ঢাকা ০৭:২৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
দেশ ও জাতি গঠনে “দৈনিক আমার দেশ” পত্রিকার কাছে নেত্রকোণার জনগণের প্রত্যাশা শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত ভুল অস্ত্রোপচার, যা ঘটেছিল প্রিয়াঙ্কা সঙ্গে সচিবালয়ে উপদেষ্টা হাসান আরিফের তৃতীয় জানাজা সম্পন্ন সাবেক সচিব ইসমাইল রিমান্ডে অবশেষে বিল পাস করে ‘শাটডাউন’ এড়াল যুক্তরাষ্ট্র চাঁদাবাজদের ধরতে অভিযান শুরু হচ্ছে: ডিএমপি কমিশনার নির্বাচনের পর নিজের নিয়মিত কাজে ফিরে যাবেন ড. ইউনূস ইয়েমেন থেকে ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, আহত ১৬ জুলাই আন্দোলন বিগত বছরগুলোর অনিয়মের সমষ্টি: ফারুকী তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ‘সড়কে নৈরাজ্যের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাব জড়িত

শরণার্থী ব্যবস্থাপনা: তুমি জানো না, নাকি বোঝো না

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৪:৪৭:৩৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭
  • ৫১৫ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ শরণার্থী ব্যবস্থাপনা পরিস্থিতি ক্রমশ লেজেগোবরে হয়ে উঠছে। পদদলিত হয়ে এবং ত্রাণের গাড়ির ধাক্কায় মানুষ মারা যাওয়ার খবর আসছে। মিয়ানমারের নির্যাতন, গুলি, আগুন, মাইন ও নৌকাডুবির হাত থেকে বাঁচার জন্য দিনের পর দিন হেঁটে বাংলাদেশের রাস্তায় এসে যদি পদপিষ্ট হয়ে একটা শিশু মারা যায়, তবে সে লজ্জা কার? শরণার্থী নারী ও শিশুদের নিরাপত্তার বিষয়টিও ক্রমশ ইস্যু হয়ে উঠছে।

প্রশ্ন উঠেছে, কে থাকবে চালকের আসনে? জাতিসংঘের কোন প্রতিষ্ঠানের মাথায় নেতৃত্বের মুকুট থাকবে? শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন ইউএনএইচসিআর, না সদ্য জাতিসংঘ পরিবারের অন্তর্ভুক্তি পাওয়া অভিবাসীবিষয়ক সংস্থা আইওএম। আইওএম কাজ করে অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে। শরণার্থীদের আইনগত অধিকার, মর্যাদা ফিরিয়ে নেওয়া যাবতীয় বিষয় একেবারেই অন্য চরিত্রের কাজ ও দায়িত্ব দাবি করে।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে জানের ভয়ে পালিয়ে আসা মানুষগুলো অভিবাসী নয়, তারা শরণার্থী—এই সত্যটা বুঝতে ও গিলতে আমাদের যত বেশি সময় লাগবে, ততই সকলেরই অমঙ্গল। আমরা জাতিসংঘ কিংবা বিশ্বকে বলছি মিয়ানমার থেকে আসা শরণার্থীদের দুর্দশার কথা, কিন্তু কাগজে-কলমে তাদের রাখছি ‘বেআইনি অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে? এই দ্বিচারিতা থেকে কী লাভ আমরা আশা করছি?

শরণার্থীদের সুরক্ষা, তাদের প্রত্যাবাসন, প্রত্যাবাসন-পরবর্তী সুরক্ষা এবং নাগরিকত্বহীন মানুষদের দেখাশোনার তাবৎ দায়িত্ব বিশ্বের মোড়লেরা শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের ওপর ন্যস্ত করেছেন। অন্য কোনো সংস্থাকে শরণার্থীদের দায়িত্ব দেওয়া মানে শরণার্থীদের স্বার্থের হানি এবং বাংলাদেশের শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার দাবিকে কমজোরি করে দেওয়া।

