ঢাকা ০৯:৩২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কেউ শোনে না হাওরের কান্না

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:২৭:৩০ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৬ এপ্রিল ২০১৭
  • ৩৯০ বার

ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস- ‘গ্রাম থাইক্কা স্বজনরা ফোন করতাছে, চৈত মাসে অভাইগ্যা আষাঢ়ের ঢল মানুষের এই বচ্ছরের আশাডারে লন্ডভন্ড কইরা দিতাছে। বেকতা মিইল্ল্যা একটাই কতা একটাই দাবি- আমাগো সরহার (সরকার), লেম্বার (মেম্বার), চিয়ারম্যান আর এমপি আওহাইন খারোওহাইন আমরার সাথে। মোডেতো একটাই বান-চরহাজদিয়ার বেরি বান। মোহনগঞ্জ থাইক্কা গাগলাজুর-আইজ ক্যালা আমিলীগ, ক্যালা বিম্পি-এইতা নাই। বেহেই আইজ ঐ বান্দের কানিত সংসার ফাতছে, হেরার চউখ্খো ঘুম নাই। হেরা আমার বাফ হেরাই আমার মা, আমার বাই বইন। বান্দের ফানি একটু চুয়ায় আর দৌওইরা যায়। কেউ মাডি লইয়া কেউ উঁরা লইয়া। পুরা হাওরডাই হেরার সামনে বাড়া ভাত। হে মাবুদ আইজ বাড়া ভাতে পানি ডাল্লা! বউ পোলা এসির তল গুমাইতাছে আমরার তো গুম নাই। কি খবর? কি খবর? সারা রাইত ধইরা ফোন আর ফোন। এই শ্যাষ! সব শ্যাষ!!’ আহা, এই করুণ আর্তনাদ- তুমি অন্তত শুনো প্রভু- দোহায় তোমার! পত্রিকার পাতায়, অনলাইনে, ফেসবুকে, টিভিতে হামেশাই প্রচারিত হচ্ছে হাওরের অকাল বন্যার খবর। এসব খবর দেখে, পড়ে বুক ভারি হয়ে যায়। উফ্ কি নিদারুণ অসহায়ত্ব! কৃষকের কষ্ট ভাগ করতে হয়তো পারবো না- তবে বিধাতার কাছে ফরিয়াদ জানাতে পরবো- ‘হে দয়ার বিধাতা তুমি কোথায়! দেখ তোমার সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবের করুণ আহাজারি! তুমি রক্ষা করো, দয়া করো প্রভু- যা মানুষ পারে না, তা শুধু তুমিই পারো।’ বাঁধে মাটি দিতে গ্রামের মসজিদের মাইকে কৃষকদের জড়ো হওয়ার আহŸান জানানো হচ্ছে। সাংবাদিক সম্মেলন, মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা করে কৃষকরা অভিযোগ করেছেন এ বছর প্রায় ৫৫ কোটি টাকা হাওরের বোরো ফসলরক্ষা বাঁধে সরকার বরাদ্দ দিলেও যথা সময়ে কাজ শুরু হয়নি। বাঁধের বরাদ্দ পাউবো ও সংশ্লিষ্টরা মিলে লোপাট করেছে। সদায়শয় সরকার কি শুনতে পাচ্ছেন হাওরবাসীর কান্না? হাওর ও জলাভ‚মি অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ড কি গভীর তন্দ্রাছন্ন? প্রিয় কাকের মতোন কা কা করা জনপ্রতিনিধিরা উন্নয়নের ঢাকঢোল পিটিয়ে কি করেন সারা বছর। এই তার প্রতিফলন!
আপনি কি জানেন, হাওরে কাঁচা-পাকা ধানের শিষগুলো কৃষকের একমুঠো সুখে থাকার আশা যখন অসময়ে পাহাড়ি ঢলে পানির নিচে তলিয়ে যায়- তখন কেমন লাগে। এইতো কদিনের মধ্যেই পাকা ধান ঘরে তোলে স্বপ্ন ফসলে ভরে উঠতো কৃষকের গোলা। কষ্ট তখন সার্থক হতো। কিন্তু হয়ে গেল- চোখের সামনে তলিয়ে গেল সোনার ফসল। প্রকৃতির কাছে এই অসহায়ত্ব কিযে নিদারুণ কষ্টের তা কি আমরা অনুভব করতে পারি না। হাওরের মাছের কি স্বাদ, হাওরের ধানের চালের কি মৌ সুবাস, হাওরের পাখির কলতান অথবা মাংসের স্বাদ, টাঙুয়ার হাওরের সুন্দরের লীলাকেতন হয়তো আমাদের স্মৃতিতে অ¤øান। কিন্তু হাওরের মানুষের কষ্ট আমরা কতটা বুঝি। হাওরের কৃষকদের বুকভরা আশা ধুয়েমুছে যাচ্ছে হাওরের বাঁধভাঙা পানিতে। বোরো ফসল রক্ষায় পানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পেরে উঠছেন না হাওরের মানুষগুলো। একের পর এক বাঁধ ভাঙছে আর ডুবছে ঘাম ঝাড়ানো, স্বপ্ন বোনা ফসল। আচ্ছা সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড, কৃষি মন্ত্রণালয়, সুনামগঞ্জে হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর, ‘হাওর এলাকায় আগাম বন্যা প্রতিরোধ ও নিষ্কাশন উন্নয়ন প্রকল্পের’, ‘হাওর এলাকায় বন্যা ব্যবস্থাপনা ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন প্রকল্প’ তারা কি করছেন? শোনা যায় ষোলশ কোটি টাকার কাজ হয়েছে। কোথায়, কি কাজ হলো খুব জানতে ইচ্ছে করছে! পাহাড়ি ঢলে হাওর রক্ষা বাঁধ প্রতি বছর কেন ভেঙে যায়। কোটি কোটি টাকা খরচা করেও কি বাঁধগুলো স্থায়ীভাবে গড়ে তোলা সম্ভব নয়? হাওর এলাকার উন্নয়নে ২৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি দেড় শতাধিক প্রকল্প সংবলিত ‘হাওর মহাপরিকল্পনা’ গ্রহণ করা হয়। এর প্রতিফলন আমরা কি এই দেখছি যে চোখের সামনে কষ্টের ফসল পানির নিচে ডুবে যাবে। বোরো একটি ফসলই হাওরবাসীর জিয়নকাঠি। অথচ এই হাওরের বাতাসে ভেসে আসে ফসলহারা মানুষের করুণ আর্তনাদ। বৃষ্টিপাতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় ও পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙে প্রতি মুহূর্তে চোখের সামনে ডুবছে হাওর। বাঁধ ভেঙে প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর ফসলি জমি ডুবে গেছে। চোখের সামনে কষ্টের ফসল পানির নিচে ডুবে যাবে। ঋণ, কর্জ, লগ্নি আর খেয়ে-না খেয়ে কষ্টার্জিত ফসল তলিয়ে গেলেও কৃষক কিছুই করতে পারে না। প্রায় প্রতি বছরই তাদের এরকম দুঃষহ দুর্ভোগ-দুর্ভাবনার মুখোমুখি হতে হয়। কি কেন? মাছ আর ধান দিয়ে দেশকে খাদ্য ও পুষ্টিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেন এই হাওরবাসীরা। তাদের ভাগ্যে এত দুর্ভোগ কেন? বাঁধ তৈরি আর সংস্কারের নামে প্রতি বছর বিপুল অংকের টাকা নিয়ে নয়-ছয় করা হলেও হাওর রক্ষা বাঁধগুলোকে পরিকল্পিত ও স্থায়ীভাবে কেন গড়ে তোলা হয় না। মাননীয় সরকার, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এখনই হাওর নিয়ে ভাবুন। সম্মানীয় কৃষি বিজ্ঞানীদের সবিনয় নিবেদন আপনারা হাওরের উপযোগী কম সময়ে অধিক ফলন সম্ভব এমন ধানের নতুন নতুন জাতের উদ্ভাবন করুন। আর সদাশয় কৃষি মন্ত্রণালয়, হাওর উন্নয়ন বোড হাওরাঞ্চলে বোরো ফসল কম সময়ে উৎপাদনশীল ধানের জাত কৃষকের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করুন। তাদের প্রশিক্ষণ দিন, ঋণ সহায়তা