ঢাকা ০৫:৩৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৮ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আজ থেকে ভারত ওবামারও

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:১৯:১৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ১ অগাস্ট ২০১৫
  • ৩১৮ বার

মা কাঁদছে। কেন কাঁদছে, জানে না পাঁচ বছরের ছোট্ট ছেলেটি। এক মুঠোয় জোর করে ধরা পতাকা। অন্য হাতে সে চোখ মুছিয়ে দিল মায়ের। তার পর সেই পতাকা দেখিয়ে বলল, “মা, আর কেঁদো না। এই দ্যাখো, আমরা আজ স্বাধীন হয়েছি!”

এত দিন ছেলেপিলে হতে ঠিকানা ভাঁড়িয়ে, বাপ-মায়ের নাম বদলে কাছের ভারতীয় হাসপাতালে যেতেন ছিটমহলবাসীরা। ধরা পড়লেই কপালে বাঁধা থাকতো পুলিশি হেনস্থা। কারণ, ওঁরা তো তখন অনুপ্রবেশকারী! ২০১০ সালের ২৯ মার্চ তেমনই এক আসন্নপ্রসবা মাকে নিয়ে হাসপাতালে এনে এক জন বলেছিলেন, অনেক মিথ্যে হয়েছে, আর নয়! বাংলাদেশি ছিটমহলের ঠিকানা দেখে প্রথমে ভর্তি করাতে চায়নি সরকারি হাসপাতাল। পুলিশ হাজির হয়েছিল গ্রেফতার করতে। ছিটমহলবাসীর বন্ধু আইনজীবীরা তখন বলেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী চিকিৎসার সুযোগ মৌলিক নাগরিক অধিকার। এ ক্ষেত্রে নাগরিকত্বের ভেদ টানা অনুচিত। বেআইনিও বটে। কোচবিহার জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে তখন ভর্তি নেওয়া হয় মশালডাঙার সেই মাকে। ছেলে হলে ছিটমহলবাসীরা নাম রাখলেন, জেহাদ হোসেন ওবামা।

শুক্রবার পড়ন্ত বিকেলের আলোয় মশালডাঙা ছিটমহলে সেই জেহাদের হাতেই ভারতের জাতীয় পতাকা। মা আসমার চোখের জল মুছিয়ে দিচ্ছে আর কিছু ক্ষণের মধ্যে নতুন দেশের বাসিন্দা হতে চলা শিশুটি। আসমা কিছুটা ধাতস্থ হলেন। বললেন, ‘‘সে দিন যখন পুলিশ বলেছিল গ্রেফতার করবে, মনে হয়েছিল সব শেষ হয়ে গেল আমার।” আর এখন? “আজ আর আমাদের কোনও হাসপাতাল থেকে কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে না। আজ আর কোনও গর্ভবতীর হাসপাতালে গিয়ে গ্রেফতারের ভয় করতে হবে না।”

শুক্রবার রাত বারোটা। সাড়ে ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে বয়ে আনা অন্ত্যেবাসী তকমা ঝেড়ে ফেলে ছিটমহলবাসীরা একটা সত্যিকারের দেশ পাচ্ছেন তাঁরা হাতের মুঠোয়। শুধু চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মতো অধিকারই নয়, পাচ্ছেন বাচ্চাদের ঠিকঠাক পড়াশোনা করানোর অধিকারও। আর তিন মাস বাদে স্কুলে ভর্তি হওয়ার কথা ছোট্ট জেহাদের। সে এ বারে ভারতের স্কুলেই ভর্তি হতে পারবে। ছিটমহলের বিভিন্ন গ্রাম থেকে মধ্য মশালডাঙা গ্রামের উৎসব মঞ্চের পথে।

তাই ঘড়ির দুই কাঁটা এক হয়ে যেতেই চিৎকার উঠল জমায়েতের মধ্য থেকে। শুরু হল বাজি-পটকার আওয়াজ। মশালডাঙার আকাশ ভরে গেল রোশনাইয়ে। ভারতের জাতীয় পতাকা আগেই অস্থায়ী বেদি তৈরি করে বসানো ছিল। মধ্যরাতের স্বাধীনতায় সেই পতাকা উঠল আকাশে। জমায়েতের লোকজন আনন্দে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরলেন। শুধু আসমা নয়, অনেক মানুষেরই চোখে জল। মা-ঠাকুমারা এসেছেন বাড়ির শিশুদের সঙ্গে নিয়ে। কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছিল তারা। আওয়াজে জেগে উঠে তাদের গলাতেও চিৎকার।

দীর্ঘ বাধা টপকে, খানাখন্দ পেরিয়ে স্বাধীনতার ৬৭ বছরে এসে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি শুধু যে ঐতিহাসিক, তা-ই নয়। এ যেন ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে নতুন সম্পর্কের দিগন্ত খুলে দিল- বলছিলেন স্থানীয় বয়স্ক মানুষেরা। ৫১টি বাংলাদেশি ছিটমহল এ দিন মিশে গেল ভারতের সঙ্গে। সরকারি হিসেব বলছে, ১৪ হাজার বাংলাদেশি মানুষ এ দিন সরকারি ভাবে নাগরিকত্ব পেলেন ভারতের।

উদ্‌যাপনটা অবশ্য শুরু হয়েছিল রাত বারোটার অনেক আগেই। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালামের একটি উক্তিকে দিয়ে তোরণ সাজিয়েছেন এলাকার মানুষ। তাতে লেখা— ‘যা ঘুমের মধ্যে দেখো, সেটা স্বপ্ন নয়। স্বপ্ন সেটাই, যা তোমাকে ঘুমোতে দেয় না!’ রাত আটটায় যে অনুষ্ঠান দিয়ে উদ্‌যাপন শুরু হল, তাতে এসেছিল জেহাদ হোসেন ওবামার আখ্যানও। ছিল ছিটমহলবাসীর বাঁধা গান, যাতে সেই যন্ত্রণারই গুনগুনানি। এ ছাড়া ছিটমহলবাসীর অন্ধকার জীবনের ওপরে ঘণ্টা দুয়েকের একটি তথ্যচিত্র। তার পরেই মধ্যরাতের উল্লাস।

বাজি-পটকার রোশনাই কমে এলে, উচ্ছ্বাস থিতিয়ে এলে ছিটমহল বিনিময় কমিটির নেতা দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বললেন, ‘‘অধিকার অর্জনের স্বপ্ন, আত্মপরিচিতির স্বপ্ন সত্যিই এত দিন ঘুমোতে দেয়নি ছিটমহলের বাসিন্দাদের। সেই জয় অর্জনের পরে এ বার ওরা শান্তিতে ঘুমোবে।’’

মায়ের সঙ্গে তার আগেই ঘুমোতে গিয়েছে ছোট্ট পাঁচ বছরের ছেলেটি। যে ছিটমহলের জেহাদ, আবার ছিটমহলের ওবামা-ও। শনিবার সকালে তার ঘুম ভাঙবে নতুন দেশে, তার স্কুলে যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

আজ থেকে ভারত ওবামারও

আপডেট টাইম : ১১:১৯:১৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ১ অগাস্ট ২০১৫

মা কাঁদছে। কেন কাঁদছে, জানে না পাঁচ বছরের ছোট্ট ছেলেটি। এক মুঠোয় জোর করে ধরা পতাকা। অন্য হাতে সে চোখ মুছিয়ে দিল মায়ের। তার পর সেই পতাকা দেখিয়ে বলল, “মা, আর কেঁদো না। এই দ্যাখো, আমরা আজ স্বাধীন হয়েছি!”

এত দিন ছেলেপিলে হতে ঠিকানা ভাঁড়িয়ে, বাপ-মায়ের নাম বদলে কাছের ভারতীয় হাসপাতালে যেতেন ছিটমহলবাসীরা। ধরা পড়লেই কপালে বাঁধা থাকতো পুলিশি হেনস্থা। কারণ, ওঁরা তো তখন অনুপ্রবেশকারী! ২০১০ সালের ২৯ মার্চ তেমনই এক আসন্নপ্রসবা মাকে নিয়ে হাসপাতালে এনে এক জন বলেছিলেন, অনেক মিথ্যে হয়েছে, আর নয়! বাংলাদেশি ছিটমহলের ঠিকানা দেখে প্রথমে ভর্তি করাতে চায়নি সরকারি হাসপাতাল। পুলিশ হাজির হয়েছিল গ্রেফতার করতে। ছিটমহলবাসীর বন্ধু আইনজীবীরা তখন বলেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী চিকিৎসার সুযোগ মৌলিক নাগরিক অধিকার। এ ক্ষেত্রে নাগরিকত্বের ভেদ টানা অনুচিত। বেআইনিও বটে। কোচবিহার জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে তখন ভর্তি নেওয়া হয় মশালডাঙার সেই মাকে। ছেলে হলে ছিটমহলবাসীরা নাম রাখলেন, জেহাদ হোসেন ওবামা।

শুক্রবার পড়ন্ত বিকেলের আলোয় মশালডাঙা ছিটমহলে সেই জেহাদের হাতেই ভারতের জাতীয় পতাকা। মা আসমার চোখের জল মুছিয়ে দিচ্ছে আর কিছু ক্ষণের মধ্যে নতুন দেশের বাসিন্দা হতে চলা শিশুটি। আসমা কিছুটা ধাতস্থ হলেন। বললেন, ‘‘সে দিন যখন পুলিশ বলেছিল গ্রেফতার করবে, মনে হয়েছিল সব শেষ হয়ে গেল আমার।” আর এখন? “আজ আর আমাদের কোনও হাসপাতাল থেকে কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে না। আজ আর কোনও গর্ভবতীর হাসপাতালে গিয়ে গ্রেফতারের ভয় করতে হবে না।”

শুক্রবার রাত বারোটা। সাড়ে ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে বয়ে আনা অন্ত্যেবাসী তকমা ঝেড়ে ফেলে ছিটমহলবাসীরা একটা সত্যিকারের দেশ পাচ্ছেন তাঁরা হাতের মুঠোয়। শুধু চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মতো অধিকারই নয়, পাচ্ছেন বাচ্চাদের ঠিকঠাক পড়াশোনা করানোর অধিকারও। আর তিন মাস বাদে স্কুলে ভর্তি হওয়ার কথা ছোট্ট জেহাদের। সে এ বারে ভারতের স্কুলেই ভর্তি হতে পারবে। ছিটমহলের বিভিন্ন গ্রাম থেকে মধ্য মশালডাঙা গ্রামের উৎসব মঞ্চের পথে।

তাই ঘড়ির দুই কাঁটা এক হয়ে যেতেই চিৎকার উঠল জমায়েতের মধ্য থেকে। শুরু হল বাজি-পটকার আওয়াজ। মশালডাঙার আকাশ ভরে গেল রোশনাইয়ে। ভারতের জাতীয় পতাকা আগেই অস্থায়ী বেদি তৈরি করে বসানো ছিল। মধ্যরাতের স্বাধীনতায় সেই পতাকা উঠল আকাশে। জমায়েতের লোকজন আনন্দে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরলেন। শুধু আসমা নয়, অনেক মানুষেরই চোখে জল। মা-ঠাকুমারা এসেছেন বাড়ির শিশুদের সঙ্গে নিয়ে। কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছিল তারা। আওয়াজে জেগে উঠে তাদের গলাতেও চিৎকার।

দীর্ঘ বাধা টপকে, খানাখন্দ পেরিয়ে স্বাধীনতার ৬৭ বছরে এসে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি শুধু যে ঐতিহাসিক, তা-ই নয়। এ যেন ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে নতুন সম্পর্কের দিগন্ত খুলে দিল- বলছিলেন স্থানীয় বয়স্ক মানুষেরা। ৫১টি বাংলাদেশি ছিটমহল এ দিন মিশে গেল ভারতের সঙ্গে। সরকারি হিসেব বলছে, ১৪ হাজার বাংলাদেশি মানুষ এ দিন সরকারি ভাবে নাগরিকত্ব পেলেন ভারতের।

উদ্‌যাপনটা অবশ্য শুরু হয়েছিল রাত বারোটার অনেক আগেই। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালামের একটি উক্তিকে দিয়ে তোরণ সাজিয়েছেন এলাকার মানুষ। তাতে লেখা— ‘যা ঘুমের মধ্যে দেখো, সেটা স্বপ্ন নয়। স্বপ্ন সেটাই, যা তোমাকে ঘুমোতে দেয় না!’ রাত আটটায় যে অনুষ্ঠান দিয়ে উদ্‌যাপন শুরু হল, তাতে এসেছিল জেহাদ হোসেন ওবামার আখ্যানও। ছিল ছিটমহলবাসীর বাঁধা গান, যাতে সেই যন্ত্রণারই গুনগুনানি। এ ছাড়া ছিটমহলবাসীর অন্ধকার জীবনের ওপরে ঘণ্টা দুয়েকের একটি তথ্যচিত্র। তার পরেই মধ্যরাতের উল্লাস।

বাজি-পটকার রোশনাই কমে এলে, উচ্ছ্বাস থিতিয়ে এলে ছিটমহল বিনিময় কমিটির নেতা দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বললেন, ‘‘অধিকার অর্জনের স্বপ্ন, আত্মপরিচিতির স্বপ্ন সত্যিই এত দিন ঘুমোতে দেয়নি ছিটমহলের বাসিন্দাদের। সেই জয় অর্জনের পরে এ বার ওরা শান্তিতে ঘুমোবে।’’

মায়ের সঙ্গে তার আগেই ঘুমোতে গিয়েছে ছোট্ট পাঁচ বছরের ছেলেটি। যে ছিটমহলের জেহাদ, আবার ছিটমহলের ওবামা-ও। শনিবার সকালে তার ঘুম ভাঙবে নতুন দেশে, তার স্কুলে যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা