তামিম ইকবাল ও মুশফিকুর রহিমের ব্যাটে ইংল্যান্ডের বিপক্ষ প্রথমবার তিনশ ছাড়িয়েছিল বাংলাদেশ। তবে এই উইকেটে ৩০৫ রান নিয়ে জেতা সহজ হবে না, সেটি অনুমিতই ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ পারল না লড়াই করতেও। দারুণ পেশাদারি ব্যাটিংয়ে ইংল্যান্ড জিতল ৮ উইকেটে, ১৬ বল বাকি রেখে।
গত জুনে শ্রীলঙ্কার ঠিক ৩০৫ রানই তাড়া করে ৪০ ওভারে জিতে গিয়েছিল ইংল্যান্ড। এবার এত দ্রুত না জিতলেও একবারও মনে হয়নি, হারতে পারে ইংল্যান্ড।
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে এই প্রথম তিনশ রান তাড়া করে জিতল কোনো দল। নিজেদের যন্ত্রণা ভুলিয়েই এই রেকর্ড গড়ল ইংল্যান্ড। গত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে এই ওভালেই ইংলিশদের বিপক্ষে শ্রীলঙ্কার ২৯৩ রান তাড়ায় জয় ছিল আগের রেকর্ড।
তামিম ইকবালের সেঞ্চুরির জবাব হয়ে এলো জো রুটের অসাধারণ সেঞ্চুরি। মুশফিকের ঝড়ের জবাবে অ্যালেক্স হেলসের ঝড়। বাংলাদেশের ছিল না আর কেউ। ইংল্যান্ডের অধিনায়ক মর্গ্যানও খেললেন দারুণ ইনিংস।
হেলস ও মর্গ্যানের সঙ্গে রুটের দুটি জুটিতেই ম্যাচ শেষ। দ্বিতীয় উইকেটে জুটি ১৫৯ রানের, অবিচ্ছিন্ন তৃতীয় উইকেটে ১৪৩!
পায়ে ক্র্যাম্প নিয়েও ১৩৩ রানের অপরাজিত ইনিংসে দলকে জিতিয়ে ফিরেছেন ইংলিশদের গোল্ডেন বয় রুট।
বাংলাদেশের বোলারদের সবাই ছিলেন বিবর্ণ। সাকিব আবারও বল হাতে নিজের ছায়া। রুবেল খরুচে। খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারেননি মাশরাফি, মুস্তাফিজ। আট ব্যাটসম্যান নিয়ে খেলতে নামা দলের বোলার একজন কম ছিল এমনিতেই।
শুরুর ব্রেক থ্রু প্রত্যাশা মতোই পেয়েছিল বাংলাদেশ। মাশরাফির স্লোয়ারে জেসন রয়ের স্কুপ শর্ট ফাইন লেগে লাফিয়ে দুর্দান্ত রিফ্লেক্সে হাতে জমান মুস্তাফিজ।
বাংলাদেশের প্রথম বোলার হিসেবে দেশের বাইরে উইকেটের সেঞ্চুরি করলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক।
তবে ম্যাচের আগের দিন অধিনায়ক যা বলেছিলেন, চাপ টানা ধরে রাখা, সেটিই পারেনি বাংলাদেশ। এই ইংল্যান্ডের সঙ্গে পেরে উঠতে হলে প্রয়োজন ছিল ইনিংস জুড়ে দারুণ বোলিং-ফিল্ডিং। কিন্তু হেলস ও রুটের ব্যাটিংয়ে ক্রমেই অসহায় বাংলাদেশের বোলিং।
শুরু থেকেই এক-দুই নিয়ে রান এগিয়েছে এই জুটি। সুযোগ মতো বল পাঠিয়েছে বাউন্ডারিতে। খেলা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আস্তে আস্তে পিষে ফেলেছে বাংলাদেশের আশা। বারবার বোলার বদলেও হয়নি লাভ।
১৫৩ বলে ১৫৯ রানের জুটিই গড়ে দিয়েছে ম্যচের ভাগ্য। খামতি বলতে মুহূর্তের ভুলে হেলসের সেঞ্চুরি না পাওয়া। পার্ট টাইমার সাব্বিরকে টানা দুই বলে চার ও ছক্কা মেরে আবার স্লগ করেছিলেন। মিড উইকেটে ধরা পড়েছেন ৮৬ বলে ৯৫ রানে।
বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল দ্রুত আরও একটি-দুটি উইকেট। উল্টো রান উঠতে থাকল দ্রুত। রুট ও মর্গ্যান ধরে রাখলেন রানের ধারা।
মর্গ্যান তবু আউট হতে পারতেন। মাশরাফির বলে লং অনে সামনে ঝাপিয়ে বল হাতে জমিয়েছিলেন তামিম। তার দাবি ছিল পরিষ্কার ক্যাচ। কিন্ত আম্পায়ার সুন্দরম রবির সফট সিগন্যাল ছিল নট আউট। টিভি রিপ্লে দেখে আম্পায়ারের সফট সিগন্যাল বদল দেওয়ার মত প্রমাণ মিলল না। রিপ্লেতে আরেকটু গভীরভাবে সময় নিয়ে কেন দেখা হলো না, সেই প্রশ্ন অবশ্য তোলা যায়।
এরপর আর পেছনে তাকাননি মর্গ্যান। ৪৫ বলে ছুঁয়েছেন অর্ধশতক। আরেকপাশে রুট তুলে নিয়েছেন নবম ওয়ানডে সেঞ্চুরি।
সেখানেই না থেমে খেলা শেষ করে ফিরেছেন দুজনই। ১২৯ বলে ১৩৩ রানে অপরাজিত রুট। ৬১ বলে ৭৫ রানে অপরাজিত মর্গ্যান।
ম্যাচের প্রথম ভাগে মনে হচ্ছিলো, লড়াই করবে বাংলাদেশ। অন্তত ব্যাটিংটায় ছিল সেরকম কিছুর আভাস। তামিম ইকবাল ও মুশফিকুর রহিমের দারুণ জুটিতে বাংলাদেশ ছাড়িয়েছিল তিনশ।
১২৮ করেছেন তামিম, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশ ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ। ৭২ বলে ৭৯ মুশফিক। দুজনের ১৬৬ রানের জুটি ওভালের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যে কোনো জুটিতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ।
এই দুজন জুটি বাধার আগেই মোটামুটি একটা ভিত্তি পেয়েছিল বাংলাদেশ। সকাল থেকেই রোদ ঝলমলে আবহাওয়া। তবু সকালে উইকেটে কিছু আর্দ্রতা থাকতে পারে বলে ব্যাটিং উইকেটেও বোলিং নিলেন মর্গ্যান। মেহেদী হাসান মিরাজকে বাইরে রেখে আট বাটসম্যান নিয়ে নামা বাংলাদেশ পায় ব্যাটিং।
আগের ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ২২ রানে ৬ উইকেট হারানোর কারণে হোক বা অন্য কারণে, বাংলাদেশের শুরুটা ছিল ভীষণ সতর্ক। প্রথম ৪ ওভারে ছিল ৬ রান।
পঞ্চম ওভারে প্রথম চার আসে সৌম্য সরকারের ব্যাট থেকে। ১১ রানে সেই সৌম্যরই সহজ ক্যাচ ছাড়েন মইন।
সৌম্য অবশ্য সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি। বেন স্টোকসের বাইরের বল উড়িয়ে মেরে ফিরে গেছেন ২৮ রানে। তবে ততক্ষণে উদ্বোধনী জুটিতে বাংলাদেশ পেয়ে গেছে ৫৬।
তামিম শুরুতে ছিলেন সাবধানী। ২০ বলে তার রান ছিল ৪। মার্ক উড শরীর তাক করা কিছু বলে বিপাকেও ফেলেছেন তাকে। তবে থিতু হওয়ার পর অবশ্য তাকে থামানোর পথ জানা ছিল না ইংলিশ বোলারদের। চোটের কারণে ২ ওভারের বেশি বল করতে পারেননি ক্রিস ওকস। সেটিও ভুগিয়েছে ইংলিশদের।
তিনে সুযোগ পেয়ে শুরুটা ভালোই করেছিলেন ইমরুল কায়েস। কিন্তু তিনিও উইকেট উপহার দিয়ে ফিরলেন ১৯ রানে।
বাংলাদেশের সেরা সময়ের শুরু এরপরই। মুশফিক যথারীতি শুরুতে থেকেই খেলেছেন থিতু ব্যাটসম্যানের মতো। তামিম জমে গেছেন। রানের চাকা তখন ঘুরছে আর ঘুরছেই।
মাঝে বেন স্টোকসের সঙ্গে কথার লড়াইয়ও নাড়াতে পারেনি তামিমের মনোসংযোগ। ১২৪ বলে তুলে নেন ওয়ানডেতে নবম সেঞ্চুরি।
সেঞ্চুরির পরও থামেননি। মইন আলিকে ছক্কা মেরেছেন, উড়িয়েছেন মার্ক উডকে। ছুটছিলেন মুশফিকও। শেষ পর্যন্ত রান বাড়ানোর তাড়ায় একই ওভারে ফিরেছেন দুজন। ১২ চার ও ৩ ছক্কায় ১৪২ বলে ১২৮ তামিম। ৮ চারে ৭২ বলে ৭৯ মুশফিক।
শেষ দিকে সাব্বির রহমানের ব্যাট থেকে এসেছে ১৫ বলে ২৪। শেষ ১০ ওভারে এসেছে ৮৩ রান। শেষ ৫ ওভারে ৪৩।
শেষ দিকে আরেকটু রান বেশি না হওয়ার আক্ষেপ থাকতে পারে। তবে দিন শেষে বলা যায়, রান কিছু বেশি হলেও লাভ হতো না! উইকেটে বোলারদের জন্য কিছু ছিল না বটে। তবে বোলিং-ফিল্ডিং ভালো হলে অন্তত লড়াইটা জমতে পারত!
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ৩০৫/৬(তামিম ১২৮, সৌম্য ২৮, ইমরুল ১৯, মুশফিক ৭৯, সাকিব ১০, সাব্বির ২৪, মাহমুদউল্লাহ ৬*, মোসাদ্দেক ২*; ওকস ০/৪, উড ০/৫৮, বল ১/৮২, স্টোকস ১/৪২, প্লাঙ্কেট ৪/৫৯, মইন ০/৪০ রুট ০/১৮)।
ইংল্যান্ড: ৪৭.২ ওভারে ৩০৮/২ (রয় ১, হেলস ৯৫, রুট ১৩৩*, মর্গ্যান ৭৫*; মাশরাফি ১/৫৬, সাকিব ০/৯২, মুস্তাফিজ ০/৫১, সৌম্য ০/১৩, মোসাদ্দেক ০/৪৭, রুবেল ০/৬৪, সাব্বির ১/১৩))
ফল: ইংল্যান্ড ৮ উইকেটে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: জো রুট