হাওর বার্তা ডেস্কঃ বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের উপর দিয়ে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ যখন আঘাত হানে তখন ৫ লাখ মানুষের ঘরবাড়ি বিনষ্ট হয়। গত জুন মাসে বাংলাদেশের কক্সবাজারের কুতুপালং’এর বাসিন্দা খোরশেদা জানান, আরো অনেকের মত ঘূর্ণিঝড়ে তার বাড়িঘর বিনষ্ট হয়নি, ক্ষেতের ফসল তলিয়ে গেছে। এর কয়েক সপ্তাহ পর দক্ষিণ চীনের হিমালয় এলাকার ১২ মিলিয়ন মানুষকে বন্যার তোড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়। ২০১০ সালের এক হিসেবে বাংলাদেশে প্রতিবছর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক, রেল ও পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা মেরামত করতে ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন পড়ে। এবছর চীনের দক্ষিণপূর্বাঞ্চলের ঝিয়াঝি প্রদেশে বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৩০ মিলিয়ন ডলার। এর পাশের প্রদেশ হিউনানে ৫৩ হাজার ঘরবাড়ি বিনষ্ট হয়েছে।
আবহাওয়াগত পরিবর্তনে দক্ষিণ এশিয়ার এসব উন্নয়নশীল লাখ লাখ মানুষকে বিপদজনক পরিস্থিতিতে ফেলেছে। আগামী ৩০ বছরে এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২০ ভাগ বৃদ্ধি পাবে। অস্ট্রেলিয়ার কমনওয়েলথ সাইন্টিফিক এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ অর্গানাইজেশনের আবহাওয়া বিজ্ঞানী দেইয়ি কিরোনো বলেন, দক্ষিণ এশিয়া ইতিমধ্যে আশঙ্কাজনকভাবে বিশ্বের অন্যতম উষ্ণতম এলাকায় পরিণত হয়েছে। বছরে এ এলাকায় গড়ে ১ হাজার মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হচ্ছে। প্রবল বৃষ্টিপাতজনিত আকস্মিক বন্যায় ভারত, বাংলাদেশ ও চীনের উপকূল অঞ্চলে ১৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষকে বিপদে ঠেলে দিয়েছে। এশিয়া-প্রশান্ত এলাকার আরো অনেক বেশি মানুষ এধরনের বিপদের মুখে পড়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার এসব দেশের গ্রামাঞ্চল থেকে প্রচুর মানুষ যেমন শহরে আসছে, সেই সাথে ব্যাপক অপরিকল্পিত শহরায়নে নিষ্কাশন ব্যবস্থা
অনুন্নত থেকে যাচ্ছে। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ভিজির্টি ফেলো পল সায়ারস বলেন, এক সময়ের সবুজ মাঠ এখন জনবসতিতে পরিণত হয়েছে। নদী, খাল, বিল ভরাট হয়ে ভবন উঠছে, বৃষ্টি বা বন্যার পারি সরে যেতে পারছে না। ১৯৫০ সাল থেকে বিশ্বে সর্বাধিক ২২ লাখ মানুষ বন্যার কারণে মারা গেছে চীন, ভারত ও বাংলাদেশে। আহতের সংখ্যা আরো বেশি। বেলজিয়ামের ইউনিভার্সিটি ক্যাথলিক ডি লুভেইন’র জরিপ আরো বলছে, ১৯৫৯ সালে চীনে বন্যায় কুড়ি লাখ মানুষ মারা যায়।
বিশ্বের আবহাওয়া বিশ্লেষণে প্রধান প্রতিষ্ঠান আইপিসিসি বলছে, বিশ্বে বন্যায় এশিয়ায় সর্বাধিক অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। অনেক শহর মৃত জনপদে পরিণত হচ্ছে। বাংলাদেশ ও ভারতের ৫০ ভাগ ও চীনের ২৫ ভাগ মানুষ গঙ্গা,ব্রহ্মপুত্র ও ইয়ংতেজ নদীর বন্যা কবলিত অববাহিকায় বাস করছে যা বিশ্ব জনসংখ্যার ১৪ ভাগ। শুধুমাত্র চীনের সাংহাই বন্যা কবলিত সমভূমি, উর্বর মাটি যেখানে সহজেই নদীর পানি গড়িয়ে যায় সে এলাকার উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ দেশটির জিডিপির ৪০ ভাগের সমান। এশিয়ার অধিকাংশ বড় শহরগুলো যেসব নদীর অববাহিকায় রয়েছে, বন্যা হলে তা সহজেই প্লাবিত হয়ে পড়ে। পানি নিষ্কাশনের প্রাকৃতিক উপায় বিনষ্ট হওয়াই এর প্রধান কারণ। বিশ্বব্যাংকের নগর বিশেষজ্ঞ আবহাস জাহ বলেন, এসব শহরে চাহিদা অনুসারে পয়:নিষ্কাশন খাতে টেকসই বিনিয়োগ হয় না।চীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও সেতুং যখন ১৯৭৬ সালে মারা যান তখন দেশটির ১৭ ভাগ মানুষ শহরে বাস করলেও এখন বাস করছে ৫৬ ভাগ। বিশ্বব্যাংকের আরেক হিসেবে ভারতে ৩৩ ভাগ মানুষ শহরে বাস করছে। বৃষ্টির পানি গড়িয়ে যাওয়ার খাল, বিল ও খোলা মাঠ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পর তা এখন বন্যায় রুপান্তরিত হচ্ছে। এর সঙ্গে বাড়তি যোগ হয়েছে আবহাওয়ার পরিবর্তন।
৫ বছর আগে মুম্বাই, সাংহাই, হ্যানয়, বেইজিং , ফনম পেনহ সহ এশিয়ার প্রধান শহরগুলোয় যে বন্যা হত এখন তারচেয়ে অনেক বেশি বন্যা হচ্ছে, উষ্ণতা বেড়েছে, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃষ্টি আগের চেয়ে অনেক বেশি আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। এক ঘন্টা বা এক দিনের বৃষ্টি সামাল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বৃষ্টিই বন্যার একমাত্র কারণ না হলেও তা শহরগুলোর অচল ও ভূগর্ভে ভঙ্গুর নিষ্কাশন ব্যবস্থার ওপর বিষয়টি নির্ভর করছে। বিপদজনক পরিস্থিতি ভয়ানক প্রাণঘাতিময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। এক থেকে আধা ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধি পানিবাহিত রোগ সৃষ্টি করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শহরে নাগরিকদের কাছ থেকে পানি দূরে রাখা বা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার জন্যে শারীরিক পরিকাঠামো তৈরির বিকল্প নেই। রোগ সম্পর্কে পূর্বাভাস ও সবুজায়ন প্রকল্পকে অন্যতম সহায়ক বিনিয়োগ মনে করা হচ্ছে। রোগ পূর্বাভাসে ১ ডলার ব্যয় করলে তা রোগাক্রান্ত হওয়ার পর ৮ ডলার খরচকে বাঁচাতে পারে। তবে এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের পরিমাণ ঢের বেশি। চীন ‘স্পঞ্জি সিটি’ প্রকল্পে বৃষ্টির পানি ধরে যথাযথ ব্যবহারে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে। চীন, বাংলাদেশ ও ভারতের বন্যা ব্যবস্থাপনায় সমন্বয় আনাও জরুরি।
ওয়েস্ট অব ইংল্যান্ড ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক জেসিকা ল্যামন্ড মনে করেন, শহরে পানি মোকাবেলা কোনো আদর্শ উপায় হতে পারে না। শহর সেখানেই গড়ে তোলা উচিত যেখান থেকে পানি সহজে গড়িয়ে অন্যত্র যেতে পারে। সিএনএন’এর এ প্রতিবেদনটি করেছেন বেন ওয়েস্টকট ও স্টিভ জর্জ।-আমাদের সময়