস্টে আরসার কথিত হামলার পর সেনাবাহিনী তাদের ভাষায় যে শুদ্ধি অভিযান শুরু করে, সেটি এত সুসংগঠিত, সমন্বিত এবং ধারাবাহিকভাবে পরিচালিত হয়েছে যে সেটি দেখেও জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের মনে হয়েছে এটি ছিল একেবারে আগে থেকে পরিকল্পনা করে করা। আর যেভাবে রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলো ধ্বংস করা হয়েছে, তাতে মনে হয়নি কোন অভিযান পরিচালনার সময় সংঘাতের কারণে ধ্বংস হয়েছে। সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা একেবারে পরিকল্পনা করেই গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দিয়েছে, রোহিঙ্গাদের সব সম্পদ ধ্বংস করেছে।
জাতিসংঘের কর্মকর্তারা বলেছেন, মিয়ানমার যে রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবেই বিতাড়নের চেষ্টা করছে এটা তাদের মনে হয়েছে রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলো এবং তাদের সব সম্পদ যেভাবে ধ্বংস করা হয়েছে সেটা দেখে। রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে শুধু যে বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে তা নয়। সেখানে তাদের গবাদি পশু, ফসলের ক্ষেত, এমনকি বসত ভিটায় যেসব গাছপালা ছিল সেগুলো পর্যন্ত ধ্বংস করা হয়েছে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, রোহিঙ্গারা যদি ফিরে আসে, সেখানে যেন তারা আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে না পারে। যেন তারা তাদের নিজেদের জায়গাকে পর্যন্ত আর চিনতে না পারে। রিপোর্টে আরো গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টির উল্লেখ করা হয়েছে, তাহলো, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কার্যত রাখাইনে যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বলে একটি জনগোষ্ঠী ছিল, তার সমস্ত চিহ্ন মুছে ফেলতে চেয়েছে। এজন্যে তারা বিশেষ করে টার্গেট করেছিল রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা শিক্ষক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় নেতাদের। এর উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্টতই রোহিঙ্গাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যসহ সবকিছু ধ্বংস করা। এই রিপোর্ট যাদের সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছে, তারা ভয়ঙ্কর ও গা শিউরে উঠার মতো নির্যাতনেরও বিবরণ দিয়েছেন।
কীভাবে সেনাবাহিনী এসে গ্রামগুলোতে আক্রমণ চালিয়েছে, নির্বিচারে লোকজনের ওপর গুলি চালিয়েছে, বাড়ি-ঘরে আগুন দিয়ে জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছে, মেয়েদের ধর্ষণ করেছে, তার বিস্তারিত বিবরণ আছে এতে। বেশিরভাগ মানুষ তাদের দেওয়া সাক্ষ্যে বলেছেন, যাদের গুলি করে মারা হয়, তাদের একেবারে খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়েছে। অনেককে পালানোর সময় পেছন দিক থেকে গুলি করা হয়। খুবই বিশ্বাসযোগ্য একটি সূত্রকে উদ্ধৃত করে রিপোর্টে এক অন্তঃসত্ত্বা রোহিঙ্গা নারীকে ধর্ষণ ও হত্যারও বিবরণ আছে। ধর্ষণের পর ওই মহিলার পেটে ছুরি চালানো হয়, এমনকি তার স্তন কেটে ফেলা হয়। অনেক মেয়েকে তাদের পরিবারের সদস্যদের সামনেই ধর্ষণ করা হয়। বিবিসি।