ঢাকা ১২:৩৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
দেশ ও জাতি গঠনে “দৈনিক আমার দেশ” পত্রিকার কাছে নেত্রকোণার জনগণের প্রত্যাশা শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত ভুল অস্ত্রোপচার, যা ঘটেছিল প্রিয়াঙ্কা সঙ্গে সচিবালয়ে উপদেষ্টা হাসান আরিফের তৃতীয় জানাজা সম্পন্ন সাবেক সচিব ইসমাইল রিমান্ডে অবশেষে বিল পাস করে ‘শাটডাউন’ এড়াল যুক্তরাষ্ট্র চাঁদাবাজদের ধরতে অভিযান শুরু হচ্ছে: ডিএমপি কমিশনার নির্বাচনের পর নিজের নিয়মিত কাজে ফিরে যাবেন ড. ইউনূস ইয়েমেন থেকে ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, আহত ১৬ জুলাই আন্দোলন বিগত বছরগুলোর অনিয়মের সমষ্টি: ফারুকী তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ‘সড়কে নৈরাজ্যের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাব জড়িত

খেলাটা মুক্তিযুদ্ধ নয় : সাঈদ ফেরদৌস

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:৪৯:৩৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২১ জুন ২০১৭
  • ৪০৯ বার

ক্রিকেটভক্ত হবার জন্য আপনাকে ভারতদরদী কিংবা পাকিস্তানপ্রেমী হইতে হবে এই কথা কে বললো? কিংবা বাংলাদেশি/বাঙালি হবার জন্য আপনাকে পাকিস্তান বা ভারতের ব্যাপারে বিদ্বেষ বা ঘৃণা লালন করতে হবে এই কথাই বা কেন মনে করেন?

কাল দেখলাম কেউ কেউ পাকিস্তানের বিজয়ে বাংলাদেশে যে উল্লাস/উদযাপন তাতে লজ্জা/কুণ্ঠা বোধ করছেন। যারা এই উল্লাস করছেন তাদের দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন, ক্ষোভ, ঘৃণা উগরে দিচ্ছেন। পাকিস্তানের বিজয়ের আনন্দে উদ্বেলিত হবার অর্থ তাদের কাছে মুসলিম আত্মপরিচয়ের উদযাপন। কারো কারো কাছে এটা মুক্তিযুদ্ধের অবমাননার সামিল।

এরই উল্টোপিঠে অন্য একটা দল বলার চেষ্টা করছেন যে পাকিস্তানের বিজয়ের জন্য আনন্দ করার অর্থ পাকিস্তানকে সমর্থন করা নয়; বরং সাম্প্রতিক সময়ে বিবিধ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কারণে ভারতের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ তারই প্রকাশ হিসেবে তারা দেখছেন এই উল্লাসকে।

আমার মনে হয় না বিপরীত মেরুতে দাঁড়ানো এই দুটো দলের কেউই পুরোপুরি ভুল বলছেন। বাংলাদেশের বহু মানুষ মুসলিম হিসেবেই পাকিস্তানকে সমর্থন করে এটা যেমন বহুদিনের সত্য, আবার বেড়ে ওঠার কালে ইমরান খান কিংবা ওয়াসিম আকরামকে যে আমাদের ভারতীয় কিংবা বিশ্বের অন্য কোনো দলের তারকাদের চাইতে বেশি ভালো লাগতো তার কারণ তাদের ধর্ম/জাতিগত পরিচয় নয়। মাঠে পাকিস্তানের আনপ্রেডিক্টেবল পারফর্ম্যান্স, তার তারকাদের ক্যারিশম্যাটিক উপস্থিতি একটা ব্যাপার ছিলো বটে। ঠিক তেমনি একথাও উড়িয়ে দেয়া যায় না যে, আজকের বাংলাদেশের দুর্গতির জন্য যারা ভারতকে দায়ী করেন তারা ভারতের এই পরাজয়ে উল্লসিত।

দু’দিন আগে বিরাট কোহেলির জিভ দেখানো নিয়ে ফেইসবুকে ব্যাপক ট্রল হয়েছে। ম্যাচটাতে বাংলাদেশ হেরেছে এবং কোহ্লির জিভ বের করা ছবিটা দেখে আমারো ভীষণ গায়ে জ্বালা ধরেছে। কিন্তু কথা হলো এই জ্বালা ধরানোর উত্তর বাংলাদেশ কি দিয়ে দেবে? ফেসবুকে ঘৃণা উগরে দিয়ে, অনলাইনে ঘৃণার সংস্কৃতিতে লালন করে, গালাগালি করে? নাকি এই উত্তর বাংলাদেশ দেবে তাদের পারফর্ম্যান্স দিয়ে, মাঠে?

আমরা জানি খেলাটা মোটেই শুধু মাঠে সীমাবদ্ধ থাকেনা। এরসাথে বাজার বাণিজ্য, প্রচার সম্পর্কিত। ফলে খেলার আগে পরে দুই প্রতিদ্বন্দ্বি বাকযুদ্ধে জড়ায়। মাঠে স্লেজিং, বডি ল্যাংগুয়েজে যুদ্ধের উত্তাপ ছড়ায়। আপনি দর্শক চাইলে এই যুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবা দিতে পারেন বৈকি! তাতে আপনার এই ট্রল করা, গালাগালি করা নিশ্চয়ই কাজে দেবে।

কিন্তু তা যদি না করতে চান, অথচ খেলাটাও উপভোগ করতে চান, সেইপথও আছে। একটা ভালো ওভার, একটা দুর্দান্ত বল, একটা অসাধারণ স্কয়্যার ড্রাইভ, একটা ভালো পুলশট যেই খেলুকনা কেন আমাদেরতো ভালো লাগে। বাংলাদেশ যে সেদিন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে এভাবে ঘুরে দাঁড়ালো, তার প্রশংসা কেবল বাংলাদেশের মানুষ-ই করেনি কিন্তু। নিজের বেলায় সবার প্রশংসা চাইবেন, কিন্তু অন্যের বেলায় প্রশংসা করতে পারবেন না, সেটা কি ঠিক হবে।

পাকিস্তান এর ’৭১ এর ভূমিকা কিংবা মুসলমানিত্ব/মুসলিম জাতীয়তাবাদ, ভারতের হিন্দু/হিন্দু জাতীয়তাবাদী পরিচয় কিংবা এখনকার আঞ্চলিক রাজনীতি যদি তাদের মাঠের পারফর্ম্যান্স দেখতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, সেটা কি সঙ্গত হবে?

একথা সত্য কাল পাকিস্তানের সমর্থকদের বাঁধভাঙা উল্লাসকে আমার বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে, মনে হয়েছে এটা খেলা নয়, তার চাইতে বেশিকিছুর প্রতি প্রতিক্রিয়া। আবার এই উল্লাস নিয়ে যারা ‘দেশ গেল’ ‘জাতি গেল’ বলে মাতম করছেন, সেটাও আমার বাড়াবাড়ি-ই লেগেছে। অন্যদিকে আমি এটাও মনে করি যে, খেলায় পাকিস্তান বা ভারতকে সমর্থন করলেই বাংলাদেশিত্ব/বাঙ্গালীত্ব বিসর্জন দেয়া হয়না। দেশপ্রেম বিকোয় না।

কাজী নজরুল ইসলামের কথাটা মনে আছে নিশ্চয়ই, ‘যে জাত ধর্ম ঠুনকো এতো/ আজ নয় কাল ভাঙবে সেতো’।

দেশপ্রেম দেখাতে হয় নিজের ঘরে দেখান। তার জন্য ভারত পাকিস্তানকে বলির পাঁঠা হিসেবে ধরে আনতে হবেনা। আমার দেশের মধ্যে আমার রাষ্ট্র, থানাপুলিশ, রাষ্ট্রের বাহিনী, মন্ত্রি-এমপি এবং অধিপতি সমাজ ব্যবস্থা, মানে আপনি আমি শিক্ষত মধ্যবিত্ত যার অংশ, তা কি করে আমজনতার মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খায় সেটা নিয়ে আলাপ তুলুন, তাতে ম্যালা দেশপ্রেম দেখানো হবে।

বাংলাদেশের অধিনায়ক তো আমাদেরকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, খেলাটা মুক্তিযুদ্ধ নয়, এটা একটা খেলাই মাত্র।

লেখক-অধ্যাপক, নৃতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

দেশ ও জাতি গঠনে “দৈনিক আমার দেশ” পত্রিকার কাছে নেত্রকোণার জনগণের প্রত্যাশা শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত

খেলাটা মুক্তিযুদ্ধ নয় : সাঈদ ফেরদৌস

আপডেট টাইম : ১২:৪৯:৩৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২১ জুন ২০১৭

ক্রিকেটভক্ত হবার জন্য আপনাকে ভারতদরদী কিংবা পাকিস্তানপ্রেমী হইতে হবে এই কথা কে বললো? কিংবা বাংলাদেশি/বাঙালি হবার জন্য আপনাকে পাকিস্তান বা ভারতের ব্যাপারে বিদ্বেষ বা ঘৃণা লালন করতে হবে এই কথাই বা কেন মনে করেন?

কাল দেখলাম কেউ কেউ পাকিস্তানের বিজয়ে বাংলাদেশে যে উল্লাস/উদযাপন তাতে লজ্জা/কুণ্ঠা বোধ করছেন। যারা এই উল্লাস করছেন তাদের দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন, ক্ষোভ, ঘৃণা উগরে দিচ্ছেন। পাকিস্তানের বিজয়ের আনন্দে উদ্বেলিত হবার অর্থ তাদের কাছে মুসলিম আত্মপরিচয়ের উদযাপন। কারো কারো কাছে এটা মুক্তিযুদ্ধের অবমাননার সামিল।

এরই উল্টোপিঠে অন্য একটা দল বলার চেষ্টা করছেন যে পাকিস্তানের বিজয়ের জন্য আনন্দ করার অর্থ পাকিস্তানকে সমর্থন করা নয়; বরং সাম্প্রতিক সময়ে বিবিধ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কারণে ভারতের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ তারই প্রকাশ হিসেবে তারা দেখছেন এই উল্লাসকে।

আমার মনে হয় না বিপরীত মেরুতে দাঁড়ানো এই দুটো দলের কেউই পুরোপুরি ভুল বলছেন। বাংলাদেশের বহু মানুষ মুসলিম হিসেবেই পাকিস্তানকে সমর্থন করে এটা যেমন বহুদিনের সত্য, আবার বেড়ে ওঠার কালে ইমরান খান কিংবা ওয়াসিম আকরামকে যে আমাদের ভারতীয় কিংবা বিশ্বের অন্য কোনো দলের তারকাদের চাইতে বেশি ভালো লাগতো তার কারণ তাদের ধর্ম/জাতিগত পরিচয় নয়। মাঠে পাকিস্তানের আনপ্রেডিক্টেবল পারফর্ম্যান্স, তার তারকাদের ক্যারিশম্যাটিক উপস্থিতি একটা ব্যাপার ছিলো বটে। ঠিক তেমনি একথাও উড়িয়ে দেয়া যায় না যে, আজকের বাংলাদেশের দুর্গতির জন্য যারা ভারতকে দায়ী করেন তারা ভারতের এই পরাজয়ে উল্লসিত।

দু’দিন আগে বিরাট কোহেলির জিভ দেখানো নিয়ে ফেইসবুকে ব্যাপক ট্রল হয়েছে। ম্যাচটাতে বাংলাদেশ হেরেছে এবং কোহ্লির জিভ বের করা ছবিটা দেখে আমারো ভীষণ গায়ে জ্বালা ধরেছে। কিন্তু কথা হলো এই জ্বালা ধরানোর উত্তর বাংলাদেশ কি দিয়ে দেবে? ফেসবুকে ঘৃণা উগরে দিয়ে, অনলাইনে ঘৃণার সংস্কৃতিতে লালন করে, গালাগালি করে? নাকি এই উত্তর বাংলাদেশ দেবে তাদের পারফর্ম্যান্স দিয়ে, মাঠে?

আমরা জানি খেলাটা মোটেই শুধু মাঠে সীমাবদ্ধ থাকেনা। এরসাথে বাজার বাণিজ্য, প্রচার সম্পর্কিত। ফলে খেলার আগে পরে দুই প্রতিদ্বন্দ্বি বাকযুদ্ধে জড়ায়। মাঠে স্লেজিং, বডি ল্যাংগুয়েজে যুদ্ধের উত্তাপ ছড়ায়। আপনি দর্শক চাইলে এই যুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবা দিতে পারেন বৈকি! তাতে আপনার এই ট্রল করা, গালাগালি করা নিশ্চয়ই কাজে দেবে।

কিন্তু তা যদি না করতে চান, অথচ খেলাটাও উপভোগ করতে চান, সেইপথও আছে। একটা ভালো ওভার, একটা দুর্দান্ত বল, একটা অসাধারণ স্কয়্যার ড্রাইভ, একটা ভালো পুলশট যেই খেলুকনা কেন আমাদেরতো ভালো লাগে। বাংলাদেশ যে সেদিন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে এভাবে ঘুরে দাঁড়ালো, তার প্রশংসা কেবল বাংলাদেশের মানুষ-ই করেনি কিন্তু। নিজের বেলায় সবার প্রশংসা চাইবেন, কিন্তু অন্যের বেলায় প্রশংসা করতে পারবেন না, সেটা কি ঠিক হবে।

পাকিস্তান এর ’৭১ এর ভূমিকা কিংবা মুসলমানিত্ব/মুসলিম জাতীয়তাবাদ, ভারতের হিন্দু/হিন্দু জাতীয়তাবাদী পরিচয় কিংবা এখনকার আঞ্চলিক রাজনীতি যদি তাদের মাঠের পারফর্ম্যান্স দেখতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, সেটা কি সঙ্গত হবে?

একথা সত্য কাল পাকিস্তানের সমর্থকদের বাঁধভাঙা উল্লাসকে আমার বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে, মনে হয়েছে এটা খেলা নয়, তার চাইতে বেশিকিছুর প্রতি প্রতিক্রিয়া। আবার এই উল্লাস নিয়ে যারা ‘দেশ গেল’ ‘জাতি গেল’ বলে মাতম করছেন, সেটাও আমার বাড়াবাড়ি-ই লেগেছে। অন্যদিকে আমি এটাও মনে করি যে, খেলায় পাকিস্তান বা ভারতকে সমর্থন করলেই বাংলাদেশিত্ব/বাঙ্গালীত্ব বিসর্জন দেয়া হয়না। দেশপ্রেম বিকোয় না।

কাজী নজরুল ইসলামের কথাটা মনে আছে নিশ্চয়ই, ‘যে জাত ধর্ম ঠুনকো এতো/ আজ নয় কাল ভাঙবে সেতো’।

দেশপ্রেম দেখাতে হয় নিজের ঘরে দেখান। তার জন্য ভারত পাকিস্তানকে বলির পাঁঠা হিসেবে ধরে আনতে হবেনা। আমার দেশের মধ্যে আমার রাষ্ট্র, থানাপুলিশ, রাষ্ট্রের বাহিনী, মন্ত্রি-এমপি এবং অধিপতি সমাজ ব্যবস্থা, মানে আপনি আমি শিক্ষত মধ্যবিত্ত যার অংশ, তা কি করে আমজনতার মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খায় সেটা নিয়ে আলাপ তুলুন, তাতে ম্যালা দেশপ্রেম দেখানো হবে।

বাংলাদেশের অধিনায়ক তো আমাদেরকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, খেলাটা মুক্তিযুদ্ধ নয়, এটা একটা খেলাই মাত্র।

লেখক-অধ্যাপক, নৃতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়