লোককথায় এক চোরা পাখি আছে, যে কিনা মানুষের ঘরদোর থেকে সোনা-রুপার গয়না আর চকচকে দামি জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে যায়। ইউরোপের লোককথায় এই চরিত্র ‘চোরা ম্যাগপাই’ হিসেবে বহুল জনপ্রিয়। লোককথার মতোই গানে, কবিতায়, অপেরায়, প্রবাদ-প্রবচনে মানুষের দুনিয়াদারিতে মিশে আছে এই ‘চোরা পাখি’র চরিত্র। কিন্তু ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ম্যাগপাই আসলে চকচকে জিনিস-পাতি চুরি করে না। মানুষ কি এখন ম্যাগপাইকে ‘চোরা পাখি’ বলা বন্ধ করে নিজের ‘দুনিয়াদারি’র গল্পগুলো পালটাবে?
ম্যাগপাই সোনা-রুপার গয়না বা চকচকে জিনিস চুরি করে—এ ধারণা লোককথার মতোই গানে, কবিতায়, অপেরায়, প্রবাদ-প্রবচনে মানুষের দুনিয়াদারিতে মিশে আছে। এ নিয়ে অনেক ছবিও আঁকা হয়েছে।যুক্তরাজ্যের এক্সেটার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা গেছে, ম্যাগপাই পাখি আসলে চকচকে জিনিস দেখে ভয় পায়; মূলত সেগুলো নতুন এবং বিপজ্জনক হতে পারে বলে মনে করে। এই গবেষণায় ধাতব স্ক্রু, ফয়েলের আংটি এবং অ্যালুমিনিয়ামের ছোট চৌকো টুকরোসহ নানা চকচকে জিনিস ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি এমন কিছু জিনিসে নীল রঙের প্রলেপ দিয়েও রেখে দেওয়া হয় একই সঙ্গে। পাখিদের খাবার দিয়ে প্রলুব্ধ করার জন্য বাদামের পাশে ফেলে রাখা হয় এসব জিনিস।
আলাদা আলাদা স্থানে মোট ৬৪টি এমন পরীক্ষায় দেখা গেছে, ম্যাগপাইরা এসে বাদাম খেলেও মাত্র দুইবার চকচকে জিনিস তুলে নিতে গেছে এবং সঙ্গে সঙ্গেই সেগুলো ফেলে দিয়েছে। পাখিগুলো সব জায়গাতেই এসব চকচকে ও নীল রঙের জিনিস এড়িয়ে গেছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই এগুলোর উপস্থিতির কারণে কম খেয়েই চলে গেছে।
গবেষক দলের প্রধান ডক্টর টনি শেফার্ড বলেছেন, ‘ম্যাগপাইয়ের মধ্যে চকচকে জিনিসের জন্য কোনো শর্তহীন আকর্ষণ খুঁজে পাইনি আমরা। বরং ওদের মধ্যে নতুন জিনিসের বিষয়ে ভীতি দেখা গেছে।’ এই বিজ্ঞানী আরও বলেন, ‘মনে হচ্ছে ম্যাগপাইকে ঘিরে থাকা লোককথাগুলো আসলে আমাদের সংস্কৃতিতে অতি সাধারণীকরণের ফল, প্রমাণসাপেক্ষ কিছু নয়।’
ম্যাগপাই আসলেই চকচকে জিনিস চুরি করে কি না—এমন খোঁজখবর করতে ‘সেন্টার ফর রিসার্চ ইন অ্যানিমেল বিহেভিয়র’-এর বিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের উদ্যোগে এ গবেষণা চালানো হয়। এ প্রসঙ্গে গবেষক দলের নেতা শেফার্ড বলেন, ‘কিছু পাখি বাসা বানানোর সময় চকচকে জিনিস ব্যবহার করে সম্ভাব্য শিকারি প্রাণীদের তাড়ানোর জন্য। কিন্তু আমরা কয়েক ডজন ম্যাগপাইয়ের বাসা দেখেও চকচকে কিছু পাইনি। তাই আমরা এটা ভাবছি না যে ম্যাগপাই বাসা বানানোর জন্য হলেও চকচকে জিনিস চুরি করে।’
এ গবেষণার ফল ঘিরে মনোবিজ্ঞানীদের আলোচনায় যে বিষয়টি সামনে উঠে এসেছে তা হলো—মানুষ এখনো জেনেশুনে ম্যাগপাইকে ‘চোরা পাখি’ বলে ডাকবে কি না? ইউরোপীয় সমাজ-সংস্কৃতিতে বিষয়টি এতটাই গভীরে গেঁথে আছে যে, ‘কলিন্স’-এর ইংরেজি অভিধানে ম্যাগপাইয়ের বিকল্প একটা অর্থ হলো—‘যে ব্যক্তি ছোটখাটো জিনিস চুরি করে।’ অভিধানের এই শব্দ কি পাল্টানো হবে? কিংবা রোসিনির বিখ্যাত অপেরা ‘লা গাজ্জা লাদরা’ বা ‘চোরা ম্যাগপাই’-এর নাম ও কাহিনি কি পাল্টানো হবে? যে অপেরায় একের পর এক রুপার জিনিস চুরির অপরাধে এক গৃহপরিচারিকাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, কিন্তু পরে দেখা যায় আসলে একটা ম্যাগপাই সেগুলো চুরি করেছে। এই গবেষণায় বিব্রত হয়ে পড়তে পারেন বিখ্যাত কমিক সিরিজ টিনটিনের প্রকাশকও। কেননা তাঁদের একটা গল্পেও দেখানো হয়েছে একটা ম্যাগপাই পাখি একটা পুরস্কারের রত্ন চুরি করে নিয়ে যায়।
মানুষ একটা পাখিকে ‘নাম দেওয়া’ বা তাকে ‘চোরা’ অভিধা দেওয়া নিয়ে বিচলিত হবে কি না—সে প্রশ্নের উত্তর হয়তো কেবল ভবিষ্যত্ই দিতে পারে। তবে, বিজ্ঞানীরা এও জানিয়েছেন যে গবেষণাটিকে এখনই পূর্ণাঙ্গ বলা যাবে না। কেননা, গবেষকেরা এখনো কেবল ‘বিবাহিত’ ম্যাগপাইয়ের ওপর এই গবেষণা চালিয়েছেন। ‘ব্যাচেলর’ বা অবিবাহিত ম্যাগপাইদের এ গবেষণার আওতায় রাখা যায়নি। বিবাহিত ম্যাগপাইদের ঘরবাড়িতে চকচকে জিনিস লাগে না। ফলে চুরির স্বভাব থেকে থাকলে তা হয়তো ব্যাচেলরদের ওপর বর্তাতে পারে। তাহলে কি ব্যাচেলর ম্যাগপাইয়েরা সম্ভাব্য সঙ্গীকে প্ররোচিত করার জন্য সোনা-রুপার আংটি চুরি করে নিয়ে যায়!