দীর্ঘ ৬৮ বছরের ‘বন্দিদশা’ থেকে মুক্ত হচ্ছে নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত ছিটমহলবাসীরা। সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের অভ্যন্তরের ১৬২টি ছিটমহল শুক্রবার মধ্যরাতে মূল ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত হচ্ছে। ঐতিহাসিক এই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে ছিটমহলগুলোতে চলছে আনন্দ-উৎসবের আমেজ।
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার অভ্যন্তরের দাসিয়ারছড়া ছিটমহলে শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতীয় পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করবে ছিটবাসীরা। মধ্যরাতের মাহেন্দ্রক্ষণে ৬৮টি মোমবাতি জ্বালিয়ে ৬৮ বছরের অন্ধকার জীবনের অবসান ঘটাবেন ছিটবাসীরা। পোড়ানো হবে আতশবাজী, উড়ানো হবে ফানুস।
বিশেষ এই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর বিশেষ মোনাজাত ও মিলাদ মাহফিল এবং সুবিধামত সময়ে মন্দিরে প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে উৎসব আয়োজন শুরু হয়। এরপর ধারাবাহিকভাবে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলবে নৌকাবাইস, ঘোড়-দৌড়, লাঠি খেলা। সূর্যাস্তের সাথে সাথে ছিটমহলগুলোতে শুরু হবে আলোকসজ্জ্বা, রাস্তায় রাস্তায় মশাল প্রজ্জ্বলন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বাংলাদেশের মূল ভূখন্ডের মানচিত্রে যুক্ত হতে যাচ্ছে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলায় দাসিয়ারছড়া ছিটমহলের ১৯শত ৪৩ একর জমি এবং জনগনণা অনুযায়ী প্রায় ৭ হাজার ৬৯ জন ছিটবাসী। এছাড়া ভুরুঙ্গামারীর ১০টি ছিটমহলের প্রায় ৩শত ২৩একর জমির সাথে যুক্ত হবে ১ হাজার ৫১৩ জন মানুষ। জেলা সদরের ডাকুয়ারকুটি ছিটমহলের জনবসতি না থাকলেও ১৩ দশমিক ৪৮ একর জমি জেলার মানচিত্রে যুক্ত হবে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১১১টি ছিটমহলে যৌথ জনগনণা অনুযায়ী জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪১ হাজার ৪৪৯ জন। সেই ছিটমহল থেকে ভারতের মূল ভূখন্ডে যেতে নিবন্ধিত হয়েছে ৯৭৯ জন ছিটবাসী। এর মধ্যে কুড়িগ্রামের ১০টি ছিটমহলের ৩১৭ জন। শুধু দাসিয়ার ছড়ারই ২৮৪ জন। কুড়িগ্রামে ১০টি ছিটমহল থেকে ১৫৮ জন হিন্দু এবং ১৫৯ জন মুসলমান পরিবারের সদস্য ভারতে যাওয়ার জন্য নিবন্ধিত হয়েছে।
অপরদিকে ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশি ৫১টি ছিটমহলের প্রায় ১৪ হাজার মানুষের কেউ বাংলাদেশে আসতে আগ্রহ দেখায়নি।
তবে কুড়িগ্রামের অভ্যন্তরের ছিটমহলগুলোর অধিবাসীদের মধ্যে ভারতে যাবার জন্য নিবন্ধিতরা জানায়, ভারতের পত্রিকাগুলোর রিপোর্টে বলা হচ্ছে- পূনর্বাসনের আশ্বাস দেখে ছিটবাসীরা ভারতে আসার জন্য উৎসাহ বোধ করছেন। এতে করে আমাদের প্রতি একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। আসলে আমাদের পরিবারের অনেকেই দীর্ঘসময় ধরে ভারতে অবস্থান করার পাশাপাশি সেখানে কাজকর্মও করে আসছে। তাই আমরাও ভারতে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করেছি। আমরা যেন সেখানে গিয়ে নিরাপদে থাকতে পারি, প্রতারণার শিকার না হই এটাই সরকারের কাছে দাবি।
ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা জানান, ছিটমহল বিনিময়ের এই চূড়ান্ত মুহুর্তে আমরা উচ্ছসিত। তবে সরকারীভাবে বরণ করে এই মূহুর্তটি উদযাপন করলে আমরা বেশি খুশি হতে পারতাম। তবুও দীর্ঘ ৬৮ বছরের প্রতিক্ষার ফল আজ আমাদের হাতে চলে এসেছে।
তিনি আরো জানন, কুড়িগ্রামের ১২টি ছিটমহলের প্রায় সাড়ে ৮ হাজার মানুষের মধ্যে ভারত যাচ্ছেন মাত্র ৩১৭ জন মানুষ। বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ থাকলেও শেষ পর্যন্ত যারা আগ্রহী তারা যেন যেতে পারে সেটাই ভাবছে দুই দেশের সরকার।
ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির বাংলাদেশ অংশের সভাপতি মইনুল হক বলেন, আজ আমাদের আনন্দের দিন। আমরা সেজন্য বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছি।
তিনি জানান, ছিটবাসীদের পূনর্বাসনের জন্য ভারত কুচবিহারে আন্তর্জাতিক মানের আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকারের ১১১টি ছিটমহলের উন্নয়নে বরাদ্দ রেখেছে মাত্র ২শ কোটি টাকা। যা খুবই অপ্রতুল।