হাওর বার্তা ডেস্কঃ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন একাত্তরের দুঃসাহসিক কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর-উত্তম। তিনি তাঁর মুক্তিযোদ্ধা সহকর্মীদের নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার প্রতিবাদে সশস্ত্র লড়াইয়ে নামেন। তিনি তখন জেলা গভর্নর। ২২ আগস্ট ছয়জন সঙ্গী নিয়ে জামালপুর সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঢোকেন তিনি। সেখানে গিয়ে ‘হত্যাকারী অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে’ সশস্ত্র প্রতিরোধের ডাক দেন। টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ অঞ্চলের বিপুলসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা এবং ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মী ভারতে গিয়ে যোগ দেন কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা থেকেও অনেকে যান।
পঁচাত্তরের অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে এই বাহিনীর একটি গ্রুপ যমুনা নদী হয়ে নৌপথে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার নিশ্চিন্তপুর চরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে তাঁদের সম্মুখযুদ্ধ হয়। এতে বগুড়া জেলা যুবলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আব্দুল খালেক খসরু নিহত হন। পরে তাঁরা সেখান থেকে পিছু হটে টাঙ্গাইল হয়ে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সীমান্ত এলাকায় চলে যান।
পথে হালুয়াঘাটে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ হয়। হালুয়াঘাট সীমান্তে গিয়ে গোবড়াকুড়া গ্রামে আদিবাসী গারো প্রবোধ দিওর বাড়িতে প্রতিরোধব্যূহ (ডিফেন্স) তৈরি করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে গ্রুপটি। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ভারতের তিন মাইল ভেতরে চান্দুভূই নামক স্থানে প্রতিরোধযোদ্ধাদের হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা হয়। বাহিনীর নামকরণ করা হয় ‘জাতীয় মুক্তিবাহিনী’। এ বাহিনীর লোগো ও ব্যাজে ব্যবহার করা হয় বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ নির্বাচিত হন কাদের সিদ্দিকী। এ ছাড়া ৩৬ জনকে এই বাহিনীর কমান্ডার করা হয়।
ছিয়াত্তর সালের আগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে জাতীয় মুক্তিবাহিনী ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করে। বাহিনীর পক্ষ থেকে ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করে অনেকগুলো সশস্ত্র গ্রুপকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অ্যাকশনে পাঠানো হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে এসব গ্রুপের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যুদ্ধ হয়। এতে জাতীয় মুক্তিবাহিনীর বেশ কয়েকজন নিহত, আহত ও গ্রেপ্তার হন। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় বিশ্বজিৎ নন্দীর নেতৃত্বে একটি গ্রুপ টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কে বানারপাড়া সেতু আক্রমণ করে। পরদিন তাদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে চারজন শহীদ হন। গুলিবিদ্ধ হয়ে বিশ্বজিৎ নন্দী গ্রেপ্তার হন। সামরিক আদালতে তাঁর ফাঁসির আদেশ হয়। ১৪ বছর কনডেম সেলে কাটিয়ে নব্বই সালে মুক্তি পান তিনি।
কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীর তৎপরতা আতঙ্ক ছড়ায় ক্ষমতাসীনদের মধ্যে। গোয়েন্দা নজরদারি, গ্রেপ্তার বেড়ে যায়। বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী প্রথম বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বরে কাদেরিয়া বাহিনী ঢাকায় অভিযান চালাতে পারে—এ আশঙ্কায় ব্যাপক সতর্কতা অবলম্বন করে সরকার।
১৯৭৭ সালে ভারতের নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস হেরে যায়। ক্ষমতায় আসেন মোরারজি দেশাই। নতুন সরকার জাতীয় মুক্তিবাহিনীকে তাদের দেশের মাটি ব্যবহার করতে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। জাতীয় মুক্তিবাহিনীর প্রধান কাদের সিদ্দিকীকে আলোচনার কথা বলে মেঘালয়ের তুরায় নিয়ে গিয়ে নজরবন্দি করা হয়। বাহিনীর অন্য সদস্যদের চান্দুভূই হেডকোয়ার্টারে বিএসএফ সদস্যরা ঘিরে রাখে। একপর্যায়ে সাতাত্তরের মে মাসে প্রতিরোধযোদ্ধাদের বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বাহিনীপ্রধান কাদের সিদ্দিকীসহ নেতৃস্থানীয় কয়েকজন নেতাকে আশ্রয় দেয় ভারত সরকার। আর এর মধ্য দিয়েই সমাপ্তি ঘটে এ লড়াইয়ের।
ইতিহাসের জঘন্যতম এই হত্যাকাণ্ডের পরপর শুরু হওয়া সেই সশস্ত্র যুদ্ধ চলেছে সাতাত্তর সালের মে মাস পর্যন্ত। প্রায় দুই বছর ধরে চলা এই প্রতিবাদসংগ্রামে শহীদ হন শতাধিক। পঙ্গুত্ব বরণ করেন শত শত জন। প্রায় ছয় হাজার জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়। তাঁরা অবর্ণনীয় নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হন।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা এ আন্দোলনে ছিল অন্যতম প্রধান শক্তি। যোদ্ধাদের ৩০ শতাংশই ছিল তারা। শহীদ যে ৮৬ জনের নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে, এর মধ্যে ২৫ জনই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে গড়ে ওঠা সশস্ত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও সমর্থন জানানোর অপরাধে সাধারণ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যদের সে সময় অনেক নির্যাতন, হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। অনেকে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন।