ঝিনাইদহের ঐতিহাসিক বারো আওলিয়ার বারোবাজার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বারো আওলিয়ার বারোবাজার কালীগঞ্জ শহর থেকে ১৭ কিলোমিটার দক্ষিণে। যশোর জেলা শহর থেকে ১১ মাইল উত্তরে, ঢাকা খুলনা মহাসড়কের দুই ধারে শত শত পুকুর ও দিঘির স্বচ্ছ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঢেউ, বুড়ি ভৈরব নদীর তীরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমতি ঐতিহাসিক মসজিদ পরিবেষ্টিত এই বারোবাজার। বারোজন আওলিয়ার নামানুসারে এখানকার নামকরণ করা হয় বারোবাজার। আওলিয়ারা হলেন এনায়েত খাঁ, আবদাল খাঁ, দৌলত খাঁ, রহমত খাঁ, শমসের খাঁ, মুরাদ খাঁ, হৈবত খাঁ, নিয়ামত খাঁ, সৈয়দ খাঁ, বেলায়েত খাঁ ও শাহাদত খাঁ। আওলিয়ার নামে শুধু বারোবাজার নয় পার্শ্ববর্তী অন্কে গ্রাম-গঞ্জের নাম আওলিয়াদের নামানুসারে রাখা হয়েছে।

কিংবদন্তি আছে বঙ্গ বিজয়ী বীর ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি নদীয়া দখলের পর নদীয়ার দক্ষিণ বা দক্ষিণ পূর্বে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের দিকে মনোযোগী না হয়ে উত্তর দিকে বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। ফলে তার জয়ী রাজ্য উত্তরদিকে প্রশস্ত হতে থাকে। পরিশেষে সামছুদ্দিন ইলিয়াস শাহের পৌত্র নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহর শাসনামলে যশোর ও খুলনার কিংবদ তার রাজ্যভূত হয়। ওই অঞ্চলে বিজয়ের গৌরব অর্জন করেন বৃহত্তর খুলনা জেলার বাগেরহাটের পরশমণি শ্রেষ্ঠ আওলিয়া হযরত খান জাহান আলী। তিনি ১৬৫৯ সালে (৮৬৩) হিজরী ২৩ অক্টোবর ইহধাম ত্যাগ করেন। তিনি এক সময় নিজের আত্মরক্ষার্থে একটি ক্ষুদ্র সেনাবাহিনীর অধিনায়ক হয়ে কুষ্টিয়া জেলার দৌলতগঞ্জ প্রবেশ করেন। সেখান থেকে বৃহত্তর যশোর জেলার কোটচাঁদপুর উপজেলার হাকিমপুর হয়ে বারোবাজার অভিমুখে রওনা দেন। পথিমধ্যে জনসাধারণের পানীয় জলের তীব্র কষ্ট দেখে তিনি এ অঞ্চলে অগণিত দিঘি আর পুকুর খনন করেন। কিংবদন্তি আছে, একই রাতে এ সব জলাশয় খনন করা হয়েছিল। ফলে বারোবাজার অঞ্চলে ৮৪ একর পুকুর ও দিঘি এখনো বিদ্যমান। এ অঞ্চলে ১৮টি উল্লেখযোগ্য দিঘির নামানুসারে জানা যায়, পীরপুকুর ৪ একর, গোড়ার পুকুর ৫ একর, সওদাগর দিঘি ১১ একর, সানাইদার পুকুর ৩ একর, সাতপীরের পুকুর ৩ একর, ভাইবোনের দিঘি ৪ একর, আনন্দ ২ একর, গলাকাটা দিঘি ৪ একর, জোড়াবাংলা দিঘি ৩ একর, চোরাগদা দিঘি ৪ একর, মাতারানী দিঘি ৮ একর, নুনো গোলা দিঘি ৩ একর, কানাই দিঘি ৩ একর, পাঁচ পীরের দিঘি ৩ একর, মনোহর দিঘি ৩ একর, আদিনা দিঘি ৩ একর, শ্রীরাম রাজার দিঘি ১০ একর ও বেড় দিঘি ৮ একর। সর্বমোট ৮৪ একর দিঘি।

এক সময় হযরত খানজাহান আলী বেলাট দৌলতপুরের পূর্ব দিকে বাদুগাছা গ্রামের প্রভাবশালী শ্রীরাম রাজাধীরাজের মুখোমুখি হয়ে পড়েন। এবং কিটুটা বাধাগ্রস্ত হন। ফলে তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচারে অধিক উৎসাহী হয়ে এই বারোবাজারে এক যুগকাল অবস্থান করেন। তার দৃঢ় মনোবল উদারতা, দানশীলতা ও মাহনুবভতায় এলাকাবাসী মুগ্ধ হয়ে পড়েন। এলাকার অনেক অমুসলিম ইসলাম ধর্ম গ্রহণে ঝুঁকে পড়েন। এভাবে এক যুগ অবস্থানের পর তিনি এক শিষ্যের তত্ত্বাবধানে দিয়ে শেষ জীবন বাগেরহাটে অতিবাহিত করেন।

খানজাহান আলীর এক যুগ সাধনার স্থাপত্য নিদর্শন রয়ে গেছে এই বারোবাজারে। বারোবাজারে অনেক মসজিদ মাটির নিচ থেকে পাওয়া যায়। এর মধ্যে সাতগাছিয়া মসজিদ, গলাকাটা মসজিদ, জোড়বাংলা মসজিদ, মনোহর মসজিদ, গোড়ার মসজিদ, পীরপুকুর মসজিদ, শুকুর মল্লিক মসজিদ, নুনপোলা মসজিদ, পাঠাগার মসজিদ। এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় নিদর্শন ৩২ গম্বুজবিশিস্ট সাতগাছিয়া আদিনা মসজিদ ও বারোবাজার গলাকাটা দিঘির ৬ গম্বুজবিশিস্ট একটি মসজিদ। যে মসজিদটি অনন্তকাল ধরে মাত্র দুটি ভিত্তির ওপর দণ্ডায়মান রয়েছে। এছাড়াও এখানে রয়েছে অগণিত মসজিদ। যে কোনো মাটি ঢিপি সরালেই মসজিদের সন্ধান পাওয়া যায়। যার অনেকগুলো ইতিমধ্যে আবিষ্কার করে আংশিক সংস্কারও করা হয়েছে। এখনো অনেক মসজিদ মাটির নিচে রয়েছে বলে ধারণা করা যায়। কারণ এ পর্যন্ত যতগুলো মাটির ঢিবি সরানো হয়েছে ততগুলো মসজিদের সন্ধান পাওয়া গেছে।

কিংবদন্তি আছে বহুকাল আগে এই বারোবাজার যুদ্ধে অথবা মহামারিতে জনশূন্য হয়ে পড়ে। এরপর এখানে বারোজন আওলিয়ার আগমন ঘটে এবং তখন থেকেই সৃষ্টি হয়েছে অগণিত মসজিদ, পুকুর আর দিঘি। জলাশয়ের ঘটনাগুলো জনসাধারণ উপলব্ধি করলেও মসজিদগুলো মাটির ঢিবির নিচে থাকায় এর গুরুত্ব এতদিন কেউ উপলব্ধি করতে পারেনি। কারণ প্রতিটি জলাশয়ের পাশেই অবস্থিত একটি করে মসজিদ। আর সেই মসজিদের সিঁড়ি জলাশয় পর্যন্ত পাকা করা ছিল। এসব পাকা সিঁড়ির ওপর প্রায় ৮-১০ ফুট পর্যন্ত মাটি চাপা পড়ে জনসাধারণের দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে গিয়েছিল।

সরকারের খুলনাস্থ প্রত্নতত্ত্ব দফতরের কর্মকর্তারা কয়েক বছর আগে এখানে ক্যাম্প স্থাপন করে কিছু মসজিদ ও পাকা সিঁড়িগুলো আবিষ্কার করেছেন। এ ছাড়াও কয়েকটি মসজিদ সংস্কার করেছেন। এসব ঐতিহাসিক স্থানগুলো সংরক্ষণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তপেক্ষ প্রয়োজন বলে এলাকাবাসী মনে করেন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর