ঢাকা ০৫:০১ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৪ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভরা বর্ষায় হাওরে

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৭:১৫:৪২ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৫ জুলাই ২০১৭
  • ২৭৯ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ জুন মাসের শেষ দিকে আমরা কজনা বেরিয়ে পড়লাম হাওরে দুরাত থাকব বলে। রূপাবই নামে একটি বড় নৌকাকে বানালাম বাড়ি। নয়জন আমরা, সঙ্গে রূপাবইয়ের একজন গাইড, একজন মাল্লা ও একজন রন্ধনশিল্পী। থাকাখাওয়া এই নৌকাতেই। দিনের বেলায় বোটে করে সারা দিন ঘুরে বেড়ানো, পথেই কোনো বাজারে বা জেলের কাছ থেকে মাছ কিনে নেওয়া। সবাই যখন চোখ ভরে নদী-হাওরের মিলনস্থল, অতি দূরের বসতি কিংবা পাহাড় আর মেঘের মিলনমেলা দেখছে, তখনই বোটের একেবারে পিছন দিকে রান্নাঘরে তৈরি হচ্ছে সদ্য কেনা মাছের ঝোল, ডাল, সবজি। রন্ধনশিল্পী দয়াপরবশ হয়ে একদিন একই সঙ্গে ভাজা আর রান্না মাছ খাওয়ালেন। একবাক্যে আমরা সবাই স্বীকার করে নিলাম, তাজা মাছের স্বাদই আলাদা। রাতে মাছ নয়, মাংস। এক রাতে মুরগি, অন্য রাতে রাজহাঁস।
প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙত খিচুড়ি আর ডিমভাজির গন্ধে। সেই সঙ্গে ঝাল আমের আচার। তোফা এক ভোজ!
সুনামগঞ্জ পর্যন্ত পানি চলে এসেছে, তাই আমাদের আর সুনামগঞ্জ থেকে স্থলপথে তাহিরপুর যেতে হলো না। রাতে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে সুনামগঞ্জ। রূপাবইয়ের কর্ণধারদের একজন ডা. রাজন আগেই বলে দিয়েছিলেন কোথায় কীভাবে যেতে হবে, তাই যাত্রাপথ নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছিল না মনে।
শাপবাড়ি ঘাট থেকে জল কেটে যখন আমরা যাত্রা শুরু করলাম, তখনো জানতে পারিনি, সামনের তিনটি দিন সোনার আলোয় ভরিয়ে দেবে আমাদের। সুরমা নদীর তীর চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে গেলে চারদিকে শুধু দিগন্তহীন পানি, মনে হচ্ছিল এ বুঝি আমাদের সমুদ্রযাত্রা। আকাশে তখন প্রচণ্ড তাপ ছড়ানো সূর্য। রাগী সূর্যের নিচে বসে সকালের নাশতা করা একেবারেই অসম্ভব, তাই আমাদের প্রথম খিচুড়ি-ডিম পরিবেশিত হয় রূপাবইয়ের খোলের ভেতর, যেখানে স্পঞ্জের আসন পেতে জায়গাটাকে মসৃণ করা হয়েছে।
প্রথম গন্তব্য শুখাই জমিদারবাড়ি। ৩০০ বছর আগের জমিদারবাড়িটি এখনো টিকিয়ে রেখেছে তার অস্তিত্ব, কিন্তু তা এতটাই জরাজীর্ণ যে সেখানে বসবাসের কথা ভাবতে পারে না কেউ। পাশেই দুটো টিনের বাড়ি উঠিয়ে নিয়েছেন জমিদার বংশের দুই সদস্য, যাঁদের মধ্যে নীলকমল বাবু এখনো থাকেন এই গ্রামেই।
