হাওর বার্তা ডেস্কঃ প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিরুদ্ধে সরকার ও সরকারি দলের আনা জুডিশিয়াল ডিজ-অনেস্টির অভিযোগের তদন্ত বা পরিসমাপ্তি বা নিষ্পত্তির আগেই ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছে সরকার। একটি রায় সরকারের মনোপূত না হওয়া ছাড়াও একজন প্রধান বিচারপতিকে ভিন্ন পথে হেনস্তার এক নতুন পন্থা সৃষ্টি হলো, যার নজির এর আগে ছিল না। প্রধান বিচারপতি সিনহা অবশ্য দুই মাস আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, তার অনুমতি ছাড়া বিচার বিভাগে নিয়োজিত কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতিবিষয়ক তদন্ত করা যাবে না। এখন তার নিজের বিরুদ্ধেই পেশাগত অসদাচরণের পাশাপাশি দুর্নীতির অভিযোগে নেমেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট। অধিকন্তু বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে ১২৬টি দুর্নীতিবিষয়ক অভিযোগ দুদকে জমা পড়েছে, যার প্রাথমিক কার্যক্রম দুদক শুরু করেছে বলে জানা যায়।
প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে মন্ত্রী-এমপিদের বক্তব্যে রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সব মহলে যখন আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে, ঠিক তখনই তার আয়-ব্যয়ের তদন্ত শুরু হয়েছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, প্রধান বিচারপতির পরিবারের আর্থিক বিষয়াদি খতিয়ে দেখছে রাজস্ব বোর্ড ও বাংলাদেশ ব্যাংক। বিচারপতি সিনহা হাইকোর্টে বিচারপতি হিসেবে শপথ নেয়ার আগে যথাযথভাবে আয়কর দিয়েছেন কি না তাও খতিয়ে দেখছে রাজস্ব বোর্ড। একই সাথে তার স্ত্রী, দুই মেয়ে ও তার শ্যালকের বার্ষিক আয়কর বিবরণী নিরীক্ষা করছেন তারা।
বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার দুই মেয়ে। একজন ভারতে, অন্যজন থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়। তারা কিভাবে চলেন, বাংলাদেশ থেকে বৈধ-অবৈধ পথে তাদের কোনো টাকা-পয়সা পাঠানো হয়েছে কি না, সে ব্যাপারে তদন্ত শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এনবিআরের চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ড যেকোনো ব্যক্তিরই আয়ের উৎস এবং তার আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্য খতিয়ে দেখতে পারে।’ এনবিআরের নথিতে দেখা যায়, বিচারপতি সিনহা ১৯৭৪ সালে সিলেটে আইন পেশা শুরু করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি হাইকোর্টে এবং ১৯৯০ সালে আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ১৯৯৯ সালের ২৪ অক্টোবর বিচারপতি সিনহা হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। আইনজীবী হিসেবে তিনি কত আয়কর দিয়েছেন, তা খতিয়ে দেখছে এনবিআর।
একই সাথে বিচারপতি হওয়ার পর তার আয়ের সাথে ব্যয়ের সামঞ্জস্য কতটা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিচারপতি সিনহার স্ত্রীর সম্পত্তি, জমিজমা, ব্যাংক হিসাব ইত্যাদির উৎস সস্পর্কেও খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। তার দুই মেয়েকে কিভাবে বিদেশে পাঠানো হলো, সে ব্যাপারেও অনুসন্ধান চলছে। বিচারপতি সিনহা ও তার পরিবার অবৈধপন্থায় কোনো অর্থ দেশের বাইরে পাঠিয়েছেন কি না সে ব্যাপারে তদন্ত শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট এ কাজ করছে। কেউ কেউ মনে করছেন, ষোড়শ সংশোধনীর রায় সরকারের বিপক্ষে যাওয়ায় প্রধান বিচারপতির ওপরব্ধ হয়ে সরকার এখন তার আয়-ব্যয়ের তদন্ত করছে।
দুর্নীতিবাজ আমলাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় খুব কম। তারা বিভিন্ন আইনের সূত্রে ‘রক্ষাকবচ পেয়ে যান’। আমলাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত করতে এখন সরকারের অনুমতি লাগে। অথচ দুদক নিজেই নানা অভিযোগে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের মতো। অথচ তদন্তের ক্ষেত্রে আমলানির্ভর দুদকের হাত সম্প্রসারিত করেছে বিচার বিভাগ। দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা ২০০৭ মোতাবেক তদন্তসংক্রান্ত কিছু বিষয়ে যেখানে সময় নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল, বিচার বিভাগ সে নির্ধারিত সময়কে ম্যান্ডেটরির (বাধ্যতামূলক) পরিবর্তে ডিসক্রিশনারি (স্বেচ্ছাধীন) টাইম বলে। ফলে দুদকের হাত হয়েছিল সম্প্রসারিত। দুদক আইন একটি নিবর্তনমূলক আইন। এটা দিয়ে দুদককে বানানো হয়েছে ‘দুধে ধোয়া তুলসীপাতা’ এবং অভিযুক্তদের বানানো হয়েছে ‘সমাজের নিকৃষ্ট জীব’।
দুদকের নোটিশ জারি হওয়ার আগেই দালাল অভিযুক্তদের বাড়িতে চলে যায় টাকার জন্য। ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে এর অনেক প্রমাণ দেয়া যাবে। টাকা ও ক্ষমতার বশে বশীভূত হওয়ার অনেক প্রমাণ রয়েছে। যারা টাকা দিতে পারে না তাদের ওপরে ক্ষমতাবানেরা খগড়হস্ত।
২০০৭ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালার অনুচ্ছেদ-১৭ মোতাবেক দুদক আইন ২০০৪-এর ধারা ২৬ অনুযায়ী সহায়ক-সম্পত্তি ঘোষণাবিষয়ক পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়েছে, যা নিরূপ : ‘কমিশন (দুদক) কোন তথ্যের ভিত্তিতে এবং উহার বিবেচনায় প্রয়োজনীয় তদন্ত পরিচালনার পর যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে, কোনো ব্যক্তি বা তাহার পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি, বৈধ উৎসের সহিত অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পত্তি দখলে রাখিয়াছেন বা মালিকানা অর্জন করিয়াছেন, তাহা হইলে কমিশন বা কমিশন কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কমিশনারের অনুমোদনক্রমে উপপরিচালক পদমর্যাদার নিনহেন এমন একজন কর্মকর্তা নিজ স্বাক্ষরে উক্ত ব্যক্তির নিকট হইতে তফসিলের ফরম-৫এ বর্ণিত ছক অনুযায়ী তাহার সম্পদ ও দায়-দেনার হিসাব সরবরাহের আদেশ জারি করিতে পারিবেন।’
কোনো ব্যক্তিই জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নন। ফলে প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান বিচারপতি জবাবদিহিতার আওতায় আসতেই পারেন। কিন্তু যেহেতু প্রধান বিচারপতি একটি প্রতিষ্ঠান, যিনি দেশের প্রধান বিচারপতি তার গুরুত্ব অনেক, তাই বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে অ্যাকশন (তদন্ত) হতে হবে। কিন্তু বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে তদন্ত ষোড়শ সংশোধনী রায় প্রকাশের পরে কেন করা হলো? এতে স্পষ্ট হয়, বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন নয়।
বিচারপতি সিনহা নিজেও বলেছেন, ‘সকলেই স্বাধীন একমাত্র আমি ছাড়া।’ এ কথা তিনি প্রধান বিচারপতির চেয়ারে বসে প্রকাশ্যে আদালতে দায়-দায়িত্ব নিয়েই বলেছেন। এ দেশে স্বাধীন বলা যায় সরকারপ্রধানকে। কারণ সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ মোতাবেক রাষ্ট্রপতিও প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ ছাড়া সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না। তা ছাড়া দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রধানমন্ত্রীর ওপর নির্ভরশীল দু’টি কারণে। প্রথমত, (আমলানির্ভর) সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো কাগজে-কলমে স্বাধীন হলেও ঔপনিবেশিক ভাবধারায় আমলাতন্ত্র গঠিত বলে মন-মানসিকতার ক্ষেত্রে এতই দুর্বল যে, তারা মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেন না। দ্বিতীয়ত, আমলাদের সুবিধামতো পোস্টিং ও প্রমোশন প্রধানমন্ত্রীর হাতে, যা পাওয়ার জন্য অনেক আমলা তাদের বিবেক বিসর্জন দিয়ে যন্ত্রের মতো কাজ করে; যেখানে আদর্শ ও ন্যায়নীতির বালাই নেই। আমলাদের কোথাও জবাবদিহি করতে হয় না, যদি সর্বাধিক ক্ষমতাবান তার ওপর সুদৃষ্টি রাখেন।
এ ছাড়া সরকারি দলের সাথে সুর মিলিয়ে প্রধান বিচারপতির এককালীন সহকর্মী, বন্ধুবর বিচারপতি এ এইচ এম শামসুুদ্দিন মানিক প্রধান বিচারপতি সিনহাকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘তুমি শুধু প্রধান বিচারপতির পদ ছাড়বা না, এই দেশ ছাড়তে হবে।’ বিষয়টি সম্বোধনের ক্ষেত্রে ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে গড়িয়েছে। মন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেছেন, ‘পার্লামেন্ট যদি অবৈধ হয়, তোমার নিয়োগও অবৈধ। কারণ এই পার্লামেন্ট রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেছে। সেই রাষ্ট্রপতি তোমাকে নিয়োগ দিয়েছে। তোমার নিয়োগ অবৈধ, তুমি অবৈধ চিফ জাস্টিস।’ স্মর্তব্য, এই বিচারপতি মানিক নিজেই একদিন জাতীয় সংসদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এখন কেন সাফাই গাইছেন? নিশ্চয়ই বিরোধটি তাদের ব্যক্তিগত। বক্তব্য রাষ্ট্রীয় ভাবমর্যাদা কতটুকু হেয়প্রতিপন্ন করে তা-ও ভেবে দেখার প্রয়োজন তারা মনে করেন না। যখন তাদের সম্বোধন ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে চলে যায়, এর চেয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য আর কী হতে পারে?
তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নয়, বরং সামরিক শাসন আনতে চাচ্ছেন প্রধান বিচারপতি।’ প্রকাশ্যেই বলা হচ্ছে, প্রধান বিচারপতি পাকিস্তানের দালাল। মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, ‘পছন্দ না হয় দেশ ছেড়ে চলে যান।’ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ করা উচিত।’ প্রধান বিচারপতিকে যদি এভাবে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়, স্বাধীন বিচার বিভাগ তো স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, স্বাধীন দুদকের মতোই কথিত স্বাধীন হতে বাধ্য হবে। তখন সংবিধানের মর্যাদা থাকবে কোথায়?
তাকে দেশ ছাড়ার যে হুমকি দেয়া হয়েছে, তা সবার আগে গভীর উদ্বেগের সঞ্চার করেছে। ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা’ নস্যাতে সফল হলে একনায়কতন্ত্র চেপে বসবে।