ইসলামী দলগুলো নিয়ে ১৪ দলীয় জোটে অসন্তোষ

মূলত বাম ও গণতান্ত্রিক প্রগতিশীলদের সমন্বয়ে গড়া ১৪ দলে ইসলামপন্থী দলের সংখ্যা বাড়তে যাচ্ছে। এরই মধ্যে এ জোটের নেতাদের সঙ্গে ইসলামী ঐক্য ফ্রন্ট বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক আলোচনাও হয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সমর্থক ভোটারদের পক্ষে টানতেই ক্ষমতাসীন জোটের রং বদলের এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে ১৪ দলের বাম শরিকরা জোটে ইসলামীপন্থীদের অন্তর্ভুক্তির বিরুদ্ধে মত দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ১৪ দলীয় জোটের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। ক্ষমতাসীন জোটের শরিকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

১৪ দলের নেতারা বলেছেন, ভোটের মাঠে প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি-জামায়াতই এতদিন মূলত এ দেশের ইসলামভিত্তিক রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে। আগামী নির্বাচনে এই ভোটে ভাগ বসাতে চায় আওয়ামী লীগ। তারা এ লক্ষ্যেই কট্টর নয়, এমন দু-একটি ইসলামী দলকে ১৪ দলে যুক্ত করার পরিকল্পনা করছে। এরই মধ্যে দলটি হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছে। এ সংগঠনটিতে বেশ কয়েকটি ইসলামপন্থী দল আছে। কয়েকটি আবার ২০ দলীয় জোটে রয়েছে।

হেফাজতের সঙ্গে থাকা দলগুলোর মধ্যে আছে- ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্য আন্দোলন, জমিয়াতুল উলামা ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ইত্যাদি। সরাসরি ১৪ দল বা মহাজোটে না টানলেও এদের সঙ্গে এক ধরণের রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে সরকারের তরফ থেকে।

বিগত সংসদ নির্বাচনের আগেও ইসলামপন্থী দল তরীকত ফেডারেশনকে ১৪ দলে নেওয়া হয়। বিএনপি-জামায়াতের ধর্মভিত্তিক ভোটে ভাগ বসাতে সরকারের অংশীদার জাতীয় পার্টিকেও ইসলামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে জাপা চেয়ারম্যান এরশাদের নেতৃত্বে একটি প্ল্যাটফর্ম আত্মপ্রকাশ করেছে।

একাধিক সূত্র জানায়, গত শনিবার ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে ১৪ দলের বৈঠকে জোট সম্প্রসারণ বিষয়ে আলোচনা হয়। ওই বৈঠকে ইসলামী ঐক্য ফ্রন্ট বাংলাদেশের কয়েকজন নেতাকে উপস্থিত থাকতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এতে সাড়া দিয়ে ওই দলটির সভাপতি সৈয়দ বাহাদুর শাহ মোজাদ্দেদী ও মহাসচিব জয়নুল আবেদিন জুবায়েরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল উপস্থিত হয় এবং ১৪ দলে যোগদানের আগ্রহ জানায়। ফ্রন্ট নেতারা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন বলেও ১৪ দলের নেতাদের আশ্বস্ত করেন।

তাদের বক্তব্যের পর ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম বলেন, আপনাদের বক্তব্য শুনলাম। আমরা জোটের মধ্যে এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করে আপনাদের জানাব।

জানতে চাইলে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, তাদের জোটে নেওয়ার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। দলটির নেতারা আমাদের বৈঠকে এসেছেন, আলাপ-আলোচনা হয়েছে, তবে জোটে নেওয়া হবে এমন কোনো কথা হয়নি। সামনে নির্বাচন। এখন অনেকের সঙ্গেই কথাবার্তা হবে। অনেকেই তো জোটে আসতে চান। এমনকি বিএনপির জোট থেকে বেরিয়ে আসা ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্সও আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে আগ্রহী। কিন্তু আমরা তাদের ১৪ দলে নয়, নির্বাচনী জোটে রাখতে চাই।

সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেকমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া বলেন, ১৪ দলেরই এখন কোনো প্রয়োজন বা যৌক্তিকতা নেই। কারণ, কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম মোকাবেলার বিষয় সামনে নেই। এমনকি আগামী নির্বাচনের জন্যও ওই সব দলের ১৪ দলে অন্তর্ভুক্তি কোনো প্রভাব ফেলবে না। যে দলটিকে জোটে নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে সেটির কোনো সংগ্রামী ঐতিহ্য নেই। সেটি পরিছন্ন ভাবমূর্তির কোনো দলও নয়। কাজেই এ দলটিকে ১৪ দলের মতো একটি আদর্শিক জোটে অন্তর্ভুক্তি রাজনীতিতে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলবে বলে আমি মনে করি না। বরং তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হলে তা জোটের মূল চেতনার পরিপন্থী কাজ হবে।

ইসলামপন্থী দলকে ১৪ দলে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে জোটের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগকে সাম্যবাদী দলের আপত্তির কথা জানানো হয়েছে কি না—এ প্রশ্নের জবাবে দিলীপ বড়ুয়া বলেন, ১৪ দলের সর্বশেষ বৈঠকেই একজন নেতা আমাদের আপত্তির কথা তুলে ধরেছেন।

জাসদ (আম্বিয়া) সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়া বলেন, ১৪ দল সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত আগেই নেওয়া আছে। তবে এখন যে দলটিকে নেওয়ার কথা চলছে, তাদের বিষয়ে আমাদের স্পষ্ট কোনো ধারণাই নেই। এমনকি আমাদের জোটে থাকা ইসলামী দল তরীকত ফেডারেশনও তাদের চেনে না। আর দলটি মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনায় বিশ্বাস করে কি না সেটাও দেখতে হবে। এখন তারা যদি ইসলামিক রিপাবলিক চায় তাহলে তো আর ঐক্য করা যাবে না। আর তাদের দলের নামটাও তো সেক্যুলার রাজনীতির উপযোগী নয়।

আম্বিয়া আরো বলেন, তবে ১৪ দলের সর্বশেষ বৈঠকে ইসলামী ঐক্যফ্রন্টকে জোটে নেওয়ার সম্ভাবনা নাকচ করা হয়নি। তাদের সম্পর্কে জানা ও বোঝার জন্য সময় নেওয়া হয়েছে। এখন তাদের ১৪ দলে নাকি নির্বাচনী জোটে নেওয়া হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার বলেন, ১৪ দল একটি আদর্শভিত্তিক জোট। এখান থেকে সরে আসার কোনো জায়গা নেই। ইসলামী ঐক্যফ্রন্ট আগে মহাজোটের সঙ্গে ছিল। দলটি আমাদের জানিয়েছে, তারা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। তবে তাদের জোটে নেওয়ার বিষয়ে কিছুই চূড়ান্ত হয়নি।

ন্যাপের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন বলেন, ১৪ দলের নীতিগত অবস্থান থেকে সরে ইসলামীকরণের দিকে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমরা অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল রাজনীতিচর্চার বিষয়ে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ। এ অবস্থান বদলে ফেলার কোনো প্রশ্নই আসে না।

গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন বলেন, ১৪ দল একটি আদর্শিক জোট। এর সম্প্রসারণ করতে চাইলে আদর্শিক মিল আছে এমন দলকে যুক্ত করেই তা করতে হবে। প্রয়োজন মনে হলে অন্য কোনো দলের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা বা ঐক্য হতে পারে।

কমিউনিস্ট কেন্দ্রের যুগ্ম আহ্বায়ক অসীত বরণ রায় বলেন, তারা (ইসলামী ঐক্যফ্রন্ট) আমাদের বৈঠকে এসেছে, কথা বলেছে। কিন্তু মনে হয় না তাদের জোটে নেওয়া হবে।

ইসলামী ঐক্য ফ্রন্ট বাংলাদেশকে জোটে টানতে আওয়ামী লীগের আগ্রহ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অসীত বরণ বলেন, সেটা আওয়ামী লীগের ব্যাপার। তারা ভোটের রাজনীতির হিসাব-নিকাশ অনেক কিছুই করতে বা ভাবতে পারে। কিন্তু তার দায়িত্ব তো আর আমরা নেব না। ১৪ দল একটি অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল রাজনৈতিক জোট। জোটের এ চরিত্র বজায় রাখতে হবে।

জাতীয় পার্টির (জেপি) সাধারণ সম্পাদক শেখ শহীদুল ইসলাম বলেন, ১৪ দলে এরই মধ্যে একটি ইসলামী দল আছে। ফলে ইসলামী দল হলেই যে তাকে জোটে নেওয়া যাবে না বিষয়টা এমন নয়। তবে এখন যে দলটিকে নেওয়ার কথা চলছে তার বিষয়ে আমরা ওয়াকিবহাল নই। সে জন্য তাদের টানার বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তারা যদি সব ধর্মের সম্মিলনে বিশ্বাসী হয়, আমাদের ন্যূনতম কর্মসূচির সঙ্গে যদি তাদের মতের মিল থাকে, তাহলেই কেবল তাদের জোটে নেওয়া যায়।

ক্ষমতাসীন জোটের একাধিক সূত্র জানায়, ইসলামী ঐক্য ফ্রন্ট বাংলাদেশের সঙ্গে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। আলোচিত এক-এগারো পরবর্তী নির্বাচনে ফ্রন্টের সভাপতি সৈয়দ বাহাদুর শাহ মোজাদ্দেদীকে একটি আসন ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ, যদিও তিনি হেরে যান। ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে বিএনপির আন্দোলনের বিরুদ্ধেও নানা কর্মসূচি পালন করেছে ইসলামী ঐক্য ফ্রন্ট।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা নির্বাচনের আগে ১৪ দলকে সম্প্রসারণ করতে চাই। তবে কট্টর ইসলামী দলগুলোকে জোটে নেওয়া আমাদের আদর্শের সঙ্গে খাপ খায় না। কিন্তু ইসলামী দলগুলো সঙ্গে থাকলে আমাদের ভোট বাড়বে এতে কোনো সন্দেহ নেই। সে ক্ষেত্রে ইসলামী ঐক্য ফ্রন্টকে সঙ্গে রাখা একটি ভালো কৌশল হবে। তারা এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছে। বিভিন্ন সময়ে জামায়াত-বিএনপির বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে। সে জন্যই তাদের জোটে নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।

ইসলামী ঐক্য ফ্রন্টের সঙ্গে অনুষ্ঠিত ১৪ দলের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন। তিনি বলেন, তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ও প্রগতিশীল রাজনীতিতে বিশ্বাস করে বলে আমাদের জানিয়েছে। আর ২০০৮ সালের নির্বাচনে যে মহাজোট গঠন করা হয়েছিল তারা সেখানেও ছিল। এখন তাদের জোটে নেওয়ার বিষয়টি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে উত্থাপন করা হবে। তিনি সম্মতি দিলে নেওয়া হবে।

প্রসঙ্গত, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলার পর ১৪ দল গঠনের উদ্যোগ শুরু হয়। নানামুখী চেষ্টার ফলে পরের বছর ২৩ দফা ঘোষণা সামনে রেখে বাম প্রগতিশীল জোট ১১ দল, আওয়ামী লীগ, জাসদ ও ন্যাপ মিলে ১৪ দল গঠিত হয়। পরে সিপিবি, বাসদসহ ১১ দলের চারটি দল বেরিয়ে যায়।

ওয়ার্কার্স পার্টি, গণফোরাম, সাম্যবাদী দল, গণতন্ত্রী পার্টি, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, বাসদ (একাংশ)—এ আটটি দল ১৪ দলে থেকে যায়। ফলে সে সময়ে ১৪ দল মূলত ১১ দলীয় জোটে পরিণত হয়। পরে গণফোরাম জোট থেকে বাদ পড়ে। এতে ১৪ দল ১০ দলীয় জোটে পরিণত হয়।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কিছু আগে ডানপন্থী জাতীয় পার্টি জেপি ও তরীকত ফেডারেশনকে জোটে নেওয়া হয়। বছরখানেক আগে জাসদ ভেঙে দু’টি আলাদা জাসদ গঠিত হয়। দুই জাসদই বর্তমানে ১৪ দলে রয়েছে। ফলে জোটটিতে এখন ১৩টি দল রয়েছে। ইসলামী ঐক্য ফ্রন্টকে নিলে ১৪ দলীয় জোট আসলেই ১৪ দলে পরিণত হবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর