হাওর বার্তা ডেস্কঃ কমতে শুরু করেছে নদ নদীর পানি। কিন্তু বন্যার পানিতে এখনো চারদিক থৈ থৈ করছে। মানিকগঞ্জ জেলার কোন কোন ইউনিয়নে একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম হচ্ছে নৌকা। মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকায় শতবর্ষী নৌকার হাট ও জেলার ঘিওরে বৃহত্তম নৌকার জমে উঠেছে।
জেলার অধিকাংশ অঞ্চল চলতি বন্যায় তলিয়ে গিয়েছে পানিতে। অনেকে বন্যার পানি দ্রুত সরে যাবে ভেবে এতোদিন নৌকা না কিনে অন্যের নৌকায় অথবা কলাগাছের ভেলায় চলাচল করেছে। অাবার কয় দিন পরেই পবিত্র ঈদুল অাযহা। সকলের সাথে ঈদ করতে গ্রামে অাসতে শুরু করেছে লোকজন। তাই এ সময় চারদিকে পানি থাকায় নৌকার কদর বেড়ে গেছে। পানি স্থায়ী হওয়ায় নৌকা কিন্তে ঝিটকায় শতবর্ষী নৌকার হাট ও ঘিওরে বৃহত্তম নৌকার হাটে ভীড় করছে। ঘিওরে ঈদগা মাঠে সপ্তাহের প্রতি বুধবার ও ঝিটকায় প্রতি শনিবার হাটের দিন হলেও বন্যার কারনে সপ্তাহ জুড়েই ব্যাপক বিক্রি হচ্ছে নৌকা। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিক্রেতারা নৌকা সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখে হাটে।
মানিকগঞ্জে নদ নদীর পানি কমতে শুরু করলেও বর্ষার পানি থৈ থৈ করছে চার দিকে। বর্ষা এলেই নৌকার চাহিদা বেড়ে যায়, তাই নৌকা তৈরির শ্রমিকরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। জেলার ৭টি উপজেলার ৬৫ টি ইউনিয়নই এখন বর্ষার পানিতে নিমজ্জিত। অার বন্যার পানি না থাকলেও পদ্মা ও যমুনা, ধলেশ্বরী, কালিগঙ্গা ও ইছামতি নদীর তীরবর্তী মানুষদের নৌকা ছাড়া চলাচলের অন্য কোন মাধ্যম নেই। অপর দিকে চলতি বন্যায় জেলার ২ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
পানিবন্দি মানুষের বাহন নৌকা তৈরির কারখানার শ্রমিকরা এখন নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছে। আর জেলার হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকার শতবর্ষী নৌকার হাটও জমে উঠেছে। শনিবার এ নৌকার হাটে জেলার ঘিওর, হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা ছাড়াও ঢাকার দোহার নবাবগঞ্জ উপজেলাসহ পদ্মা ও যমুনার তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষ নৌকা কিনতে ভিড় জমাচ্ছে । প্রতিদিনই ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এ নৌকার হাট।
কড়ই, চাম্বুল, ওরিয়ান, লোহা, রেইন ট্রি, কদম, জিকা কাঠের ১০-১২ হাতের নৌকা বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার
থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত । এ হাটে ডিঙ্গি বা কোষা নৌকার চাহিদাই সবচেয়ে বেশী।
ঝিটকা বাজারের নৌকা তৈরির শ্রমিক লিয়াকত আলী জানায়, একটি নিম্নমানের কাঠের নৌকা একদিনেই তৈরি করতে পারলেও উন্নত মানের কাঠের নৌকা তৈরিতে সময় লাগে ২-৩ দিন। এ হাটে নৌকা সরবরাহ করার জন্য হরিরামপুর উপজেলার ২০-২৫ টি নৌকা তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানায় প্রায় ২ শতাধিক নৌকা তৈরির শ্রমিক কাজ করছে । অাবার হাটে সাভার থেকেও বেপারিরা নৌকা আনেন। সারা বছর অন্য কাজে ব্যস্ত থাকলেও বর্ষার ৩ মাস তাদের নৌকা তৈরির কাজ করে লাভবান হয় বেশি।
ঝিটকা হাটের নৌকা বেপারী রেজাউল করিম জানায়, ঝিটকার হাটের দিন ৫/৬ শতাধিক নৌকা বিক্রি হয় । তাছাড়া এ বছর বন্যার পানি বেশি থাকায় হাট ছাড়াও প্রতিদিন ভাল বিক্রি হচ্ছে নৌকা। হরিরামপুর উপজেলার গৌরিনাথপুর গ্রাম থেকে নৌকা কিনতে আসা রেজাউল করিম জানায়, বাড়ির চারদিকেই পানি, নৌকা ছাড়া কোথাও যাওয়া যায় না । তাই নৌকা কিনতে আসলাম।
নৌকা ব্যবসায়ী মুন্নু জানায়, চলতি বছরে ১০-১২ হাতের কোষা নৌকার চাহিদা সবচেয়ে বেশী, নিম্নমানের ১০-১২ হাতের নৌকা ২ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকার মধ্যেই পাওয়া সম্ভব। ৫ হাজার টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে ভালো মানের নৌকা পাওয়া যায়।