১৯৯১ সনের জলোচ্ছ্বাসের পর যেমন নানা বর্ণের, নানা আকারের আর নানা বিশ্বাসের সংস্থা ও সংগঠনের ঢল নেমেছিল, এবারও তেমনটাই ঘটছে। দেশের ভেতরের মানুষ যেমন আবেগ আর হাতের কাছে যা পাওয়া যায়, তা-ই নিয়ে ছুটে গেছে, তেমনি অপরিচিত এবং সন্দেহের উদ্রেককারী নানা বিদেশি সংস্থাও ছুটে আসছে।

পাঠকের মনে থাকার কথা ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর গেরুয়া বসনা আনন্দমর্গীদের ক্রিয়াকলাপের কথা; ভেসে আসা লাশ দিয়ে তাদের কীর্তির কথা গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর আমাদের হুঁশ হয়। এবার বেহুঁশ করে দিয়েছে শিখ জাতীয়তাবাদী সংগঠন খালসা এইডের এক ঢোঁক জল খাওয়ানো আর বড় বড় ডেকচিতে খিচুড়ি রান্নার দৃশ্য। তারা নাকি ৫০ হাজার শরণার্থীর দায়িত্ব নিয়েছে। পাঁচ স্তরের অনুমতির নিরাপত্তা-চাদর ফুঁড়ে তারা কীভাবে টেকনাফে পৌঁছে গেল, তা যদি কেউ জানতে চায়, তাহলে কি বেয়াদবি বলে তাকে নাকচ করে দেওয়া হবে? খালসারা সারা দুনিয়ায় বাংলাদেশের সংকটের কথা বলে চাঁদা ওঠাচ্ছে। এই চাঁদার হিসাব কে নেবে?

শরণার্থীদের মধ্যে কাজের অনুমতি নেওয়ার যে পঞ্চধাপ নীতি ঘোষিত হয়েছে, তা কি শুধুই কাগজে-কলমে? নীতি-পদ্ধতি-প্রক্রিয়ার বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের একটু বাস্তবমুখী এবং জনমুখী হতে হবে। আগারগাঁওয়ের নতুন ভবনে ওঠা এনজিওবিষয়ক ব্যুরোকে এই অবস্থায় একটু নড়েচড়ে বসতে হবে। কী ক্ষতি, যদি তারা একটা অস্থায়ী অফিস খোলে কক্সবাজারে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অনুমতি তো সেখানে বসেই দেওয়া যায়। এটা হলে এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর প‌ক্ষে সার্বক্ষণিক তদারকিও করাও সম্ভব হবে। কোন সংগঠন কী উদ্দেশ্যে আসছে, সেটা না জেনে অনুমতি দেওয়ার ফল সুনামির পর শ্রীলঙ্কা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। মার্কিন মুলুক থেকে শিশুদরদি সেজে আসা শিশু পাচার আর শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনকারীদের শনাক্ত করতে তাদের বছরেরও বেশি সময় চলে যায়। হাইতি তো ধরতেই পারেনি পাচারের আগে।

আদতে সবকিছুই নির্ভর করছে আমরা শরণার্থীদের কী চোখে দেখছি তার ওপর। তাদের সম্পর্কে আমাদের রাষ্ট্রের ভাবনা কী আমাদের পারসেপশনটাই-বা কী? সরকার যে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে শরণার্থীদের নেগবানি করার জন্য চাঁদা চাইছে, সেই অ্যাকাউন্টের নাম দিয়েছে হিউম্যানেটারিয়ান অ্যাসিস্ট্যান্ট টু দ্য মিয়ানমার সিটিজেন ইলিগ্যাল মাইগ্রেটেশন। বেআইনিভাবে অভিবাসিত মিয়ানমারের নাগরিক আর আসতে দেওয়া শরণার্থী এক বস্তু নয়। আন্তর্জাতিক আইনের চোখে বেআইনিভাবে অভিবাসিত আর শরণার্থীর এবং তাদের অধিকারের সীমারেখার মধ্যে যোজন যোজন ফারাক। এটা যদি জ্ঞানী আমলারা না বোঝেন, তাহলে কে বোঝাবে? তাঁরা অবুঝ হলে নেতৃত্বের বুঝ আসবে কোথা থেকে? কূটনীতির দর-কষাকষি টেবিলে একটা ছোট শব্দ অনেক বড় হয়ে উঠতে পারে।

