হাওর বার্তা ডেস্কঃ দুর্ঘটনার এক যুগ পরও সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার টেংরাটিলা পরিত্যক্ত গ্যাসফিল্ডের আশপাশ এলাকা ও বাড়িঘর এবং টিউবওয়েল দিয়ে বুদ্বুদ আকারে গ্যাস বের হচ্ছে। দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে যত্রতত্র গ্যাস উদ্গীরণ। দুর্ঘটনার এক যুগেও ক্ষতিপূরণ পায়নি ক্ষতিগ্রস্তরা।
মঙ্গলবার সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার মোছা. নাজমুন আরা খানুম, সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলাম টেংরাটিলা এলাকা পরিদর্শন করেছেন।
এখনো গ্রামের বিভিন্ন টিউবওয়েলে চাপ দিলে উদ্গীরণ হয়। কেউ আগুন ধরিয়ে দিলে উদ্গীরিত গ্যাসে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। টেংরাটিলা গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে ও গ্যাসফিল্ডের পাশের গ্রামের বিভিন্ন পুকুর, জমি, রাস্তা ও বাড়িঘরের ফাটল দিয়েও বুদবুদ আকারে গ্যাস বেরোচ্ছে। এতে টেংরাটিলা গ্রামের মানুষ আবারো আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
গ্রামের ইউপি সদস্য আব্দুল মতিন জানান, গ্রামের বাবর আলীর বাড়িসহ গ্রামের প্রায় সব বাড়িরই বিভিন্ন ফাটল দিয়ে গ্যাস উদ্গীরণের কারণে বিভিন্ন প্রজাতির গাছপাতা ঝরে কাণ্ড শুকিয়ে মরে যাচ্ছে।
ইউপি সদস্য আরো জানান, টেংরাটিলা গ্রামের রশিদ আলীর বাড়ির টিউবওয়েল দিয়ে অনবরত গ্যাস উদ্গীরণ হচ্ছে। টিউবওয়েল দিয়ে যেমন নিচে পানি পড়ছে, তেমনি ওপর দিয়ে গ্যাস উদ্গীরণ হচ্ছে। উদ্গীরিত এ গ্যাসের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। একইভাবে গ্রামের বাবর আলীর বাড়ির উঠানের বিভিন্ন ফাটল দিয়ে বুদ্বুদ আকারে গ্যাস বের হচ্ছে।
গ্রামের মেহেরুন নেছা জানান, রাতে বসতঘরের দরজা বন্ধ করলে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। তাই বাধ্য হয়ে ঘরের জানালা খুলে ঘুমাতে হয়।
এদিকে গ্রামের বিভিন্ন পুকুরে ছোট ছোট পাইপ ফেলে এবং উঠানে পুতে রান্নার কাজে অপরিকল্পিতভাবে উদ্গীরিত গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে। এ গ্যাসকে গ্রামের লোকজন কাসেম গ্যাস বলে অবিহিত করেছেন। কারণ গ্রামের কাসেম আলী প্রথমে এ গ্যাসের ব্যবহার করেন।
টেংরাটিলা রক্ষা আন্দোলন কমিটির আহ্বায়ক আজিম উদ্দিন জানান, গ্রামের প্রায় অর্ধশতাধিক পরিবার অপরিকল্পিতভাবে বাড়ির উঠানে ও পুকুরে ছোট ছোট প্লাস্টিকের পাইপ পুঁতে রেখে রান্নার চুলোয় গ্যাস ব্যবহার করছে।
আজিম উদ্দিন আরো জানান, বিভিন্ন সময়ে সরকারের বিভিন্ন প্রতিনিধি দল টেংরাটিলায় আসলে টেংরাটিলাবাসী ক্ষতিপূরণের দাবি জানায়। কিন্তু তারা এখনো ক্ষতিপূরণ পায়নি। বারবার শুধু আশ্বাস পেয়ে আসছে।
টেংরাটিলা বাজারের ফিসফিড ব্যবসায়ী মনিরুজ্জামান কাজল জানান, টেংরাটিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের রাস্তা ও জমির বিভিন্ন ফাটল দিয়ে বুদ্বুদ আকারে গ্যাস বের হচ্ছে। এতে সব সময়ই এলাকায় গ্যাস আতঙ্ক রয়েছে।
টেংরাটিলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক ফরিদ উদ্দিন মাস্টার জানান, গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ড্রোন নিয়ে মি.এক্সিন ও খ্রিস্টিনার নেতৃত্বে আরো ৩ বিদেশি বিশেষজ্ঞ পরিত্যক্ত গ্যাসফিল্ডের বিভিন্ন ছবি ও নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে গেছেন। ড্রোনের সঙ্গে বিদেশি ১৩ জনের বিশেষজ্ঞ দল ৪ ভাগে বিভক্ত হয়ে কাজ করেন। একটি দল টেংরাটিলা এলাকায় গ্যাস উদ্গীরণের ফলে কি কি রোগ এলাকাবাসীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে তার তথ্য সংগ্রহ করছেন। দ্বিতীয় দলের সদস্যরা এলাকার উদ্গীরিত গ্যাস, পানি ও মাটির নমুনা এবং তৃতীয় দলের সদস্যরা গ্যাস সিপেজ’র ছবি ও নমুনা এবং মৎস্য সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ এবং চতুর্থ দল ড্রোনের মাধ্যমে গ্যাসক্ষেত্রে ছবি ও বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করছেন। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসী এখনো জানে না তার ফলাফল কি দেয়া হয়েছে।
দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তারেক মোহাম্মদ জাকারিয়া জানান, সচেতনতার জন্য গ্যাসফিল্ডের এলাকায় সাইনবোর্ড দেয়া হয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে গ্যাস ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাপেক্স বা জালালবাদ গ্যাস কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিলে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের সহযোগিতা করা হবে।
ইউএনও আরো জানান, উপজেলার সুরমা ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে ইতিপূর্বে জনসচেতনতার জন্য এলাকায় মাইকিং করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি ও ২৪ জুন দু’দফা বিস্ফোরণে গ্যাসফিল্ডের প্রোডাকশন কূপের রিগ ভেঙে প্রচণ্ড গর্জন এবং ভয়াবহ কম্পনসহ ২০০ থেকে ৩০০ ফুট পর্যন্ত আগুন ওঠানামা করতে থাকে।
দুই দফা বিস্ফোরণে গ্যাসফিল্ডের মাটির ওপরে ৩ বিসিক গ্যাস পুড়ে যাওয়া এবং ৫.৮৯ থেকে কমপক্ষে ৫২ বিসিক গ্যাসের রিজার্ভ ধ্বংস হওয়াসহ আশপাশের টেংরাটিলা, আজবপুর, গিরীশনগর, কৈয়াজুরি ও শান্তিপুরের মানুষের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত ও পরিবেশের ক্ষতি হয়। বিস্ফোরণের পর আশপাশের মানুষের সামান্য ক্ষতিপূরণ দিয়ে কিছুদিন পরই নাইকো তাদের সরঞ্জামাদি নিয়ে গ্যাসক্ষেত্র থেকে চলে যায়।