হাওর বার্তা ডেস্কঃ বর্ষায় নৌকা আর শীত মৌসুমে সাঁকো। নদী পারাপারে এমন ঝুঁকিপূর্ণ অবলম্বন স্থানীয়দের। দীর্ঘদিন থেকে লক্ষাধিক মানুষের নদী পারাপারে এমন অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। সেতুর অভাবে দুই জেলার সীমান্তবর্তী ৩৫ গ্রামের মানুষের এমন বেহাল দশা। তারপরও টনক নড়ছে না সংশ্লিষ্টদের। স্থানীয়রা প্রায় ৪৫ বছর থেকে সংশ্লিষ্ট অফিস ও ব্যক্তিবর্গের কাছে ওই স্থানে সেতুর জন্য ধরনা দিচ্ছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। যাদের কাছেই যাচ্ছেন তারাই শুধু প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। মৌলভীবাজারের সীমান্তবর্তী খলিলপুর ইউনিয়ন। ওই ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বরাক নদী (স্থানীয়দের কাছে এখন মরা গাং হিসেবে পরিচিত)। ওই নদীর ওপারে হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার আউশকান্দি ইউনিয়ন। বরাক নদীর অবস্থান অর্ধেক মৌলভীবাজার ও অর্ধেক হবিগঞ্জ জেলায়। এমন অবস্থানগত কারণে নদীর উপকারভোগী দুই জেলাবাসী। নদীটি মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলাবাসীর মিলনস্থল হিসেবেই স্থানীয়দের কাছে অনেকটাই পরিচিত। কিন্তু সেতু না থাকায় দীর্ঘদিন থেকে সাঁকো দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে দুই জেলাবাসীর চলছে যোগাযোগ। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, নদী পারাপারের জন্য বছরান্তে তারা ৩০০ মিটার দীর্ঘ বাঁশের সাঁকো নির্মাণ করেন। এতে খরচ হয় প্রায় লক্ষাধিক টাকা। এলাকাবাসী চাঁদা তুলেই এর ব্যয়বার বহন করেন। এতে শীত মৌসুমে সাঁকো দিয়ে চলাচল করতে পারলেও বর্ষা মৌসুমে সাঁকো ব্যবহারে থাকে মারাত্মক ঝুঁকি। তারা জানালেন নদীতে সেতু হলে মৌলভীবাজার-হবিগঞ্জ বাইপাস সড়ক হিসেবে এটি ব্যবহার করা যেত। বরাক নদীতে সেতু না থাকার কারণে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে মৌলভীবাজার অংশের প্রায় ৫০ হাজার বাসিন্দাকে। স্থানীয় দুর্ভোগগ্রস্তরা স্বাধীনতার পর থেকে সংশ্লিষ্ট বিভাগের বিভিন্ন দপ্তরে সেতুর জন্য নানা দৌড়ঝাঁপ করেছেন। কিন্তু নদীর ওপর সেতু নির্মাণের বিষয়টি আজও আলোর মুখ দেখেনি। তাই মৌলভীবাজার অংশের নদী তীরবর্তী কেশবচর, সাবটিয়া, দেওয়াননগর, হলিমপুর, ঘোড়ারাই, কাটারাই, কঞ্চনপুর, চাঁনপুর, নামুয়া, খলিলপুর ও সাদুহাটি এবং হবিগঞ্জ অংশের ফরিদপুর, নোয়াহাটি, সিটফরিদপুর, ধর্মনগর, আলমপুর, নাজিমপুর, ফরাসতপুর, বখশিপুর, মুকিমপুর ও সিছনপুর গ্রামসহ উভয় জেলার প্রায় ৩৫ গ্রামের বাসিন্দারা দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। এই সেতুর কারণে অর্থনৈতিক, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগের দিক দিয়ে পিছিয়ে রয়েছে উভয় জেলার লক্ষাধিক লোকজন। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী মরহুম এম সাইফুর রহমান, সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী মরহুম সৈয়দ মহসিন আলীর কাছে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে করা হয়ে ছিল আবেদন। এরই প্রেক্ষিতে সেতুর প্রয়োজনীয়তা যাচাই করতে তারা পরিদর্শন করেছিলেন নদী তীরবর্তী এলাকা। সর্বশেষ গেল বছরের ১৫ই আগস্ট মৌলভীবাজার-৩ আসনের (সদর-রাজনগর) অংশের সংসদ সদস্য সৈয়দা সায়রা মহসিন ও হবিগঞ্জ-১ আসনের (নবীগঞ্জ-বাহুবল) অংশের সংসদ সদস্য এমএ মুনিম চৌধুরীকে অতিথি করে উভয় জেলার বাসিন্দাদের উদ্যোগে সভা করা হয়েছিল। তারা উভয়ই আশ্বস্ত করেছিলেন সেতুটি নির্মাণের। তাদের এমন প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের প্রত্যাশায় এখন অপেক্ষায় রয়েছেন স্থানীয় দুর্ভোগগ্রস্তরা। জানা গেল সেতুটি হলে দুর্ভোগ লাঘব হতো নবীগঞ্জের স্কুল এন্ড কলেজ, সানফ্লাওয়ার জুনিয়র স্কুল, উদয়ন বিদ্যাপীঠ, উলখান্দি এতিমখানা, সৈয়দপুর ফাজিল মাদরাসা, ইয়াকুবিয়া হাফিজিয়া মাদরাসা, দাখিল মাদরাসার শিক্ষার্থীসহ আউশকান্দি উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র, অরবিট হাসপাতাল, কেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ব্যাংক ও বীমাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সেবা গ্রহীতাদের। স্থানীয়রা জানান, জেলার সদর উপজেলার খলিলপুর ইউনিয়নের অবস্থান মৌলভীবাজার শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে। তাই মৌলভীবাজার জেলার সীমান্তবর্তী ওই ইউনিয়নের বাসিন্দারা পার্শ্ববর্তী হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার ওই সকল প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে স্বল্প সময়ে যোগাযোগ করা তাদের জন্য সুবিধাজনক। সেতু না থাকায় বিশেষ করে স্কুল, কলেজ ও মাদরাসাগামী শিক্ষার্থী, মুমূর্ষু রোগী ও গর্ভবতী মহিলাদের জেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় ওই এলাকার বাসিন্দাদের। সেতু না থাকায় নিকটবর্তী নদীর ওপারের নবীগঞ্জ অংশের হাসপাতালগুলোতে যেতে পারে না তারা। তাই বাধ্য হয়ে ৩৫ কিলোমিটার দূরের মৌলভীবাজার শহর অথবা ২৫ কিলোমিটার দূরের সরকারবাজার হয়ে শেরপুরে যেতে হয়। অথচ ওই সেতু হলে হাসপাতাল যেতে এলাকাবাসীর সময় লাগবে ১০-১৫ মিনিট। এলাকাবাসী জানান, আউশকান্দি বাজারের পাশ দিয়েই ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক (প্রস্তাবিত ফোরলেন রোড) এবং ৮ কিলোমিটার দূরে শ্রীহট্ট ইকোনমিক জোনের অবস্থান। সেতুটি হলে ইকোনমিক জোনের সঙ্গে যেমন সহজ হবে যোগাযোগ তেমনি বেকারত্ব লাঘব হবে সীমান্তবর্তী দুই জেলার স্থানীয় বাসিন্দাদের। আর ব্যবসা বাণিজ্য, কৃষি উৎপাদনসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিক দিয়ে এগিয়ে যাবে পিছিয়ে থাকা অবহেলিত ওই এলাকার লোকজন। তাছাড়া ওই সেতু হলে মহাসড়ক দিয়ে নবীগঞ্জ হয়ে সহজেই ঢাকা ও সিলেটের সঙ্গে স্বল্প সময়ে যোগাযোগ করা দুই জেলাবাসীর জন্য সম্ভব হবে। সরজমিন ওই এলাকায় গেলে দেখা যায়, স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, শ্রমিক, চাকরিজীবীসহ নানা শ্রেণি পেশার লোকজন ঝুঁকি নিয়ে দীর্ঘ সাঁকো দিয়ে নদীটি পার হচ্ছেন। স্থানীয় স্কুল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানায়, বর্ষা মৌসুমে দীর্ঘ সাঁকো পরাপারে স্কুলে যেতে অনেক ভয় হয়। বর্ষা মৌসুমে ভারি বৃষ্টির দিনে ওই সাঁকোর কারণে স্কুলে যাওয়াও সম্ভব হয় না। কারণ, নদী পারাপারের জন্য ওখানে কোনো নৌকা থাকে না। তারা জানায়, ওই নদীতে তাদের অনেক সহপাঠীর বই, কলম, ঘড়ি, এমনকি পায়ের জুতাও পড়ে ভেসে গেছে। কেশবচর এলাকার আব্দুস শহিদ, রফিক আহমদ, শিক্ষক আব্দুল হাই, আমিরুল ইসলাম শাহেদসহ এলাকার লোকজন জানান, সেতু না হওয়ায় মৌলভীবাজার অংশের ২২টি গ্রামের ৫০ হাজার লোকজন উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত। দুই জেলার ৩৫ গ্রামের লক্ষাধিক মানুষের সার্বিক উন্নয়নের কথা বিবেচনায় নিয়ে ওই নদীতে সেতু নির্মাণের প্রত্যাশা তাদের।
সংবাদ শিরোনাম
জনপ্রিয় সংবাদ