একটা বেসরকারি সংস্থা তাদের প্রতিবেদনে শরণার্থীদের লিখেছে ‘রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশনকারী’ হিসেবে। এটা কি ভুল, না ব্যাধি? সেটাই এখন প্রশ্ন। শরণার্থীদের প্রতি আমাদের দয়া-মায়া-দান-ধ্যানের পাশাপাশি তাদের প্রতি সম্মান আর তাদের অধিকারগুলোকে সমুন্নত রাখাটা জরুরি। যারা ভারতে শরণার্থী হয়েছিল, তারা দু-একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া জয় বাংলার মানুষ হিসেবে সম্মান-সমীহ উপভোগ করেছে। সেটা অন্যদের দিতে আমরা কেন কার্পণ্য করব। ভিড় ঠেকাতে না পেরে ধৈর্য হারিয়ে একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মীদের শরণার্থী শিশুদের ওপর চড়াও হওয়ার সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এসব সংস্থাকে অবিলম্বে ছুটিতে পাঠিয়ে দেওয়া দরকার। এসব অন্যায় আচরণকারীর রাশ শুরুতেই শক্ত হাতে টানতে না পারলে বৈরী পরিবেশ তৈরি হবে। স্থানীয় জনগণের মধ্যেও একটা সময় পর শরণার্থীদের প্রতি নানা বৈরী মনোভাব তৈরি হতে পারে। অতীতেও এমনটা হয়েছে। ১৯৯৩-৯৪ সালে আন্তর্জাতিক সংস্থার গাড়িতে আগুন দেওয়া, অফিস পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। দমদমিয়া ক্যাম্পে আনসার-পুলিশকে গুলিবর্ষণও করতে হয়েছিল। সে পরিস্থিতি যেন আবার সৃষ্টি না হয়, সেদিকে আমাদের মন দিতে হবে।

শরণার্থীদের বাসে, ট্রাকে না তুলতে পুলিশ আইন জারি করেছে। শোনা যাচ্ছে, তাদের ঘর ভাড়া দেওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য বাড়িওয়ালাদের বলা হচ্ছে। এসবই উৎপীড়নমূলক আইনকানুন। এসব আইন করার আগে আমরা যথেষ্ট বিবেচনা করেছি কি না সন্দেহ আছে। এ রকম হলে শরণার্থীরা ক্রমশ কালোবাজারের পণ্যে পরিণত হবে। দালালের দল সেই অপেক্ষায় আছে। আমরা না মানলেও এটা সত্য যে শরণার্থীদের দূর আত্মীয়স্বজন অথবা স্বজনের স্বজন বৃহত্তর চট্টগ্রামের আর বান্দরবানের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। স্বাভাবিক মেলামেশা আর চলাফেরায় বাধা দিলে চোখ ফাঁকি দিয়ে ‘দুর্গম’ পথে সেটা শুরু হবে।

নিবন্ধন-প্রক্রিয়া ত্বরিত আর জোরদার করলে শরণার্থীদের চলাচল পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখা সহজ হবে। শরণার্থীদের আগমনের পথগুলোর মুখেই নিবন্ধনের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনীয় জনবল লাগিয়ে দুই সপ্তাহের মধ্যেই এটা করা সম্ভব। কম্বোডিয়ায় বাংলাদেশের মানুষ গিয়ে সে দেশের সব নাগরিকের নিবন্ধনকাজ শেষ করেছিল স্বল্পতম সময়ের মধ্যে। এসব মানুষের বেশির ভাগ এখনো কর্মক্ষম আছেন এবং দেশেই আছেন। তাঁদের এ কাজে লাগানো যায়।

খাবার, পানি, ঘর, ঘটিবাটি, বালতি ছাড়াও শরণার্থীদের সুরক্ষার (প্রোটেকশন) ব্যবস্থা এখনো সেভাবে আমলে নেওয়া হচ্ছে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, শরণার্থীরা এসেছে প্রাণের ভয়ে। সেনা উৎপীড়নের দগদগে ঘা তাদের মন আর শরীরে জ্বলজ্বল করছে। অনেকেই পরিবারের লোকজন রেখে এসেছে। সবাই ফিরে যেতে চায়। কারও ফেরা হবে (হয়তো) সোজা পথে, কাউকে যেতে হবে ঘোরা পাথে। যাঁরা হরদম ছবি তুলছেন আর ছাপছেন, তাঁদের একটু সাবধান হতে হবে। বিশেষ করে নারী, শিশু আর কিশোর-কিশোরীদের ছবি ছাপানোর বেলায় সতর্কতা দরকার। ভুলে গেলে চলবে না, সে দেশের সব নাগরিকের নাম-ঠিকানা হাল সাকিন সরকারি নথিতে পুরোদস্তুর লিপিবদ্ধ আছে। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা মানুষের ছবি তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করতে পারে সামরিক বাহিনী আর তাদের সহযোগীরা।

বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি এক ভয়াবহ হুমকির মুখে। রাখাইন রাজ্যের মানুষ স্বাস্থ্যসেবার সুরক্ষা ছাতার আওতায় না থাকায় পোলিও, হাম, ডিপথেরিয়া, যক্ষ্মা ইত্যাদি রোগ সেখানে ডালভাত। মানুষ সেসব রোগ বা রোগের সম্ভাবনা সে দেশে রেখে এখানে আসছে না, বরং সঙ্গে করে নিয়ে আসছে। টিকা প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে জনস্বাস্থ্য রক্ষার সব ব্যবস্থা দ্রুত এবং কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটা ঠিক, উখিয়া, টেকনাফ ও কক্সবাজারের পানি সাগরে চলে যাবে, তবে রোগব্যাধির উজানে যাওয়ার আরও পরিবহন আছে। পোলিওমুক্ত এবং যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া-নিয়ন্ত্রিত একটা দেশে এগুলো আবার ফিরে আসার অনেক উদাহরণ আছে। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

দেশ ও জাতি গঠনে “দৈনিক আমার দেশ” পত্রিকার কাছে নেত্রকোণার জনগণের প্রত্যাশা শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত

শরণার্থী ব্যবস্থাপনা: তুমি জানো না, নাকি বোঝো না

আপডেট টাইম : ০৪:৪৭:৩৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ শরণার্থী ব্যবস্থাপনা পরিস্থিতি ক্রমশ লেজেগোবরে হয়ে উঠছে। পদদলিত হয়ে এবং ত্রাণের গাড়ির ধাক্কায় মানুষ মারা যাওয়ার খবর আসছে। মিয়ানমারের নির্যাতন, গুলি, আগুন, মাইন ও নৌকাডুবির হাত থেকে বাঁচার জন্য দিনের পর দিন হেঁটে বাংলাদেশের রাস্তায় এসে যদি পদপিষ্ট হয়ে একটা শিশু মারা যায়, তবে সে লজ্জা কার? শরণার্থী নারী ও শিশুদের নিরাপত্তার বিষয়টিও ক্রমশ ইস্যু হয়ে উঠছে।

প্রশ্ন উঠেছে, কে থাকবে চালকের আসনে? জাতিসংঘের কোন প্রতিষ্ঠানের মাথায় নেতৃত্বের মুকুট থাকবে? শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন ইউএনএইচসিআর, না সদ্য জাতিসংঘ পরিবারের অন্তর্ভুক্তি পাওয়া অভিবাসীবিষয়ক সংস্থা আইওএম। আইওএম কাজ করে অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে। শরণার্থীদের আইনগত অধিকার, মর্যাদা ফিরিয়ে নেওয়া যাবতীয় বিষয় একেবারেই অন্য চরিত্রের কাজ ও দায়িত্ব দাবি করে।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে জানের ভয়ে পালিয়ে আসা মানুষগুলো অভিবাসী নয়, তারা শরণার্থী—এই সত্যটা বুঝতে ও গিলতে আমাদের যত বেশি সময় লাগবে, ততই সকলেরই অমঙ্গল। আমরা জাতিসংঘ কিংবা বিশ্বকে বলছি মিয়ানমার থেকে আসা শরণার্থীদের দুর্দশার কথা, কিন্তু কাগজে-কলমে তাদের রাখছি ‘বেআইনি অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে? এই দ্বিচারিতা থেকে কী লাভ আমরা আশা করছি?

শরণার্থীদের সুরক্ষা, তাদের প্রত্যাবাসন, প্রত্যাবাসন-পরবর্তী সুরক্ষা এবং নাগরিকত্বহীন মানুষদের দেখাশোনার তাবৎ দায়িত্ব বিশ্বের মোড়লেরা শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের ওপর ন্যস্ত করেছেন। অন্য কোনো সংস্থাকে শরণার্থীদের দায়িত্ব দেওয়া মানে শরণার্থীদের স্বার্থের হানি এবং বাংলাদেশের শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার দাবিকে কমজোরি করে দেওয়া।

১৯৯১ সনের জলোচ্ছ্বাসের পর যেমন নানা বর্ণের, নানা আকারের আর নানা বিশ্বাসের সংস্থা ও সংগঠনের ঢল নেমেছিল, এবারও তেমনটাই ঘটছে। দেশের ভেতরের মানুষ যেমন আবেগ আর হাতের কাছে যা পাওয়া যায়, তা-ই নিয়ে ছুটে গেছে, তেমনি অপরিচিত এবং সন্দেহের উদ্রেককারী নানা বিদেশি সংস্থাও ছুটে আসছে।

পাঠকের মনে থাকার কথা ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর গেরুয়া বসনা আনন্দমর্গীদের ক্রিয়াকলাপের কথা; ভেসে আসা লাশ দিয়ে তাদের কীর্তির কথা গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর আমাদের হুঁশ হয়। এবার বেহুঁশ করে দিয়েছে শিখ জাতীয়তাবাদী সংগঠন খালসা এইডের এক ঢোঁক জল খাওয়ানো আর বড় বড় ডেকচিতে খিচুড়ি রান্নার দৃশ্য। তারা নাকি ৫০ হাজার শরণার্থীর দায়িত্ব নিয়েছে। পাঁচ স্তরের অনুমতির নিরাপত্তা-চাদর ফুঁড়ে তারা কীভাবে টেকনাফে পৌঁছে গেল, তা যদি কেউ জানতে চায়, তাহলে কি বেয়াদবি বলে তাকে নাকচ করে দেওয়া হবে? খালসারা সারা দুনিয়ায় বাংলাদেশের সংকটের কথা বলে চাঁদা ওঠাচ্ছে। এই চাঁদার হিসাব কে নেবে?

শরণার্থীদের মধ্যে কাজের অনুমতি নেওয়ার যে পঞ্চধাপ নীতি ঘোষিত হয়েছে, তা কি শুধুই কাগজে-কলমে? নীতি-পদ্ধতি-প্রক্রিয়ার বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের একটু বাস্তবমুখী এবং জনমুখী হতে হবে। আগারগাঁওয়ের নতুন ভবনে ওঠা এনজিওবিষয়ক ব্যুরোকে এই অবস্থায় একটু নড়েচড়ে বসতে হবে। কী ক্ষতি, যদি তারা একটা অস্থায়ী অফিস খোলে কক্সবাজারে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অনুমতি তো সেখানে বসেই দেওয়া যায়। এটা হলে এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর প‌ক্ষে সার্বক্ষণিক তদারকিও করাও সম্ভব হবে। কোন সংগঠন কী উদ্দেশ্যে আসছে, সেটা না জেনে অনুমতি দেওয়ার ফল সুনামির পর শ্রীলঙ্কা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। মার্কিন মুলুক থেকে শিশুদরদি সেজে আসা শিশু পাচার আর শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনকারীদের শনাক্ত করতে তাদের বছরেরও বেশি সময় চলে যায়। হাইতি তো ধরতেই পারেনি পাচারের আগে।

আদতে সবকিছুই নির্ভর করছে আমরা শরণার্থীদের কী চোখে দেখছি তার ওপর। তাদের সম্পর্কে আমাদের রাষ্ট্রের ভাবনা কী আমাদের পারসেপশনটাই-বা কী? সরকার যে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে শরণার্থীদের নেগবানি করার জন্য চাঁদা চাইছে, সেই অ্যাকাউন্টের নাম দিয়েছে হিউম্যানেটারিয়ান অ্যাসিস্ট্যান্ট টু দ্য মিয়ানমার সিটিজেন ইলিগ্যাল মাইগ্রেটেশন। বেআইনিভাবে অভিবাসিত মিয়ানমারের নাগরিক আর আসতে দেওয়া শরণার্থী এক বস্তু নয়। আন্তর্জাতিক আইনের চোখে বেআইনিভাবে অভিবাসিত আর শরণার্থীর এবং তাদের অধিকারের সীমারেখার মধ্যে যোজন যোজন ফারাক। এটা যদি জ্ঞানী আমলারা না বোঝেন, তাহলে কে বোঝাবে? তাঁরা অবুঝ হলে নেতৃত্বের বুঝ আসবে কোথা থেকে? কূটনীতির দর-কষাকষি টেবিলে একটা ছোট শব্দ অনেক বড় হয়ে উঠতে পারে।

একটা বেসরকারি সংস্থা তাদের প্রতিবেদনে শরণার্থীদের লিখেছে ‘রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশনকারী’ হিসেবে। এটা কি ভুল, না ব্যাধি? সেটাই এখন প্রশ্ন। শরণার্থীদের প্রতি আমাদের দয়া-মায়া-দান-ধ্যানের পাশাপাশি তাদের প্রতি সম্মান আর তাদের অধিকারগুলোকে সমুন্নত রাখাটা জরুরি। যারা ভারতে শরণার্থী হয়েছিল, তারা দু-একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া জয় বাংলার মানুষ হিসেবে সম্মান-সমীহ উপভোগ করেছে। সেটা অন্যদের দিতে আমরা কেন কার্পণ্য করব। ভিড় ঠেকাতে না পেরে ধৈর্য হারিয়ে একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মীদের শরণার্থী শিশুদের ওপর চড়াও হওয়ার সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এসব সংস্থাকে অবিলম্বে ছুটিতে পাঠিয়ে দেওয়া দরকার। এসব অন্যায় আচরণকারীর রাশ শুরুতেই শক্ত হাতে টানতে না পারলে বৈরী পরিবেশ তৈরি হবে। স্থানীয় জনগণের মধ্যেও একটা সময় পর শরণার্থীদের প্রতি নানা বৈরী মনোভাব তৈরি হতে পারে। অতীতেও এমনটা হয়েছে। ১৯৯৩-৯৪ সালে আন্তর্জাতিক সংস্থার গাড়িতে আগুন দেওয়া, অফিস পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। দমদমিয়া ক্যাম্পে আনসার-পুলিশকে গুলিবর্ষণও করতে হয়েছিল। সে পরিস্থিতি যেন আবার সৃষ্টি না হয়, সেদিকে আমাদের মন দিতে হবে।

শরণার্থীদের বাসে, ট্রাকে না তুলতে পুলিশ আইন জারি করেছে। শোনা যাচ্ছে, তাদের ঘর ভাড়া দেওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য বাড়িওয়ালাদের বলা হচ্ছে। এসবই উৎপীড়নমূলক আইনকানুন। এসব আইন করার আগে আমরা যথেষ্ট বিবেচনা করেছি কি না সন্দেহ আছে। এ রকম হলে শরণার্থীরা ক্রমশ কালোবাজারের পণ্যে পরিণত হবে। দালালের দল সেই অপেক্ষায় আছে। আমরা না মানলেও এটা সত্য যে শরণার্থীদের দূর আত্মীয়স্বজন অথবা স্বজনের স্বজন বৃহত্তর চট্টগ্রামের আর বান্দরবানের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। স্বাভাবিক মেলামেশা আর চলাফেরায় বাধা দিলে চোখ ফাঁকি দিয়ে ‘দুর্গম’ পথে সেটা শুরু হবে।

নিবন্ধন-প্রক্রিয়া ত্বরিত আর জোরদার করলে শরণার্থীদের চলাচল পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখা সহজ হবে। শরণার্থীদের আগমনের পথগুলোর মুখেই নিবন্ধনের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনীয় জনবল লাগিয়ে দুই সপ্তাহের মধ্যেই এটা করা সম্ভব। কম্বোডিয়ায় বাংলাদেশের মানুষ গিয়ে সে দেশের সব নাগরিকের নিবন্ধনকাজ শেষ করেছিল স্বল্পতম সময়ের মধ্যে। এসব মানুষের বেশির ভাগ এখনো কর্মক্ষম আছেন এবং দেশেই আছেন। তাঁদের এ কাজে লাগানো যায়।

খাবার, পানি, ঘর, ঘটিবাটি, বালতি ছাড়াও শরণার্থীদের সুরক্ষার (প্রোটেকশন) ব্যবস্থা এখনো সেভাবে আমলে নেওয়া হচ্ছে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, শরণার্থীরা এসেছে প্রাণের ভয়ে। সেনা উৎপীড়নের দগদগে ঘা তাদের মন আর শরীরে জ্বলজ্বল করছে। অনেকেই পরিবারের লোকজন রেখে এসেছে। সবাই ফিরে যেতে চায়। কারও ফেরা হবে (হয়তো) সোজা পথে, কাউকে যেতে হবে ঘোরা পাথে। যাঁরা হরদম ছবি তুলছেন আর ছাপছেন, তাঁদের একটু সাবধান হতে হবে। বিশেষ করে নারী, শিশু আর কিশোর-কিশোরীদের ছবি ছাপানোর বেলায় সতর্কতা দরকার। ভুলে গেলে চলবে না, সে দেশের সব নাগরিকের নাম-ঠিকানা হাল সাকিন সরকারি নথিতে পুরোদস্তুর লিপিবদ্ধ আছে। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা মানুষের ছবি তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করতে পারে সামরিক বাহিনী আর তাদের সহযোগীরা।

বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি এক ভয়াবহ হুমকির মুখে। রাখাইন রাজ্যের মানুষ স্বাস্থ্যসেবার সুরক্ষা ছাতার আওতায় না থাকায় পোলিও, হাম, ডিপথেরিয়া, যক্ষ্মা ইত্যাদি রোগ সেখানে ডালভাত। মানুষ সেসব রোগ বা রোগের সম্ভাবনা সে দেশে রেখে এখানে আসছে না, বরং সঙ্গে করে নিয়ে আসছে। টিকা প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে জনস্বাস্থ্য রক্ষার সব ব্যবস্থা দ্রুত এবং কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটা ঠিক, উখিয়া, টেকনাফ ও কক্সবাজারের পানি সাগরে চলে যাবে, তবে রোগব্যাধির উজানে যাওয়ার আরও পরিবহন আছে। পোলিওমুক্ত এবং যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া-নিয়ন্ত্রিত একটা দেশে এগুলো আবার ফিরে আসার অনেক উদাহরণ আছে। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।