ঝিটকার নৌকা হাটে ক্রেতা ও বেপারীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, যারা প্রতি বছর বর্ষায় পানিবন্দি হয়ে পড়েন এ ধরনের ক্রেতারা বেশী দামের নৌকা
কিনেন । আর যারা অতিরিক্ত বন্যা হলে পানিবন্দি হয়ে পড়েন তারা এক মৌসুমের জন্য কম দামের নৌকা কিনেন ।
নৌকার তৈরির মহাজন সাইদুর জানায়, ১২ বছর ধরে নৌকা তৈরির ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করি। এ বছর বন্যার পানি বেশি হওয়ায় নৌকা বেশি বিক্রি হচ্ছে।
মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা ছাড়াও ঘিওর উপজেলায়ও নৌকার হাট জমে উঠেছে। জেলায় বর্ষা মৌসুমে নৌকার চাহিদা মিটায় হরিরামপুরের ঝিটকা ও ঘিওর উপজেলার নৌকার হাট। মানিকগঞ্জ জেলার বৃহত্তম নৌকার হাট ঘিওরে ভিড় করছে মানুষ নৌকা কিনতে। ঘিওর উপজেলার চার ইউনিয়নের ২০ গ্রাম ও দৌলতপুরের দুর্গম এলাকায় বর্ষায় নৌকা ছাড়া চলাফেরা করা সম্ভব নয়।
উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় এখনো পারাপারে পুরোদমে ব্যবহার হচ্ছে ডিঙ্গি নৌকা। নৌকাশিল্পের জন্য বিখ্যাত ঘিওরের কারিগরদের তৈরি নৌকা এ উপজেলার চাহিদা মিটিয়ে বিক্রি হচ্ছে হরিরামপুর, শিবালয়, দৌলতপুরসহ বিভিন্ন এলাকায়। নৌকা তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় কাটছে মিস্ত্রিপাড়ার নারী-পুরুষদের।
বর্ষায় মানিকগঞ্জের ঘিওর, দৌলতপুর, শিবালয় ও হরিরামপুর উপজেলার বেশ কয়েকটি এলাকায় পানি উঠে গেছে। রাস্তাঘাট ভেঙে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। বর্ষার পানি জমেছে বাড়ির আঙিনায়। এ সময় এসব অঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের একমাত্র বাহন হয়ে ওঠেছে নৌকা।
অন্যান্য বছরের মতো এবারো বর্ষার ঘিওর উপজেলা সদরের প্রধান ঈদগাহ মাঠের নৌকা বিক্রির হাট জমজমাট হয়ে উঠেছে। ওই হাটে ক্রেতাদের জন্য থরে থরে সাজানো রয়েছে বাহারি কয়েক শ’ নৌকা।
ঘিওর বাজারের কাঠমিস্ত্রি রবি সূত্রধর, নিলকমল সূত্রধর, মাসুদ ও হারেছ জানায়, বর্ষা মওসুমে তারা নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত। সপ্তাহে তাদের কারখানা থেকে ৮-১০টি নৌকা ঘিওর, দৌলতপুর, বরংগাইল, তরা ও মহাদেবপুর হাটে বিক্রি করা হয়। বর্তমানে লোহা ও কাঠের দাম বেড়ে যাওয়ায় নৌকা তৈরিতে খরচ বেড়েছে। নৌকার আকার ও প্রকারভেদে তিন থেকে পনের হাজার টাকায় বিক্রি হয়। তবে লাভের অংশ আগের থেকে কমে গেছে।
ঘিওরের বানিয়াজুড়ি, বালিয়াডাঙ্গা, সিংজুড়ি ও বেগুন নারচি, দৌলতপুর উপজেলার জিয়নপুর, বাঁচামারা, বাঘুটিয়া, চরকাটারি, খলসি, ধামশ্বর, কলিয়া ও বিনোদপুর এবং শিবালয়ের কয়েকটি গ্রামের মানুষ বর্ষায় জমায়েত হন ঘিওরের নৌকার হাটে। সপ্তাহের প্রতি বুধবার হাটের দিন হওয়ায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিক্রেতারা নৌকা সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখেন। এ ছাড়াও প্রায় সারা সপ্তাহজুড়েই কমবেশি বিক্রি হয় নৌকা।
ঘিওর হাটে নৌকা বিক্রেতা খগেন সূত্রধর জানায়, ১০ হাত লম্বা এবং দুই হাত প্রস্থের একটি নৌকার মূল্য তিন হাজার থেকে তিন হাজার ২০০ টাকা। এরকম ১১/৩ সাইজের নৌকা চার হাজার, ১২/৩ সাইজের সাড়ে চার হাজার, ১৩/৩ সাইজের পাঁচ হাজার, ১৪/৩ সাইজের সাড়ে পাঁচ হাজার এবং ১৫/৩ সাইজের নৌকা বিক্রি করেন ছয় হাজার টাকায়। এ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের স্টিলের নৌকা বিক্রি করেন তিনি।
দৌলতপুর উপজেলার বাচামারা এলাকার সিরাজ প্রামাণিক জানায়, প্রতি বছর বর্ষায় তার একটি করে নৌকা কিনতে হয়। তবে এ বছর নৌকার চাহিদা বেশি থাকায় দাম একটু বেশি বলে জানান তিনি।