তাঁর কাছ থেকে জমিদারির ইতিহাস শুনে গ্রামটা ঘুরে আসার পর নীলকমল রায় বললেন, ‘আপনারা চাইলে রাতে এখানে গান শুনতে পারেন।’
লোভনীয় প্রস্তাব। কিন্তু আমরা তো সূর্যাস্ত দেখব টাঙ্গুয়ার হাওরে। এরপর আবার এখানে ফিরে আসা কঠিন। গাইড বেলালের সঙ্গে কথা বলে আমরা ঠিক করে নিই, রাত ১০টার পর বোটেই বসবে গানের আসর। হারমোনিয়াম, মন্দিরা হলো বাদ্য। সঙ্গে থাকবে একটা প্লাস্টিকের বালতি, যার বাদন হাওরের মধ্যে নাকি অন্য এক আবেদন সৃষ্টি করে।
সে রাতে পূর্ণিমা ছিল। সে রাতে গান হয়েছিল। সে রাতের হাওর বর্ণে-গন্ধে-গীতিতে-ছন্দে আমাদের হৃদয়ে দিয়েছিল দোলা।

জাদুকাটা নদী
যে দৃশ্য গাঢ় হয়ে আছে আমাদের চোখে, সেটা জাদুকাটা নদী। পাতলাই, বউলাই নদ পেরিয়ে জাদুকাটা নদীর কাছে এসে লক্ষ করি, পাল্টে গেছে দেশের চেহারা। ওই দূরে, বহুদূরে দেখা যাচ্ছে মেঘালয়ের পাহাড়। সে পাহাড়ের গায়ে গুটিসুটি মেরে ঘুম দিচ্ছে মেঘের দল।
গাইড বেলাল ভাইকে জিজ্ঞেস করি, ‘পাহাড়টা কি ভারতে?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমরা কি কাছাকাছি যেতে পারি না?’
যাওয়ার জন্যই যে নদীর তীরে নোঙর ফেলা হবে, সে কথা বুঝিয়ে বললেন বেলাল। জানালেন, উঠে যেতে হবে বারেক টিলায়। সেখানে রয়েছে বাংলাদেশ আর ভারতকে বিভাজন করা সীমান্ত পিলার।
খাড়া পথ ধরে কিছুটা এগিয়ে গেলে কিছুটা সমতল ভূমি। সেখানে বেশ কিছু দোকান। পুরি, শিঙাড়া আছে। ভাতও রান্না হচ্ছে। নৌকা ঠেকিয়ে খাড়া পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে পর্যটকের দল। বারেক টিলার ওপরে উঠলেই ছুমন্তর ছু—অন্য জগৎ যেন এক!
মেঘলা হয়ে এসেছিল আকাশ। বারেক টিলার ওপরে ওঠার আগেই বৃষ্টি! প্রবল বৃষ্টি। প্রথমে সবাই ঠাঁই নিল চায়ের দোকানে। তারপর একে একে অনেকেই বেরিয়ে এল বৃষ্টিতে ভিজবে বলে। পাহাড়ের ওপর থেকে ডান দিকে ওই দূরে দেখা যাচ্ছে জাদুকাটা নদী। আর বাঁ দিকে দৃষ্টিসীমার মধ্যেই কিছুটা দূরে সেই সীমান্ত পিলারটি। আমরা সেদিকেই এগিয়ে যাই। প্রবল বর্ষণে মেঠো পথটা পিচ্ছিল। কিন্তু মেঘের কাছাকাছি যাওয়ার জন্য আমাদের ‘অভিযাত্রী’ দলটি সে বাধা মানছে না। পাহাড়ের পর পাহাড় দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। এভাবেই দূরের একটা পাহাড় আর আমাদের নয়, সেটা ভারত। ১২০৩ নম্বর সীমান্ত পিলারের দুধারে দুই পা রেখে আমাদের দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য শৌনক একটা অদ্ভুত কথা বলে, আমরা অবাক হই।
ও বলে, ‘আমি এখন একই সঙ্গে দুটো দেশে অবস্থান করছি। আমার এক পা বাংলাদেশের সীমান্ত পিলারের এপাশে, অন্য পা ভারতের দিকে। তার মানে আমি একই সঙ্গে দুটো টাইমজোনে আছি। এক পায়ে বাংলাদেশের সময়ে আমি, অন্য পায়ে ভারতের। আমার দুই পায়ের মধ্যে আধঘণ্টা পার্থক্য!’
