হাওর বার্তা ডেস্কঃ অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধ করে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারকে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে বলেছে যুক্তরাষ্ট্র। গতকাল শুক্রবার মার্কিন সিনেটের এক যৌথ প্রস্তাবে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত দলকে মিয়ানমারে যাওয়ার অনুমতি দিতে এবং আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়।
এ ছাড়া মার্কিন কংগ্রেসের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান এড রয়েস মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অং সান সু চিকে চিঠি লিখেছেন। চিঠিতে তিনি রাখাইনে সহিংসতার জন্য অভিযুক্তরা সরকার বা সেনাবাহিনী—যার সঙ্গেই জড়িত থাকুক না কেন, তাদের বিচার করতে বলেন।
বাংলাদেশের সাবেক ও বর্তমান কূটনীতিক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, চলমান রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র একধরনের শক্ত বার্তা দিয়েছে মিয়ানমারকে। এবার শুধু রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়া বা রাখাইনে রাখতে নিরাপদ পরিবেশের কথা বলেই যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক মহল থেমে থাকেনি; বরং রোহিঙ্গা সমস্যার মূল উৎস নাগরিকত্বের ওপরও জোর দিয়েছে। মার্কিন এই অবস্থান বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গতিশীল যোগাযোগের মাধ্যমে সমর্থন আদায়ের ক্ষেত্র তৈরি করেছে বলে মত দিয়েছেন তাঁরা।
জাতিসংঘের তদন্ত দলকে কাজ করতে দেওয়া, আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন এবং রাখাইনে সহিংসতায় যুক্ত লোকজনের বিচার—এ তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আর এই তিন ক্ষেত্রেই মিয়ানমার এ পর্যন্ত সবকিছু উপেক্ষা করে চলেছে। বিশেষ করে আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন আর রাখাইনে অক্টোবরের হত্যাযজ্ঞের তদন্ত সামনে এনেছেন মার্কিন রাজনীতিকেরা।
রাখাইনে দুই সপ্তাহ ধরে সহিংসতা চলতে থাকায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাপ ধীরে ধীরে বাড়ছে। কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড ও আন্তর্জাতিক উন্নয়নমন্ত্রী মারি ক্লদ বিবু গতকাল এক বিবৃতিতে গভীর নিন্দা জানিয়েছেন। রাখাইনের নিরপরাধ লোকজনের ওপর সহিংসতার নিন্দা জানানোর পাশাপাশি তাদের জন্য ২০ মিলিয়ন ডেনিশ ক্রোনার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ডেনমার্কের আন্তর্জাতিক উন্নয়নমন্ত্রী উলা টোরনাস। আর রাখাইন থেকে প্রাণ বাঁচাতে আসা রোহিঙ্গাদের সাময়িক আশ্রয় নিশ্চিত করার আশ্বাস দিয়েছে মালয়েশিয়া। ইরান বলেছে, রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ পাঠাতে তারা প্রস্তুত আছে।
এদিকে রোহিঙ্গাদের হত্যা-নির্যাতন ও দেশ থেকে বিতাড়নের প্রতিবাদে গতকাল বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ হয়েছে। বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোতে পবিত্র জুমার নামাজের পর বিক্ষোভ হয়। অনেক দেশে এসব বিক্ষোভের লক্ষ্য ছিল সেখানে মিয়ানমারের দূতাবাস। ভারতের চেন্নাই ও অমৃতসর, আফগানিস্তানের কাবুল, ইরানের তেহরান, ফিলিপাইনের ম্যানিলা, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর, ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা ও জাপানের টোকিওতে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ করে বলে খবর পাওয়া গেছে।
রোহিঙ্গা পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, রাখাইনের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন বিপুল সংখ্যায় বাংলাদেশে চলে আসায় সীমান্তবর্তী এলাকায় নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সেখানে খাবারসহ অন্যান্য মানবিক সহায়তা দেওয়ার জন্য সরকার সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এরই মধ্যে পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝতে পারছে। তারা বিষয়টি সমাধানের ওপর জোর দিচ্ছে।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, বাংলাদেশ আশা করে, মিয়ানমারের নাগরিকেরা শিগগির তাদের দেশে ফিরে যাবে। এক দেশের নাগরিক অন্য দেশে থাকাটা যে সম্মানজনক নয়, তা মিয়ানমারকে বুঝতে হবে।
নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) গতকাল বলেছে, রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশ পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে পাওয়া হত্যা, শেল নিক্ষেপ ও তাদের গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনার বর্ণনায় ‘জাতিগত নিধনের’ সব উপাদানই আছে। মিয়ানমারের সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং লায়েং সে দেশের গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, রাখাইন রাজ্যে সরকার অনুমোদিত সামরিক অভিযান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের সময়কালের ‘অসমাপ্ত কাজ’।
এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের উচিত জরুরি সভা ডেকে মিয়ানমারকে বলে দেওয়া যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নৃশংস নিপীড়ন বন্ধ না হলে দেশটি চরম নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়বে।