র্যাগিং করলে আজীবনের জন্য বহিষ্কারসহ কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে- গত ৩০ মার্চ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সংবাদ বিজ্ঞপ্তি জারি করে এ ঘোষণা দেয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এ হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও বন্ধ হয়নি র্যাগিং। আর এর শিকার হচ্ছে মূলত প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা। ছাত্রদের আবাসিক হলগুলোতে প্রথম বর্ষের (৪৪তম ব্যাচ) শিক্ষার্থীদের ওপর গভীর রাত পর্যন্ত চলে র্যাগিং। বিভিন্ন হলের অতিথি কক্ষে অথবা গণরুমে রাত ১০টা থেকে শুরু করে ভোর পর্যন্ত র্যাগিংয়ের নামে চলছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।
সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে গত সোমবার রাত ৩টায় মওলানা ভাসানী হলে। সেখানে র্যাগিংয়ের নামে প্রথম বর্ষের ১৭ শিক্ষার্থীকে বেদম পিটিয়েছে ছাত্রলীগের কর্মীরা। নির্যাতিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে একজনকে রাত সাড়ে ৩টায় এবং আরেকজনকে পরের দিন সকালে বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যাল সেন্টারে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। নির্যাতনের কথা কাউকে না বলতে ওই ১৭ জনকে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতিও দেখিয়েছে ছাত্রলীগকর্মীরা। ঘটনার দুই দিন পার হলেও গতকাল বুধবার পর্যন্ত দোষীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সোমবার রাত ১২টায় মওলানা ভাসানী হলের প্রথম বর্ষের (৪৪তম ব্যাচ) শিক্ষার্থীদের হলের অতিথি কক্ষে ডেকে পাঠায় হল শাখা ছাত্রলীগের দ্বিতীয় বর্ষের (৪৩তম ব্যাচ) ছাত্রলীগকর্মীরা। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা হাজির হলে ‘বেয়াদবি’র অভিযোগ তুলে ৮০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থীকে গালাগাল করে ছাত্রলীগকর্মীরা। এ সময় তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও হলের ছাত্রলীগকর্মী সোহেল অতিথি কক্ষে ঢুকে ‘বেয়াদবি’ করার জন্য প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের মারধরের নির্দেশ দিয়ে যায়। তখনকার মতো প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের বিদায় করে দিয়ে রাত ২টায় ফের সবাইকে একসঙ্গে জড়ো হতে বলে ছাত্রলীগকর্মীরা। তারা জড়ো হলে রাত ৩টায় হলের ১১৪ নম্বর কক্ষের (গণরুম) ১৭ শিক্ষার্থীকে ৩০১ নম্বর কক্ষে ডেকে পাঠায় ছাত্রলীগের কর্মীরা। ১৭ শিক্ষার্থী সেখানে গেলে তাদের পর্যায়ক্রমে মারধর করতে থাকে ছাত্রলীগকর্মীরা। প্রথমে চলে চড়, থাপ্পড়, কিল, ঘুষি, লাথি। এরপর কয়েকজনকে লোহার রড ও ক্রিকেট খেলার স্টাম্প দিয়ে পেটানো হয়। এ সময় পেছনে থাকা অন্য শিক্ষার্থীদের বিষয়টি ভালো করে দেখার কথা বলে তারা।
গভীর রাতে ডেকে নিয়ে ১৭ শিক্ষার্থীকে বেদম মারধর
নির্যাতনের শিকার পাঁচ শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানায়, “রাত ৩টায় আমাদের ৩০১ নম্বর রুমে ডেকে পাঠায় ছাত্রলীগের কর্মীরা। সেখানে গেলে তারা ‘বেয়াদবি করছস’ বলেই আমাদের একেকজনকে ডেকে প্রথম চড়, থাপ্পড়, কিল, ঘুষি মারতে শুরু করে। এমনকি বেশ কয়েকজনকে রড আর স্টাম্প দিয়েও মারধর করে তারা। পেটে লাথি লাগায় সাদিক (প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, ৪৪তম ব্যাচ) গুরুতর আহত হয়, লিমনের (পদার্থবিজ্ঞান, ৪৪তম ব্যাচ) বাঁ চোখের ওপরে ফেটে গিয়ে রক্ত পড়তে থাকে। পরে তাদের দুজনকে বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসাকেন্দ্রে নেওয়া হয়।”
নির্যাতিত শিক্ষার্থীরা জানায়, হল শাখা ছাত্রলীগের কর্মী ইয়াছিন (দর্শন বিভাগ), বাবু, রাকিব (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ), শুভ (নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ), আবির (ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ), মনির (গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা বিভাগ) এবং আসিফ (প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ) রড ও স্টাম্প দিয়ে শিক্ষার্থীদের মারধর করে। এ সময় ছাত্রলীগকর্মী আসিফ (পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ), রাফি (আইন ও বিচার বিভাগ) এবং রাব্বিও সেখানে ছিল। তারা সবাই দ্বিতীয় বর্ষের (৪৩তম ব্যাচ) শিক্ষার্থী।
নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটছে তাদের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আহত এক শিক্ষার্থী কালের কণ্ঠকে বলে, ‘নিজেকে মানুষ মনে হচ্ছে না। বিনা অপরাধে কোনো মানুষ অন্য মানুষকে এভাবে মারতে পারে!’ আরেক শিক্ষার্থী বলে, ‘প্রচণ্ড আতঙ্কের মধ্যে সময় পার করছি। নিজেকে অবাঞ্ছিত মনে হচ্ছে। বাসায় শুনলে সবাই দুশ্চিন্তা করবে, তাই বাসায়ও কিছু বলতে পারছি না।’ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন কি না- জানতে চাইলে নির্যাতিত একাধিক শিক্ষার্থী বলে, ‘এই মুহূর্তে কারো সঙ্গে কথা বলতেই ভয় পাচ্ছি। প্রশাসনের কারো কাছে কিছু বললে সেটা যদি হলে জানাজানি হয় তাহলে আমাদের অবস্থা আরো খারাপ হবে।’
ছাত্রলীগের দুই পক্ষের বিরোধের জের ধরে গত এপ্রিলে মওলানা ভাসানী হল শাখা ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের গণশিক্ষাবিষয়ক উপসম্পাদক দিদার হোসেন হলে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দেন। গতকাল বুধবার যোগাযোগ করা হলে তিনি র্যাগিংয়ের অভিযোগ অস্বীকার করেন।
তবে ওই ১৭ শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনার বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন মওলানা ভাসানী হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. সৈয়দ হাফিজুর রহমান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ ধরনের কিছু হয়েছে কি না আমি জানি না। আমার কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি। আপনি আমাকে একটু খুলে বলুন আসলে কী হয়েছিল?’
এর আগে গত ২০ মে বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সালাম বরকত হলের ২২৩ নম্বর কক্ষে র্যাগিংয়ের নামে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র সারজিল ইমতিয়াজের ডান পা ভেঙে দেয় ওই হলের ছাত্রলীগ কর্মী কৌশিক বসাক, বিকাশ কুমার মহন্ত, অর্ণপ দত্ত ও মাকসুদুর রহমান। তারা লোহার রড, পাইপ ও স্টাম্প দিয়ে সারজিলকে বেধড়ক মারধর করে। সারজিলকে মারধরের সময় রড, স্টাম্প দিয়ে কয়টি আঘাত করা হচ্ছে, তা গুনতে আরেক শিক্ষার্থীকে নির্দেশ দেয় ছাত্রলীগকর্মীরা। মারধর শেষে তারা হিসাব করে দেখে চারজনে মিলে ৩০টি আঘাত করেছে। পরে সহপাঠীরা সারজিলকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করতে চাইলেও ছাত্রলীগকর্মীরা বাধা দেয়। ২১ মে সকালে হলের প্রাধ্যক্ষের হস্তক্ষেপে সারজিলকে সাভারের সিআরপিতে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। সহপাঠীরা জানায়, ছাত্রলীগকর্মীরা তাদের সামনে সিগারেট খেতে সারজিলকে মানা করেছিল। সেই নিষেধ অমান্য করায় তাকে এমনভাবে নির্যাতন করা হয়।
শহীদ সালাম বরকত হলের শিক্ষার্থীরা জানায়, শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে ছাত্রলীগ আয়োজিত কর্মসূচিতে যোগ দিতে গত ১৭ মে হলের নবীন শিক্ষার্থীদের ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে যাওয়া হয়। উদ্যানে ভিড়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মোসাব্বিরুল সাব্বির ও সাদমান সৌমিকের জুতার ফিতা ছিঁড়ে যায়। এ সময় তারা ছাত্রলীগকর্মীদের না জানিয়ে জুতা ঠিক করাতে যায়। এ কারণে পরদিন রাত ১১টার দিকে সাব্বির ও সৌমিককে বেধড়ক মারধর করে ছাত্রলীগকর্মী কৌশিক সরকার।
ছাত্রলীগকর্মীদের নির্দেশ অনুযায়ী মাথা ন্যাড়া না করায় শহীদ সালাম বরকত হলের প্রথম বর্ষের (লোক প্রশাসন বিভাগ) শিক্ষার্থী মাহবুব সরকারকে গত বুধবার রাতে মারধর করে ছাত্রলীগকর্মী বিকাশ কুমার মহন্ত। একই দিনে চুলে ‘আর্মিকাট’ না দেওয়ায় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী জানে আলমকেও মারধর করে সে।
এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ রফিক জব্বার হল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, আ ফ ম কামাল উদ্দিন হল, মীর মশাররফ হোসেন হলসহ ছেলেদের হলগুলোতে গভীর রাত পর্যন্ত অতিথি কক্ষে বা গণরুমে র্যাগিং চলছে বলে অভিযোগ করেছে সংশ্লিষ্ট হলগুলোর শিক্ষার্থীরা। এমনকি ছাত্রীদের কোনো কোনো হলেও চলে র্যাগিং।
আজীবন বহিষ্কারের নিয়মেও থামছে না র্যাগিং : গত ৩০ মার্চ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দেয়। সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তারা জানায়, ‘র্যাগিংয়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা অধ্যাদেশ অনুযায়ী আজীবন বহিষ্কারসহ কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। এ ছাড়া অভিযুক্ত ব্যক্তিকে রাষ্ট্রীয় আইনের আওতায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে সোপর্দ করা হবে।’
ওই বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ‘র্যাগিং একটি জঘন্য সামাজিক ব্যাধি। এই ঘৃণ্য আচরণ দ্বারা ব্যক্তির অপূরণীয় শারীরিক-মানসিক ক্ষতি হতে পারে। র্যাগিং নাগরিক অধিকার পরিপন্থী, বেআইনি ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ ছাড়া দৈহিক/মানসিক পীড়ন, যেকোনো ধরনের অশোভন আচরণ, কারো অধিকারে হস্তক্ষেপ/কর্তব্যকর্ম থেকে বিরত রাখার চেষ্টা/মত প্রকাশে বাধাদান, জোরপূর্বক কোনো রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী করা এবং রাজনৈতিক সংগঠনে যুক্ত হতে বাধ্য করা, কারো সামাজিক/মানবিক মর্যাদাহানিকর কর্মকাণ্ড, চাঁদাবাজি, মুক্তিপণ, ঘুষ বা যেকোনো ধরনের আর্থিক অনাচার, বলপ্রয়োগ, আইনের দৃষ্টিতে অন্যান্য অপরাধ র্যাগিং হিসেবে গণ্য হবে।
তবে এই কঠোর ঘোষণা সত্ত্বেও বন্ধ হচ্ছে না র্যাগিং। শিক্ষার্থীরা বলছে, হল প্রশাসনের তদারকির অভাবে র্যাগিংয়ের ঘটনা ঘটছে।
১৭ শিক্ষার্থীকে নির্যাতনের বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি মর্মাহত, এটি খুবই দুঃখজনক। বর্তমান প্রশাসন র্যাগিং বা শারীরিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু আমাদের একার পক্ষে এটি বন্ধ করা সম্ভব নয়। এতে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। এটি মারাত্মক একটি অপরাধ। শিক্ষার্থীদের মারধরের বিষয়টি নিয়ে আমি ওই হলের প্রভোস্টসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলেছি। অভিযোগ প্রমাণিত হলে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’