চা খেতে খেতে আমরা জেনে নিই, এটা হিন্দু-মুসলমানের এক অপার ভালোবাসায় ঘেরা এলাকা। এখানে শ্রীশ্রী অদ্বৈত প্রভুর ধামে গঙ্গাস্নানে আসেন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। হজরত শাহ আরফীন (রা.)-এর মেলায় আসেন মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ। সাধারণত মার্চে হয় এই স্নান ও মেলা। তখন এ পাহাড়ে ঢল নামে মানুষের। 
হাওর আমাদের চোখ খুলে দেয়। ইন্দ্রপুর গ্রাম কিংবা আদিবাসী গ্রামের দারিদ্র্য, অথচ সেই দারিদ্র্যের মধ্যেই পড়াশোনার অদম্য আগ্রহ আমাদের বিস্মিত করে তোলে। রতনশ্রী বা শ্রীপুর বাজারে রোজকার জীবনধারণের সংগীত আমাদের মুগ্ধ করে। আমরা হাওরের জল কেটে টেকেরঘাট যাই, সেখানে লাইমস্টোন লেক দেখি। সেখানেও সীমান্ত পিলার অতিক্রম করে দুঃসাহসী কিশোরদের ‘ভারত-ভ্রমণ’ দেখি। শুনি, কখনো কখনো ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী ওদের তাড়া দেয়, তখন হন্তদন্ত হয়ে ফিরে আসে ওরা নিজের মাটির কোলে। লাইমস্টোন লেকের পাশে অযত্নে পড়ে থাকা বিশাল বিশাল মেশিন দেখি। দামি এই মেশিনগুলোয় জং ধরেছে। এখন কেউ আর এখান থেকে পাথর উত্তোলন করে না। কিন্তু তাই বলে মেশিনগুলোর বারোটা বাজাতে হবে কেন—এ কথা মনে করে নিজেরাই নিজেদের ক্ষোভের আগুনে পুড়ি।

টেকেরঘাটের শুটিং মুহূর্ত
আমাদের পোশাকে বোধ হয় কিছু একটা ছিল। আর দলের কয়েকজনের হাতে ডিএসএলআর ক্যামেরাও স্থানীয় যুবকদের মনে আগ্রহ জাগাতে পারে। কোন ছবির শুটিংয়ে এসেছি, তা জানতে চায় কেউ কেউ। একজন পাসিং শটে অভিনয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসে। আমরা হাসতে শুরু করলে তাদের একজন বলে ওঠে, স্থানীয় চেয়ারম্যানের ছোট ভাই সে। এ এলাকার সবকিছু তার নখদর্পণে। যদি আমাদের কোনো সহযোগিতার দরকার হয়, তাহলে সে আমাদের জন্য জান দিয়ে দিতে প্রস্তুত।
বেচারার জান কেড়ে নেওয়ার কোনো ইচ্ছাই আমাদের ছিল না। পরিষ্কার করে বলি, এটা নিছক দেশ দেখার একটা চেষ্টা। অভিনয় নয়।
শেষ দিনের বৃষ্টি ছাড়া এ রকম নীল আকাশ বহুদিন দেখিনি। আর রাতে আকাশজুড়ে তারার মেলা? সেটাও বহুদিনের অভিজ্ঞতায় ছিল না।
টাঙ্গুয়ার হাওরে নৌকায় নিশিযাপনের সময় এ দৃশ্য গেঁথে গেল মনে। জল থইথই হাওরের চারদিকে শুধু পানি। তারার আলোয় শান্ত ঢেউগুলো যেন ফসফরাসের মুকুট মাথায় দিয়েছে। অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তাদের।
প্রকৃতি বাংলাদেশকে অনেক দিয়েছে। সেটা সব সময় বোঝা যায় না। বিশেষ করে নগরে যাদের ঘরবাড়ি, তারা জানেও না কোথায় কোন অপরূপ দৃশ্য সাজিয়ে রেখেছে প্রকৃতি। সেসব জায়গায় গেলেই কেবল অনুভব করা যায়, ‘আহা, কী রূপ দেখিনু…।’
আমরা বুঝতে পারি, সুনামগঞ্জে ভরা বর্ষায় এটাই আমাদের শেষ ভ্রমণ নয়। ফিরে আসতে হবে এখানে। বারবার ফিরে আসতে হবে। জেনে নিতে হবে, কী করে এখানকার মানুষ কিছু না পেয়েও এত সুখী হতে পারে। এ কারণেই বুঝি হাসন রাজা, শাহ আবদুল করিমের জন্ম হয় আর হাওরের হাওয়ায় মন ভিজিয়ে তাঁরা রচনা করতে পারেন মানুষের গান।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

ভরা বর্ষায় হাওরে

আপডেট টাইম : ০৭:১৫:৪২ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৫ জুলাই ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ জুন মাসের শেষ দিকে আমরা কজনা বেরিয়ে পড়লাম হাওরে দুরাত থাকব বলে। রূপাবই নামে একটি বড় নৌকাকে বানালাম বাড়ি। নয়জন আমরা, সঙ্গে রূপাবইয়ের একজন গাইড, একজন মাল্লা ও একজন রন্ধনশিল্পী। থাকাখাওয়া এই নৌকাতেই। দিনের বেলায় বোটে করে সারা দিন ঘুরে বেড়ানো, পথেই কোনো বাজারে বা জেলের কাছ থেকে মাছ কিনে নেওয়া। সবাই যখন চোখ ভরে নদী-হাওরের মিলনস্থল, অতি দূরের বসতি কিংবা পাহাড় আর মেঘের মিলনমেলা দেখছে, তখনই বোটের একেবারে পিছন দিকে রান্নাঘরে তৈরি হচ্ছে সদ্য কেনা মাছের ঝোল, ডাল, সবজি। রন্ধনশিল্পী দয়াপরবশ হয়ে একদিন একই সঙ্গে ভাজা আর রান্না মাছ খাওয়ালেন। একবাক্যে আমরা সবাই স্বীকার করে নিলাম, তাজা মাছের স্বাদই আলাদা। রাতে মাছ নয়, মাংস। এক রাতে মুরগি, অন্য রাতে রাজহাঁস।
প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙত খিচুড়ি আর ডিমভাজির গন্ধে। সেই সঙ্গে ঝাল আমের আচার। তোফা এক ভোজ!
সুনামগঞ্জ পর্যন্ত পানি চলে এসেছে, তাই আমাদের আর সুনামগঞ্জ থেকে স্থলপথে তাহিরপুর যেতে হলো না। রাতে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে সুনামগঞ্জ। রূপাবইয়ের কর্ণধারদের একজন ডা. রাজন আগেই বলে দিয়েছিলেন কোথায় কীভাবে যেতে হবে, তাই যাত্রাপথ নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছিল না মনে।
শাপবাড়ি ঘাট থেকে জল কেটে যখন আমরা যাত্রা শুরু করলাম, তখনো জানতে পারিনি, সামনের তিনটি দিন সোনার আলোয় ভরিয়ে দেবে আমাদের। সুরমা নদীর তীর চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে গেলে চারদিকে শুধু দিগন্তহীন পানি, মনে হচ্ছিল এ বুঝি আমাদের সমুদ্রযাত্রা। আকাশে তখন প্রচণ্ড তাপ ছড়ানো সূর্য। রাগী সূর্যের নিচে বসে সকালের নাশতা করা একেবারেই অসম্ভব, তাই আমাদের প্রথম খিচুড়ি-ডিম পরিবেশিত হয় রূপাবইয়ের খোলের ভেতর, যেখানে স্পঞ্জের আসন পেতে জায়গাটাকে মসৃণ করা হয়েছে।
প্রথম গন্তব্য শুখাই জমিদারবাড়ি। ৩০০ বছর আগের জমিদারবাড়িটি এখনো টিকিয়ে রেখেছে তার অস্তিত্ব, কিন্তু তা এতটাই জরাজীর্ণ যে সেখানে বসবাসের কথা ভাবতে পারে না কেউ। পাশেই দুটো টিনের বাড়ি উঠিয়ে নিয়েছেন জমিদার বংশের দুই সদস্য, যাঁদের মধ্যে নীলকমল বাবু এখনো থাকেন এই গ্রামেই।
তাঁর কাছ থেকে জমিদারির ইতিহাস শুনে গ্রামটা ঘুরে আসার পর নীলকমল রায় বললেন, ‘আপনারা চাইলে রাতে এখানে গান শুনতে পারেন।’
লোভনীয় প্রস্তাব। কিন্তু আমরা তো সূর্যাস্ত দেখব টাঙ্গুয়ার হাওরে। এরপর আবার এখানে ফিরে আসা কঠিন। গাইড বেলালের সঙ্গে কথা বলে আমরা ঠিক করে নিই, রাত ১০টার পর বোটেই বসবে গানের আসর। হারমোনিয়াম, মন্দিরা হলো বাদ্য। সঙ্গে থাকবে একটা প্লাস্টিকের বালতি, যার বাদন হাওরের মধ্যে নাকি অন্য এক আবেদন সৃষ্টি করে।
সে রাতে পূর্ণিমা ছিল। সে রাতে গান হয়েছিল। সে রাতের হাওর বর্ণে-গন্ধে-গীতিতে-ছন্দে আমাদের হৃদয়ে দিয়েছিল দোলা।

জাদুকাটা নদী
যে দৃশ্য গাঢ় হয়ে আছে আমাদের চোখে, সেটা জাদুকাটা নদী। পাতলাই, বউলাই নদ পেরিয়ে জাদুকাটা নদীর কাছে এসে লক্ষ করি, পাল্টে গেছে দেশের চেহারা। ওই দূরে, বহুদূরে দেখা যাচ্ছে মেঘালয়ের পাহাড়। সে পাহাড়ের গায়ে গুটিসুটি মেরে ঘুম দিচ্ছে মেঘের দল।
গাইড বেলাল ভাইকে জিজ্ঞেস করি, ‘পাহাড়টা কি ভারতে?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমরা কি কাছাকাছি যেতে পারি না?’
যাওয়ার জন্যই যে নদীর তীরে নোঙর ফেলা হবে, সে কথা বুঝিয়ে বললেন বেলাল। জানালেন, উঠে যেতে হবে বারেক টিলায়। সেখানে রয়েছে বাংলাদেশ আর ভারতকে বিভাজন করা সীমান্ত পিলার।
খাড়া পথ ধরে কিছুটা এগিয়ে গেলে কিছুটা সমতল ভূমি। সেখানে বেশ কিছু দোকান। পুরি, শিঙাড়া আছে। ভাতও রান্না হচ্ছে। নৌকা ঠেকিয়ে খাড়া পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে পর্যটকের দল। বারেক টিলার ওপরে উঠলেই ছুমন্তর ছু—অন্য জগৎ যেন এক!
মেঘলা হয়ে এসেছিল আকাশ। বারেক টিলার ওপরে ওঠার আগেই বৃষ্টি! প্রবল বৃষ্টি। প্রথমে সবাই ঠাঁই নিল চায়ের দোকানে। তারপর একে একে অনেকেই বেরিয়ে এল বৃষ্টিতে ভিজবে বলে। পাহাড়ের ওপর থেকে ডান দিকে ওই দূরে দেখা যাচ্ছে জাদুকাটা নদী। আর বাঁ দিকে দৃষ্টিসীমার মধ্যেই কিছুটা দূরে সেই সীমান্ত পিলারটি। আমরা সেদিকেই এগিয়ে যাই। প্রবল বর্ষণে মেঠো পথটা পিচ্ছিল। কিন্তু মেঘের কাছাকাছি যাওয়ার জন্য আমাদের ‘অভিযাত্রী’ দলটি সে বাধা মানছে না। পাহাড়ের পর পাহাড় দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। এভাবেই দূরের একটা পাহাড় আর আমাদের নয়, সেটা ভারত। ১২০৩ নম্বর সীমান্ত পিলারের দুধারে দুই পা রেখে আমাদের দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য শৌনক একটা অদ্ভুত কথা বলে, আমরা অবাক হই।
ও বলে, ‘আমি এখন একই সঙ্গে দুটো দেশে অবস্থান করছি। আমার এক পা বাংলাদেশের সীমান্ত পিলারের এপাশে, অন্য পা ভারতের দিকে। তার মানে আমি একই সঙ্গে দুটো টাইমজোনে আছি। এক পায়ে বাংলাদেশের সময়ে আমি, অন্য পায়ে ভারতের। আমার দুই পায়ের মধ্যে আধঘণ্টা পার্থক্য!’
চা খেতে খেতে আমরা জেনে নিই, এটা হিন্দু-মুসলমানের এক অপার ভালোবাসায় ঘেরা এলাকা। এখানে শ্রীশ্রী অদ্বৈত প্রভুর ধামে গঙ্গাস্নানে আসেন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। হজরত শাহ আরফীন (রা.)-এর মেলায় আসেন মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ। সাধারণত মার্চে হয় এই স্নান ও মেলা। তখন এ পাহাড়ে ঢল নামে মানুষের। 
হাওর আমাদের চোখ খুলে দেয়। ইন্দ্রপুর গ্রাম কিংবা আদিবাসী গ্রামের দারিদ্র্য, অথচ সেই দারিদ্র্যের মধ্যেই পড়াশোনার অদম্য আগ্রহ আমাদের বিস্মিত করে তোলে। রতনশ্রী বা শ্রীপুর বাজারে রোজকার জীবনধারণের সংগীত আমাদের মুগ্ধ করে। আমরা হাওরের জল কেটে টেকেরঘাট যাই, সেখানে লাইমস্টোন লেক দেখি। সেখানেও সীমান্ত পিলার অতিক্রম করে দুঃসাহসী কিশোরদের ‘ভারত-ভ্রমণ’ দেখি। শুনি, কখনো কখনো ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী ওদের তাড়া দেয়, তখন হন্তদন্ত হয়ে ফিরে আসে ওরা নিজের মাটির কোলে। লাইমস্টোন লেকের পাশে অযত্নে পড়ে থাকা বিশাল বিশাল মেশিন দেখি। দামি এই মেশিনগুলোয় জং ধরেছে। এখন কেউ আর এখান থেকে পাথর উত্তোলন করে না। কিন্তু তাই বলে মেশিনগুলোর বারোটা বাজাতে হবে কেন—এ কথা মনে করে নিজেরাই নিজেদের ক্ষোভের আগুনে পুড়ি।

টেকেরঘাটের শুটিং মুহূর্ত
আমাদের পোশাকে বোধ হয় কিছু একটা ছিল। আর দলের কয়েকজনের হাতে ডিএসএলআর ক্যামেরাও স্থানীয় যুবকদের মনে আগ্রহ জাগাতে পারে। কোন ছবির শুটিংয়ে এসেছি, তা জানতে চায় কেউ কেউ। একজন পাসিং শটে অভিনয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসে। আমরা হাসতে শুরু করলে তাদের একজন বলে ওঠে, স্থানীয় চেয়ারম্যানের ছোট ভাই সে। এ এলাকার সবকিছু তার নখদর্পণে। যদি আমাদের কোনো সহযোগিতার দরকার হয়, তাহলে সে আমাদের জন্য জান দিয়ে দিতে প্রস্তুত।
বেচারার জান কেড়ে নেওয়ার কোনো ইচ্ছাই আমাদের ছিল না। পরিষ্কার করে বলি, এটা নিছক দেশ দেখার একটা চেষ্টা। অভিনয় নয়।
শেষ দিনের বৃষ্টি ছাড়া এ রকম নীল আকাশ বহুদিন দেখিনি। আর রাতে আকাশজুড়ে তারার মেলা? সেটাও বহুদিনের অভিজ্ঞতায় ছিল না।
টাঙ্গুয়ার হাওরে নৌকায় নিশিযাপনের সময় এ দৃশ্য গেঁথে গেল মনে। জল থইথই হাওরের চারদিকে শুধু পানি। তারার আলোয় শান্ত ঢেউগুলো যেন ফসফরাসের মুকুট মাথায় দিয়েছে। অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তাদের।
প্রকৃতি বাংলাদেশকে অনেক দিয়েছে। সেটা সব সময় বোঝা যায় না। বিশেষ করে নগরে যাদের ঘরবাড়ি, তারা জানেও না কোথায় কোন অপরূপ দৃশ্য সাজিয়ে রেখেছে প্রকৃতি। সেসব জায়গায় গেলেই কেবল অনুভব করা যায়, ‘আহা, কী রূপ দেখিনু…।’
আমরা বুঝতে পারি, সুনামগঞ্জে ভরা বর্ষায় এটাই আমাদের শেষ ভ্রমণ নয়। ফিরে আসতে হবে এখানে। বারবার ফিরে আসতে হবে। জেনে নিতে হবে, কী করে এখানকার মানুষ কিছু না পেয়েও এত সুখী হতে পারে। এ কারণেই বুঝি হাসন রাজা, শাহ আবদুল করিমের জন্ম হয় আর হাওরের হাওয়ায় মন ভিজিয়ে তাঁরা রচনা করতে পারেন মানুষের গান।