বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ পরিস্থিতি ক্রমশ ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা ইতোমধ্যে বাংলাদেশে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছে। অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় সীমান্তে রয়েছে আরো বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা।
বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে মিয়ানমারের সঙ্গে যৌথভাবে চেষ্টা করছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে বিভিন্ন মাধ্যমে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
এদিকে মিয়ানমারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলাকারী আরএসও এবং আল একিনের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেছে বিজিবি।
মিয়ানমারের সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ নতুন কিছু নয়। সম্প্রতি মিয়ানমারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লাগাতার অভিযানের মুখে গত শুক্রবার সকাল থেকেই রোহিঙ্গারা নতুন করে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করছে। প্রথমদিকে বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থানে থাকলেও সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেই অবস্থান অনেকটা শিথিল হয়েছে। এ অবস্থায় গত চার দিনে প্রায় ৬ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। আরো ১০ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের সুযোগ নিতে সীমান্তে জিরো পয়েন্টে অবস্থান করছে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার ন্যাশনাল প্রোগ্রাম অফিসার সৈকত বিশ্বাস বলেন, মিয়ানমারে সহিংসতা হলেই বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে রোহিঙ্গারা। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রতিদিনই কিছু কিছু রোহিঙ্গা রাতের আঁধারে বাংলাদেশে ঢুকে উখিয়ার বালুখালী, কুতুপালং অনিবন্ধিত শরণার্থী শিবির ও বিভিন্ন বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। বতর্মানে সীমান্তবর্তী বান্দরবানের ঘুমধুম থেকে শুরু করে টেকনাফের হোয়াইক্ং পর্যন্ত আট কিলোমিটার এলাকায় সীমান্তের জিরো পয়েন্টে প্রায় ১০ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা অবস্থান করছে।
বান্দরবানের ঘুমধুম ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশ সীমান্তে আশ্রয় নেওয়া বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার খাবারের কোনো ব্যবস্থা নেই। আমরা মানবিক দিক বিবেচনা করে কেক, কলা, মুড়ি, চিড়া ও পানি খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছি। তবে সবাইকে দেওয়ার মতো সামর্থ্য আমাদের নেই।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার জামতলী পয়েন্টে ১ হাজার, তমব্রু পয়েন্টে ৩ হাজার, করিডোর পয়েন্টে দেড় হাজারসহ আরো অন্তত ৮ হাজার রোহিঙ্গা বিজিবির কর্ডনের মধ্যে রয়েছে। শনিবার মধ্যরাতে বাংলাদেশে প্রবেশের পর তাদের সেখানেই আটকে দেওয়া হয়েছিল। সোমবার দুপুর পর্যন্ত ওসব পয়েন্টে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা ত্রিপল টাঙিয়ে অবস্থান করছে।
উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের মহিলা সদস্য পারভিন আকতার বলেন, শুক্রবার থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত কয়েক হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। শনিবার রাতে প্রায় ১ হাজার রোহিঙ্গা নারী ও শিশু বাংলাদেশে ঢুকে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নজরদারি সত্বেও বান্দরবানের ঘুমধুম, তমব্রু, করিডোর, চাকমা পাড়া, উখিয়ার থাইংখালী, ধামনখালী এলাকা দিয়ে ১০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে দ্বিপাক্ষিকভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান বান্দরবানের জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক।
তিনি বলেন, এটি দুটি রাষ্ট্রের ব্যাপার। চাইলেই এর সমাধান করা যায় না। এখানের সমস্ত কিছু সরকারকে অবহিত করছি। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে পুলিশ চেকপোস্ট এবং সেনা ক্যাম্পে হামলার ঘটনায় অভিযুক্ত সন্ত্রাসী সংগঠন আরএসও এবং আল একিনের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেছে বিজিবি। সেই সঙ্গে মিয়ানমারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মুখে এসব সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্যদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তরক্ষী এ বাহিনীর পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে কঠোর ব্যবস্থা।
বিজিবির ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান বলেন, আল একিন ও আরএসও মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ। বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় আরএসও কিংবা আল একিনের কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়নি এবং হচ্ছে না। এ ব্যাপারে আমরা সবর্দা সতর্ক আছি। এ ধরনের কোনো কর্মকাণ্ড আমরা করতে দেব না, এটা আমাদের ডিউটি। এ ছাড়া আমাদের ডিউটি আন্তর্জাতিকভাবে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা।
বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারে সীমান্ত রয়েছে প্রায় ২০০ কিলোমিটার। এর মধ্যে টেকনাফে ৫২ কিলোমিটার, উখিয়ায় ১৬ কিলোমিটার এবং বাকি সীমান্ত বান্দরবান এলাকায়। বর্তমানে বাংলাদেশে বসবাস রয়েছে অন্তত ৫ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা।
কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে উখিয়া হয়ে বান্দরবানের নেত্রাংছড়ি পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ১০টি পয়েন্ট রয়েছে। যেখানে সীমান্ত থেকে লোকালয়ের দূরত্ব মাত্র কয়েক শ গজ। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন শুরু হলেই রোহিঙ্গারা সহজেই বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে।
এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সবচেয়ে জরুরি মিয়ানমার সরকারের সদিচ্ছা। মিয়ানমারের সদিচ্ছার অভাবেই এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হয়নি।