দিন। শুকনো মৌসুমে হাওরের পতিত জমিতে সরিষা, মাসকলাই, মসুরকলাই, ভুট্টা, গম, শীতকালীন সবজি উৎপাদনে উৎসাহিত করুন। বর্ষায় আখ চাষ করা যায় কিনা ভাবুন। ভাসমান সবজি চাষ, কুটির শিল্প, গরু-ছাগল (বø্যাকবেঙ্গল)-মহিষ পালন, হাস ও মুরগির খামার প্রভৃতি প্রকল্পভিত্তিক বাস্তবায়ন উদ্যোগ নিলে হাওরের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব ও টেকসই হবে। আমাদের মনে রাখা দরকার বছরে প্রায় তিন লাখ টন ধান উৎপাদন করে দেশের খাদ্য চাহিদা মেটায় হাওরবাসী। শুধু ধান নয়- হাওরাঞ্চলে রয়েছে প্রাকৃতিক মৎস্য ভান্ডার। দেশীয় জাতে বিলুপ্তপ্রায় অনেক জাতের মাছ এখনো হাওরাঞ্চলে পাওয়া। দেশের আহরিত মাছের শতকরা ২৫ থেকে ৩৫ ভাগ হাওরাঞ্চল থেকে আহরণ করা হয়। বছরে শত কোটি টাকার মাছ পাওয়া যায় হাওরে। হাওরের জলাবদ্ধ ভূমিতে জন্মে নলখাগড়া, হিজল, করচ, ইকরা, জিংলা, বাঁশ এবং প্রচুর বনজসম্পদ। জাতীয় অর্থনীতিতে এত অবদান থাকার পরও হাওরবাসীর ফসল রক্ষা বেড়িবাঁধ প্রায় প্রতি বছর ভেঙে যায়। এই ফসল রক্ষা বাঁধ নিয়ে দীর্ঘদিনের নানা অনিয়ম আর নির্দয় অবহেলার খেসারত দিতে দিতে হাওরবাসীর জীবন এখন প্রায় নিঃশেষ হতে যাচ্ছে।
হাওরে কাঁচা-পাকা ধানের শীষগুলো কৃষকের সুখে থাকার একমুঠো আশা। যখন অসময়ে পাহাড়ি ঢলে পানির নিচে তলিয়ে যায় তখন কেমন লাগে। এ শুধু কৃষকই জানেন- আমি তার কি বুঝি! প্রকৃতির কাছে এই অসহায়ত্ব কী যে নিদারুণ কষ্টের তা কি এই শহুরে বাঙালিরা অনুভব করতে পারবে। বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার চন্দ্রসোনারথাল হাওরের ৫০০ হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়ে গেছে। দিরাই উপজেলার বরাম হাওরের তুফানখালি, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সোনাতলা কাইক্কার ধাইর হাওরের ২০০ একর জমির ধান তলিয়ে গেছে। ঝুঁকিতে রয়েছে তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওর, মাটিয়ান হাওর, জগন্নাথপুর উপজেলার নলুয়া ও মইয়ার হাওরসহ জেলার আরও একাধিক হাওরের কাঁচা ধান। তাহিরপুর উপজেলার বোরো ভান্ডার খ্যাত শনি ও মাটিয়ান হাওরেও পানি ডুকছে। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের একটি ও খালিয়াজুরির ১০টি ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে খালিয়াজুরির আরও ১২টি বাঁধ। এ ছাড়া জেলার কলমাকান্দা ও দুর্গাপুরে বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে বৃষ্টির কারণে খেতের ফসল পানির নিচে তলিয়ে গেছে। জেলা কৃষি কার্যালয় সূত্র বলছে, চারটি উপজেলা মিলে অন্তত সাড়ে চার হাজার হেক্টর ফসলি জমি পানির নিচে। হাওরের কৃষকদের বুকভরা আশা ধুয়ে-মুছে যাচ্ছে হাওরের বাঁধভাঙা পানিতে। বোরো ফসল রক্ষায় পানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পেরে উঠছেন না হাওরের মানুষ। একের পর এক বাঁধ ভাঙছে আর ডুবছে ঘাম ঝরানো, স্বপ্নবোনা সোনার ফসল। হাওর এলাকার উন্নয়নে ২৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি দেড় শতাধিক প্রকল্প সংবলিত হাওর মহাপরিকল্পনার এই কি প্রতিফলন? আমাদের পানি উন্নয়ন বোর্ড আছে- তেনারা কি করছেন কে জানে। হাওরের উন্নয়নে একটি অধিদপ্তর আছে তাদের যে জনবল রয়েছে তা হাওরের উন্নয়নে কতটা ভ‚মিকা রাখবে এ নিয়ে আমার খুব দুর্ভাবনা হয়। তাছাড়া তাদের সাথে হাওরের সংযোগ আছে কিনা সন্দেহ?

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

কেউ শোনে না হাওরের কান্না

আপডেট টাইম : ১১:২৭:৩০ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৬ এপ্রিল ২০১৭

ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস- ‘গ্রাম থাইক্কা স্বজনরা ফোন করতাছে, চৈত মাসে অভাইগ্যা আষাঢ়ের ঢল মানুষের এই বচ্ছরের আশাডারে লন্ডভন্ড কইরা দিতাছে। বেকতা মিইল্ল্যা একটাই কতা একটাই দাবি- আমাগো সরহার (সরকার), লেম্বার (মেম্বার), চিয়ারম্যান আর এমপি আওহাইন খারোওহাইন আমরার সাথে। মোডেতো একটাই বান-চরহাজদিয়ার বেরি বান। মোহনগঞ্জ থাইক্কা গাগলাজুর-আইজ ক্যালা আমিলীগ, ক্যালা বিম্পি-এইতা নাই। বেহেই আইজ ঐ বান্দের কানিত সংসার ফাতছে, হেরার চউখ্খো ঘুম নাই। হেরা আমার বাফ হেরাই আমার মা, আমার বাই বইন। বান্দের ফানি একটু চুয়ায় আর দৌওইরা যায়। কেউ মাডি লইয়া কেউ উঁরা লইয়া। পুরা হাওরডাই হেরার সামনে বাড়া ভাত। হে মাবুদ আইজ বাড়া ভাতে পানি ডাল্লা! বউ পোলা এসির তল গুমাইতাছে আমরার তো গুম নাই। কি খবর? কি খবর? সারা রাইত ধইরা ফোন আর ফোন। এই শ্যাষ! সব শ্যাষ!!’ আহা, এই করুণ আর্তনাদ- তুমি অন্তত শুনো প্রভু- দোহায় তোমার! পত্রিকার পাতায়, অনলাইনে, ফেসবুকে, টিভিতে হামেশাই প্রচারিত হচ্ছে হাওরের অকাল বন্যার খবর। এসব খবর দেখে, পড়ে বুক ভারি হয়ে যায়। উফ্ কি নিদারুণ অসহায়ত্ব! কৃষকের কষ্ট ভাগ করতে হয়তো পারবো না- তবে বিধাতার কাছে ফরিয়াদ জানাতে পরবো- ‘হে দয়ার বিধাতা তুমি কোথায়! দেখ তোমার সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবের করুণ আহাজারি! তুমি রক্ষা করো, দয়া করো প্রভু- যা মানুষ পারে না, তা শুধু তুমিই পারো।’ বাঁধে মাটি দিতে গ্রামের মসজিদের মাইকে কৃষকদের জড়ো হওয়ার আহŸান জানানো হচ্ছে। সাংবাদিক সম্মেলন, মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা করে কৃষকরা অভিযোগ করেছেন এ বছর প্রায় ৫৫ কোটি টাকা হাওরের বোরো ফসলরক্ষা বাঁধে সরকার বরাদ্দ দিলেও যথা সময়ে কাজ শুরু হয়নি। বাঁধের বরাদ্দ পাউবো ও সংশ্লিষ্টরা মিলে লোপাট করেছে। সদায়শয় সরকার কি শুনতে পাচ্ছেন হাওরবাসীর কান্না? হাওর ও জলাভ‚মি অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ড কি গভীর তন্দ্রাছন্ন? প্রিয় কাকের মতোন কা কা করা জনপ্রতিনিধিরা উন্নয়নের ঢাকঢোল পিটিয়ে কি করেন সারা বছর। এই তার প্রতিফলন!
আপনি কি জানেন, হাওরে কাঁচা-পাকা ধানের শিষগুলো কৃষকের একমুঠো সুখে থাকার আশা যখন অসময়ে পাহাড়ি ঢলে পানির নিচে তলিয়ে যায়- তখন কেমন লাগে। এইতো কদিনের মধ্যেই পাকা ধান ঘরে তোলে স্বপ্ন ফসলে ভরে উঠতো কৃষকের গোলা। কষ্ট তখন সার্থক হতো। কিন্তু হয়ে গেল- চোখের সামনে তলিয়ে গেল সোনার ফসল। প্রকৃতির কাছে এই অসহায়ত্ব কিযে নিদারুণ কষ্টের তা কি আমরা অনুভব করতে পারি না। হাওরের মাছের কি স্বাদ, হাওরের ধানের চালের কি মৌ সুবাস, হাওরের পাখির কলতান অথবা মাংসের স্বাদ, টাঙুয়ার হাওরের সুন্দরের লীলাকেতন হয়তো আমাদের স্মৃতিতে অ¤øান। কিন্তু হাওরের মানুষের কষ্ট আমরা কতটা বুঝি। হাওরের কৃষকদের বুকভরা আশা ধুয়েমুছে যাচ্ছে হাওরের বাঁধভাঙা পানিতে। বোরো ফসল রক্ষায় পানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পেরে উঠছেন না হাওরের মানুষগুলো। একের পর এক বাঁধ ভাঙছে আর ডুবছে ঘাম ঝাড়ানো, স্বপ্ন বোনা ফসল। আচ্ছা সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড, কৃষি মন্ত্রণালয়, সুনামগঞ্জে হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর, ‘হাওর এলাকায় আগাম বন্যা প্রতিরোধ ও নিষ্কাশন উন্নয়ন প্রকল্পের’, ‘হাওর এলাকায় বন্যা ব্যবস্থাপনা ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন প্রকল্প’ তারা কি করছেন? শোনা যায় ষোলশ কোটি টাকার কাজ হয়েছে। কোথায়, কি কাজ হলো খুব জানতে ইচ্ছে করছে! পাহাড়ি ঢলে হাওর রক্ষা বাঁধ প্রতি বছর কেন ভেঙে যায়। কোটি কোটি টাকা খরচা করেও কি বাঁধগুলো স্থায়ীভাবে গড়ে তোলা সম্ভব নয়? হাওর এলাকার উন্নয়নে ২৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি দেড় শতাধিক প্রকল্প সংবলিত ‘হাওর মহাপরিকল্পনা’ গ্রহণ করা হয়। এর প্রতিফলন আমরা কি এই দেখছি যে চোখের সামনে কষ্টের ফসল পানির নিচে ডুবে যাবে। বোরো একটি ফসলই হাওরবাসীর জিয়নকাঠি। অথচ এই হাওরের বাতাসে ভেসে আসে ফসলহারা মানুষের করুণ আর্তনাদ। বৃষ্টিপাতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় ও পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙে প্রতি মুহূর্তে চোখের সামনে ডুবছে হাওর। বাঁধ ভেঙে প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর ফসলি জমি ডুবে গেছে। চোখের সামনে কষ্টের ফসল পানির নিচে ডুবে যাবে। ঋণ, কর্জ, লগ্নি আর খেয়ে-না খেয়ে কষ্টার্জিত ফসল তলিয়ে গেলেও কৃষক কিছুই করতে পারে না। প্রায় প্রতি বছরই তাদের এরকম দুঃষহ দুর্ভোগ-দুর্ভাবনার মুখোমুখি হতে হয়। কি কেন? মাছ আর ধান দিয়ে দেশকে খাদ্য ও পুষ্টিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেন এই হাওরবাসীরা। তাদের ভাগ্যে এত দুর্ভোগ কেন? বাঁধ তৈরি আর সংস্কারের নামে প্রতি বছর বিপুল অংকের টাকা নিয়ে নয়-ছয় করা হলেও হাওর রক্ষা বাঁধগুলোকে পরিকল্পিত ও স্থায়ীভাবে কেন গড়ে তোলা হয় না। মাননীয় সরকার, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এখনই হাওর নিয়ে ভাবুন। সম্মানীয় কৃষি বিজ্ঞানীদের সবিনয় নিবেদন আপনারা হাওরের উপযোগী কম সময়ে অধিক ফলন সম্ভব এমন ধানের নতুন নতুন জাতের উদ্ভাবন করুন। আর সদাশয় কৃষি মন্ত্রণালয়, হাওর উন্নয়ন বোড হাওরাঞ্চলে বোরো ফসল কম সময়ে উৎপাদনশীল ধানের জাত কৃষকের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করুন। তাদের প্রশিক্ষণ দিন, ঋণ সহায়তা দিন। শুকনো মৌসুমে হাওরের পতিত জমিতে সরিষা, মাসকলাই, মসুরকলাই, ভুট্টা, গম, শীতকালীন সবজি উৎপাদনে উৎসাহিত করুন। বর্ষায় আখ চাষ করা যায় কিনা ভাবুন। ভাসমান সবজি চাষ, কুটির শিল্প, গরু-ছাগল (বø্যাকবেঙ্গল)-মহিষ পালন, হাস ও মুরগির খামার প্রভৃতি প্রকল্পভিত্তিক বাস্তবায়ন উদ্যোগ নিলে হাওরের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব ও টেকসই হবে। আমাদের মনে রাখা দরকার বছরে প্রায় তিন লাখ টন ধান উৎপাদন করে দেশের খাদ্য চাহিদা মেটায় হাওরবাসী। শুধু ধান নয়- হাওরাঞ্চলে রয়েছে প্রাকৃতিক মৎস্য ভান্ডার। দেশীয় জাতে বিলুপ্তপ্রায় অনেক জাতের মাছ এখনো হাওরাঞ্চলে পাওয়া। দেশের আহরিত মাছের শতকরা ২৫ থেকে ৩৫ ভাগ হাওরাঞ্চল থেকে আহরণ করা হয়। বছরে শত কোটি টাকার মাছ পাওয়া যায় হাওরে। হাওরের জলাবদ্ধ ভূমিতে জন্মে নলখাগড়া, হিজল, করচ, ইকরা, জিংলা, বাঁশ এবং প্রচুর বনজসম্পদ। জাতীয় অর্থনীতিতে এত অবদান থাকার পরও হাওরবাসীর ফসল রক্ষা বেড়িবাঁধ প্রায় প্রতি বছর ভেঙে যায়। এই ফসল রক্ষা বাঁধ নিয়ে দীর্ঘদিনের নানা অনিয়ম আর নির্দয় অবহেলার খেসারত দিতে দিতে হাওরবাসীর জীবন এখন প্রায় নিঃশেষ হতে যাচ্ছে।
হাওরে কাঁচা-পাকা ধানের শীষগুলো কৃষকের সুখে থাকার একমুঠো আশা। যখন অসময়ে পাহাড়ি ঢলে পানির নিচে তলিয়ে যায় তখন কেমন লাগে। এ শুধু কৃষকই জানেন- আমি তার কি বুঝি! প্রকৃতির কাছে এই অসহায়ত্ব কী যে নিদারুণ কষ্টের তা কি এই শহুরে বাঙালিরা অনুভব করতে পারবে। বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার চন্দ্রসোনারথাল হাওরের ৫০০ হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়ে গেছে। দিরাই উপজেলার বরাম হাওরের তুফানখালি, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সোনাতলা কাইক্কার ধাইর হাওরের ২০০ একর জমির ধান তলিয়ে গেছে। ঝুঁকিতে রয়েছে তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওর, মাটিয়ান হাওর, জগন্নাথপুর উপজেলার নলুয়া ও মইয়ার হাওরসহ জেলার আরও একাধিক হাওরের কাঁচা ধান। তাহিরপুর উপজেলার বোরো ভান্ডার খ্যাত শনি ও মাটিয়ান হাওরেও পানি ডুকছে। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের একটি ও খালিয়াজুরির ১০টি ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে খালিয়াজুরির আরও ১২টি বাঁধ। এ ছাড়া জেলার কলমাকান্দা ও দুর্গাপুরে বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে বৃষ্টির কারণে খেতের ফসল পানির নিচে তলিয়ে গেছে। জেলা কৃষি কার্যালয় সূত্র বলছে, চারটি উপজেলা মিলে অন্তত সাড়ে চার হাজার হেক্টর ফসলি জমি পানির নিচে। হাওরের কৃষকদের বুকভরা আশা ধুয়ে-মুছে যাচ্ছে হাওরের বাঁধভাঙা পানিতে। বোরো ফসল রক্ষায় পানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পেরে উঠছেন না হাওরের মানুষ। একের পর এক বাঁধ ভাঙছে আর ডুবছে ঘাম ঝরানো, স্বপ্নবোনা সোনার ফসল। হাওর এলাকার উন্নয়নে ২৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি দেড় শতাধিক প্রকল্প সংবলিত হাওর মহাপরিকল্পনার এই কি প্রতিফলন? আমাদের পানি উন্নয়ন বোর্ড আছে- তেনারা কি করছেন কে জানে। হাওরের উন্নয়নে একটি অধিদপ্তর আছে তাদের যে জনবল রয়েছে তা হাওরের উন্নয়নে কতটা ভ‚মিকা রাখবে এ নিয়ে আমার খুব দুর্ভাবনা হয়। তাছাড়া তাদের সাথে হাওরের সংযোগ আছে কিনা সন্দেহ?